“একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি,
আমি হাসি হাসি পড়বো ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী’’
এই গানটি ক্ষুদিরামের ফাঁসির গান। ক্ষুদিরাম বোস। উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মবলিদানের গৌরবগাথা রচনা করা সর্বকনিষ্ঠ অমর বিপ্লবীর নাম। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে জীবনের জয়গান গাওয়া এক অসমসাহসী প্রতিবাদের নাম। ফাঁসি দিয়ে মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ১৮ বছর, ৭ মাস ১১ দিন। তার পূণ্যস্মৃতির প্রতি সশ্রদ্ধ ইতিনিবেদন।
ক্ষুদিরাম বসু ৩ ডিসেম্বর ১৮৮৯ তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত মেদিনীপুর জেলা শহরের কাছাকাছি কেশপুর থানার অন্তর্গত মোহবনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ত্রৈলকানাথ বসু ছিলেন নাড়াজোল প্রদেশের শহরে আয় এজেন্ট। মা লক্ষীপ্রিয় দেবী। তিন কন্যার পর তিনি মায়ের চতুর্থ সন্তান। তার দুই পুত্র আগেই মৃত্যুবরণ করেন। অপর পুত্রের মৃত্যুর আশংকায় তিনি তখনকার সমাজের নিয়ম অনুযায়ী পুত্রকে তার বড় বোনের কাছে তিন মুঠি খুদের (শস্যের খুদ) বিনিময়ে বিক্রি করে দেন। খুদের বিনিময়ে ক্রয়কৃত শিশুটির নাম পরবর্তীতে ক্ষুদিরাম রাখা হয়। ক্ষুদিরাম বসু পরবর্তিতে তার বড় বোনের কাছেই বড় হন।
ক্ষুদিরাম বসু তার প্রাপ্তবয়সে পৌঁছানোর অনেক আগেই একজন ডানপিটে, বাউন্ডুলে, রোমাঞ্চপ্রিয় হিসেবে পরিচিত লাভ করেন। ১৯০২-০৩ খ্রিস্টাব্দে যখন বিপ্লবী নেতা অরবিন্দ এবং সিস্টার নিবেদিতা মেদিনীপুর ভ্রমণ করে জনসম্মুখে বক্তব্য রাখেন এবং বিপ্লবী দলগুলোর সাথে গোপন পরিকল্পনা করেন, তখন তরুণ ছাত্র ক্ষুদিরাম বিপ্লবে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত হন। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ক্ষুদিরাম তার বোন অপরূপার স্বামী অমৃতর সাথে তমলুক শহর থেকে মেদিনীপুরে চলে আসেন। সেখানে তিনি মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। এখানেই তার বিপ্লবী জীবনের অভিষেক। তিনি বিপ্লবীদের একটি নবগঠিত আখড়ায় যোগ দেন। এটি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ব্রিটিশ বিরোধীদের দ্বারা পরিচালিত হতো। অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই ক্ষুদিরাম তার গুণাবলীর জন্য সবার চোখে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেন। মেধাবী, দুরন্ত এবং কিছুটা বাউণ্ডুলে স্বভাবের কিশোর ক্ষুদিরাম ১৯০৩ সালে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে পড়াশুনা বন্ধ করে দেন। এ সময় তিনি ঝুঁকে পড়েন দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডে। অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সংকল্প গ্রহণ করেন তিনি।
স্কুলের অদূরে ভবানী মন্দির প্রাঙ্গনে গিয়ে সময় কাটাতেন। সেখানে সাক্ষাৎ হলো সত্যেন বসুর সাথে। ১৯০৩ সালে ক্ষুদিরাম তার কাছে গুপ্ত সমিতির (সশস্ত্র বিপ্লববাদী সংগঠন) শিষ্য হিসাবে দীক্ষা গ্রহণ করলেন। এতোদিন পর ক্ষুদিরাম মুক্তভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারলেন। ইচ্ছে মতো পড়াশুনা, খেলাধুলাসহ নানা কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হলেন। বিপ্লবীদের আদর-স্নেহ-ভালবাসায় সিক্ত করলেন নিজেকে। রাজনৈতিক পড়াশুনা ক্রমান্বয়ে বাড়াতে থাকলেন। শপথ গ্রহণ করলেন দেশমাতৃকাকে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য।
