মন্ত্রী মশাই খবরটা দেখেছেন নিশ্চয়। আপনি তো দেখবেনই তাই না? আপনার শ্রমিকদের অবদান। কত সফল আন্দোলন করলো আপনার পরিবহন শ্রমিকরা। তার ফল একটা সাত দিনের শিশুর লাশ। পড়েছেন তো খবরের কাগজে, দেখেছেন তো টিভির পর্দায়। খুব হাসি পেয়েছে নিশ্চয়, দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে হেসেছেন তো এই সংবাদে। যদিও জানেন কিভাবে মারা গেল সাত দিনের কন্যাশিশুটি। তারপরও বলি, আপনার শ্রমিকদের পরিবহন ধর্মঘটের কারণে। তারা অ্যাম্বুলেন্সটি আটকে রেখেছিল। পথে দফায় দফায় আটকেছে। বাবা-মামার করুণ আর্তি, কান্না তাদের মন গলাতে পারেনি। আপনার যোগ্য সিপাহি তারা, ইমোশনে ধর্মঘটে শিথিলতা দেখায়নি। কে মরল বা বাঁচল তাদের কী এসে গেল।
কী পাথর হৃদয় কর্মী বাহিনী আপনার, বাচ্চাটা মারা যাচ্ছে দেখেও তারা অ্যাম্বুলেন্স ছাড়েনি। অসুস্থ শিশুটি বিনা চিকিৎসায় মারা গেল পথে, অ্যাম্বুলেন্সের ভিতরে। তাদের এই সাফল্যে পুরস্কার দেবেন নিশ্চয়। আপনার ও আপনার কর্মীদের, পরিবহন শ্রমিকদের কঠোর শাস্তি দাবি করছি। প্রধানমন্ত্রী আপনি এই অন্যায়ের বিচার করুন। আপনার কাছেই দাবি জানাই। কারণ, পরিহন শ্রমিকদের নেতা আপনার একজন মন্ত্রী। মন্ত্রী মশাইয়ের ছত্রচ্ছায়ায় এই অন্যায় অনাচার করে চলেছে পরিবহন শ্রমিকরা।
দশম সংসদের শেষ অধিবেশনের শেষ লগ্নে এসে কেন এই ধর্মঘট ডাকবে তারা? এই আইন পাশ হবার আগে দফায় দফায় শ্রমিকদের নেতা, বাস মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিরা বসেছে সরকারের সাথে। আর যে বিল পাশ হয়ে গেছে একমাস আগে তার বিরুদ্ধে এতো দিন পরে কেন আন্দোলন করবে। নাকি মন্ত্রী মশাই নিজের ক্ষমতা ও দম্ভ দেখালেন প্রধানমন্ত্রীকে, আগামী নির্বাচনে যেন তার নমিনেশনে কোন গড়বড় না হয়। এটা কি হুমকি দিলেন নাকি মন্ত্রী মশাই প্রশাসনের উপর ছড়ি ঘুরিয়ে দেখালেন, দেখ আমি চাইলে কি না করতে পারি। মন্ত্রী সাহেব আপনি যা পারেন তাতে ভালো কিছু নেই। যা পারেন না, তা হল ন্যায়ভাবে কিছু চাওয়া। স্কুলের বাচ্চাবাচ্চা ছেলেমেয়ে, ৪/৫ দিন ধরে পথ রোধ করে ছিল, সেই দিনগুলোতে দেখুন কী হয়েছে, অ্যাম্বুলেন্সকে আলাদা রাস্তা করে সবার আগে যেতে দিয়েছে। জনগণের সুবিধা-অসুবিধা দেখেছে, রাস্তা পরিষ্কার করেছে। আর আপনার শ্রমিকরা গাড়ী ভাঙচুর, জনগণের গায়ে পোড়া মবিল ছুড়ে মেরেছে। জনে জনে মুখে আলকাতরা মেখে দিয়েছে। সর্বোপরি তাদের কারণে একটি শিশুর করুণ মৃত্যু হয়েছে। খুবই হাস্যকর ব্যপার, আপনি হাসবেন তো, তাই না। মন্ত্রী মশাই হাসুন প্লিজ।