১৯০৫ সালের অক্টোবরে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন চলার সময় বরিশালের টাউন হলে অশ্বিনী কুমার বক্তব্য দেন। বক্তব্যে তিনি বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনকে জোরদার করা প্রসঙ্গে তার উপলব্ধির কথা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যে সব বক্তৃতা করে বেড়াচ্ছি, যদি কেউ তা যাত্রাপালা আকারে গ্রামে গ্রামে প্রচার করে, তাহলে তা আমাদের এরূপ সভা বা বক্তৃতার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর হবে।’
অশ্বিনী কুমার দত্তের এই বক্তব্য মুকুন্দ দাস খুবই গুরুত্ব সহকারে নিলেন। মাত্র তিন মাসের মধ্যে রচনা করলেন অসাধারণ যাত্রাপালা ‘মাতৃপূজা’। ‘মাতৃপূজা’র মূল বিষয় ছিল দেশপ্রেম। দেশের সন্তানরা প্রয়োজনে জীবন দিয়ে ভারতমাতাকে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত করবে। পুলিন দাস, অশ্বিনী কুমার দত্ত, মুকুন্দ দাস দারুণ দেশপ্রেমের উন্মাদনা সৃষ্টি করলেন তরুণ সমাজের মধ্যে।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে জন্ম নেয় স্বদেশি আন্দোলন। যে আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষের সাথে একাত্বতা ঘোষণা করে ছাত্ররা। বিশেষ করে স্কুলের কিশোররা। আর এই দুই আন্দোলনের সমর্থনে সক্রিয় অহিংস সংগ্রাম যেমন পরিচালিত হয়, তেমনি সহিংস কর্মকাণ্ডভিত্তিক গোপন সংগঠনেরও জন্ম হতে থাকে।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী ও স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন ক্ষুদিরাম বসু। এ সময় ক্ষুদিরাম সত্যেন বসুর নেতৃত্বে গুপ্ত সংগঠনে যোগ দেন। এখানে তিনি শারীরিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক ও রাজনৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। এখানে পিস্তল চালনার শিক্ষাও হয়। এই গুপ্ত সংগঠনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে ক্ষুদিরাম ইংল্যান্ডে উৎপাদিত কাপড় জ্বালিয়ে দেন এবং ইংল্যান্ড থেকে আমদানীকৃত লবণবোঝাই নৌকা ডুবিয়ে দেন। এসব কর্মকাণ্ডে তার সততা, নিষ্ঠা, সাহসিকতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়। ফলে ধীরে ধীরে গুপ্ত সংগঠনের ভেতরে তার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
১৯০৬ সালের দিকে দেশপ্রেমের একটা ছোট বই ছাপা হয়, এগুলো বিক্রির জন্য তরুণদের উপর দায়িত্ব পড়লো। ক্ষুদিরাম তাদের মধ্যে অন্যতম। মেদিনীপুর মারাঠা কেল্লায় প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে ক্ষুদিরাম বই হাতে বলছেন, ‘আসুন পড়ুন। দেশের দুর্দশার খবর জানুন। অত্যাচারী রাজশক্তির নির্মমতার নজির- এই বই আপনাদের জন্য’।