শিশুটির মা সায়রা বেগম শ্রমিকদের বারবার বলেছেন, আমার বাচ্চাটা অসুস্থ। কিন্তু কেউ তার কথা শোনেনি। তিনি বারবার বলেছেন, আমার বাচ্চাটার কষ্ট হচ্ছে, ছেড়ে দাও আমাদের, হাসপাতালে যেতে দাও। তারা উল্টো বলেছে কিসের রোগী? তোমরা বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছ। একেকজন শ্রমিক একেক কথা বলেছে। ধমক দিয়েছে। তিনি ড্রাইভারকে বলেছেন, আমাকে নামিয়ে দাও। আমি হেঁটেই যাব। ততক্ষণে মায়ের চোখের সামনে কোলেই মেয়েটা মারা গেছে। এটা তো খুব আনন্দের বিষয়! মন্ত্রী সাহেব হাসুন প্লিজ। মন্ত্রী মশাই আপনি কোনোদিন এমন কষ্ট পান সেটা আমরা চাই না, তাই বলছি আপনি হাসুন।
আপনার শ্রমিকরা ৮ দফা দাবিতে ধর্মঘট ডেকেছে! গত ১৯ সেপ্টেম্বর ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ জাতীয় সংসদে পাস হয়, এই আইনের কয়েকটি ধারা পরিবর্তনের দাবি করছে তারা। তাদের আট দফা দাবি হলো:
১. সড়ক দুর্ঘটনায় মামলা জামিনযোগ্য করতে হবে;
২. শ্রমিকদের অর্থদণ্ড ৫ লাখ টাকা করা যাবে না;
৩. সড়ক দুর্ঘটনা তদন্ত কমিটিতে শ্রমিক প্রতিনিধি রাখতে হবে;
৪. ড্রাইভিং লাইসেন্সে শিক্ষাগত যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণি করতে হবে;
৫. ওয়েটস্কেলে (ট্রাক ওজন স্কেল) জরিমানা কমানোসহ শাস্তি বাতিল করতে হবে;
৬. সড়কে পুলিশের হয়রানি বন্ধ করতে হবে;
৭. গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের সময় শ্রমিকদের নিয়োগপত্র সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সত্যায়িত স্বাক্ষর থাকার ব্যবস্থা করতে হবে;
৮. সব জেলায় শ্রমিকদের ব্যাপক হারে প্রশিক্ষণ দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করতে হবে এবং লাইসেন্স ইস্যুর ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ করতে হবে।
৬,৭,৮ ছাড়া তাদের বাকি দাবিগুলি নিছক মামা বাড়ির আবদার বলে আমার ব্যক্তিগত মতামত।
মন্ত্রী মশাই আপনাদের মন কঠিন, আপনারা পাথর হৃদয়ের স্বার্থপর মানুষ, নিজের সুবিধা ছাড়া কিছুই বোঝেন না, যে জনগণের ভোটে আজ মন্ত্রী আপনি, সেই জনগণকে জিম্মি করে, নিজের দল ও সরকারের বিরুদ্ধে হরতাল করে কি লাভ হল? মাঝখান থেকে জনরোষ, জনঅসন্তুষ্টি বাড়ল। প্রধানমন্ত্রীকে আরো সমালোচনার মধ্যে ফেললেন। প্রধানমন্ত্রী যে জনগণের কাছে ভোট চাইছেন সেই জনগণকে আপনি দুর্ভোগে ফেলছেন। কারণটা তো বেশ স্পষ্ট , আপনি চাইছেন প্রধানমন্ত্রীকে জনগণ অপছন্দ করুক। তাকে বা তাঁর দলকে না ভোট দিক। না হলে এই সময়ে কেন শ্রমিকদের দিয়ে আপনি ধর্মঘট করার কারণ কি মন্ত্রী সাহেব?
আমাদের জন্য, যে জনগণ আপনাদের ভোট দিয়েছে তাদের জন্য কী করেছেন আপনি? আমাদের ভোট ছাড়া কি আপনি ক্ষমতায় আসতে পারবেন? আপনারা হেলিকপ্টারে চড়ে নির্বাচনী এলাকায় যাবেন ভোট চাইতে, হেলিকপ্টারে চড়ে বোঝাবেন উন্নয়নের চালচিত্র, আমরা খানাখন্দওয়ালা রাস্তায় লুংগি হাটু পর্যন্ত তুলে, শাড়ি উঁচু করে, প্যান্ট পাজামা হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে হেঁটে হেঁটে, আনফিট বাসের ভিড়ে ঘামতে ঘামতে, দুই পাঁচ টাকা ভাড়া কমানো নিয়ে ঝগড়া করতে করতে আপনাদের নির্বাচনী সমাবেশে যোগ দেবো, আবার একইভাবে পদে পদে হেনস্তা হতে হতে ফিরে যাবো, আমাদের ভোট ও সমর্থনের পুরস্কার দিবেন, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে দুর্ভোগ ডেকে এনে। আমাদের আমজনতার মুখে আলকাতরা আর পোড়া মবিল মেখে দিয়ে।
ভোট চাইবার কালে আমরা হয়ে যাই দেশের মালিক কিন্তু নির্বাচন পরবর্তী পাঁচ বছরে আমরা দাসানুদাস আপনাদের। নির্বাচনকালে আমরা সকল ক্ষমতার উৎস। নির্বাচনের পরে আমরা চাকর, বেয়াড়াজাতি আমাদের দমিয়ে রাখতে নিত্যনতুন আইনের মারপ্যাচ, জেল জরিমানা আর ঘানি।
মন্ত্রী মশাই আন্দোলন করবো তো আমরা বিভিন্ন দাবি দাওয়াতে। কিন্তু আপনি সরকারে থেকে কেন সরকারের বিরুদ্ধে, প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে ধর্মঘট করেন? কী তার হেতু? আপনাদের অন্যায় আন্দোলেন ৭ দিনের শিশু মারা গেল, কী জবাব দেবেন তার বাবা-মাকে। কত টাকা দেবেন? সন্তান হারানোর যে ক্ষতি, তার পূরণ কি করতে পারবেন? জানি পারবেন না, তাই আপনার ও আপনার সাঙ্গপাঙ্গের শাস্তি চাই।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এই সন্তান হারা মা-বাবার প্রতি ন্যায় বিচার করুন। পরিবহণ শ্রমিক নেতার কঠোর শাস্তি চাই। কদিন আগে, ডিজিটাল আইনের প্রতিবাদে সম্পাদকরা প্রতিবাদ সমাবেশ করার খবরে আপনি বলেছিলেন, আইন পাশ হবার পর আন্দোলন কেন? আপনার মন্ত্রী, আপনার বক্তব্যকে উপেক্ষা করে, একমাস আগে বিল পাশ হওয়া আইনের প্রতিবাদে দুইদিনের ধর্মঘট ডেকে যে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করল, সেই সাথে একজন নবজাতকের মৃত্যু ঘটালো, তার শাস্তি দাবী করছি। উনার জন্য কঠোর শাস্তির মঞ্জুর করুন। সন্তান হারা মা-বাবার জন্য এইটুকু করুন দয়া করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। না হলে আমাদের মুখে আলকাতরা মাখিয়ে দিক পরিবহণ শ্রমিকরা আর মন্ত্রী মশাইকে আমাদের সামনে এসে হাসতে বলুন। হাহা করে হাসতে বলুন। আমরাও আমাদের কালি মাখা চেহারায় হাত জোড় করে বলবো মন্ত্রী মশাই হাসুন প্লিজ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)