এমন সময় একজন হাবিলদার এসে ক্ষুদিরামের হাত চেপে ধরল। শক্তি ও বয়সে তার চেয়ে অনেক বেশি। তবুও ক্ষুদিরামের কাছে- কুছ পরোয়া নেহি। হাবিলদারের মুখের মধ্যে এক ঘুষি মেরে দিলেন সমস্ত শক্তি দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে নাক ফেটে রক্ত বেরুলো। সত্যেন বসু ঠিক ওই সময় এসে হাজির হলেন। দেখলেন বিষয়টি। সান্ত্বনা দিলেন হাবিলদারকে। ক্ষুদিরাম মুহূর্তের মধ্যে হাওয়া। কয়েকদিন আত্মীয়ের বাড়িতে আত্মগোপন করে রইলেন। তাতে কি আর একজন দেশপ্রেমিক শান্তি পান? দেশ জোড়া বিপ্লবের ঢেউ। হাজার হাজার ছেলে মেয়ে জড়িয়ে আছে দেশমাতৃকার কাজে। পুলিশ ধরার ভয়ে আর কত দিন পালিয়ে থাকা যায়? মনস্থির করলেন পুলিশের কাছে ধরা দেবেন। তাই আলীগঞ্জের তাঁতশালায় চলে এসে ধরা দিলেন। পুলিশ মারা ও নিষিদ্ধ বই বিলির অপরাধে ক্ষুদিরামের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের মামলা করা হল। বাংলাসহ সারা ভারতবর্ষ এই প্রথম ক্ষুদিরামকে চিনলো। ১৩ এপ্রিল ক্ষুদিরাম মুক্তি পেলেন। খানিকটা শাস্তি পেলেন সত্যেন বসু। ক্ষুদিরাম এবার গুপ্ত সমিতির কাজে আরো উঠে পড়ে লাগলেন।
“ভারতের ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার মধ্য দিয়ে। বৃটিশদের শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার অদম্য মানসিকতা সেদিনের ছাত্র সমাজকে আপসহীন বিপ্লবী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বহু যুবক বিপ্লবী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বহু যুবক বিপ্লবী দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল এমনকি আমরা দেখেছি শিক্ষকদের প্রেরণাতেও বহু মেধাবী ছাত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। শিক্ষক-ছাত্রের এক অনুকরণীয় সম্পর্ক গড়ে দিয়েছিল সে সময়। ক্ষুদিরামেরা সেই অগ্নিগর্ভ সময়েরই সৃষ্টি। সে সময়ে তারুণ্যের প্রাবল্য আঘাত হানে অত্যাচারী শাসকের দুর্গে। ‘বোকা’ ক্ষুদিরামরাই নতুন পথ দেখান।” নির্মল সেন।
ক্ষুদিরাম বসু সম্পর্কে হেমচন্দ্র কানুনগো লিখেছেন, ক্ষুদিরামের সহজ প্রবৃত্তি ছিলো প্রাণনাশের সম্ভাবনাকে তুচ্ছ করে দুঃসাধ্য কাজ করবার। তার স্বভাবে নেশার মতো অত্যন্ত প্রবল ছিলো সৎসাহস। আর তার ছিলো অন্যায় অত্যাচারের তীব্র অনুভূতি। সেই অনুভূতির পরিণতি বক্তৃতায় ছিলো না, বৃথা আস্ফালনেও ছিলো না; অসহ্য দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-আপদ, এমনকি মৃত্যুকে বরণ করে, প্রতিকার অসম্ভব জেনেও শুধু সেই অনুভূতির জ্বালা নিবারণের জন্য, নিজ হাতে অন্যায়ের প্রতিবিধানের উদ্দেশ্যে প্রতিবিধানের চেষ্টা করবার ঐকান্তিক প্রবৃত্তি ও সৎসাহস ক্ষুদিরাম চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
অপারেশন কিংসফোর্ট
স্বাধীনতাকামী বিপ্লববাদী দলগুলোকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী মরিয়া হয়ে উঠে। তারা একের পর এক বিপ্লবীকে ধরে ধরে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা রুজু করে এবং তাদেরকে আন্দামান, আলীপুরসহ বিভিন্ন জেলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে পাঠানো শুরু করে। জেলে নেয়ার পর তাদের উপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন।
ব্রিটিশ বিচারক ছিলেন কিংসফোর্ট। এক নিষ্ঠুর বিচারক। ১৩ বছরের ছেলে সুশীল সেন পুলিশ সার্জেন্টকে ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দেয়ায় সুশীল সেনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়। কিংসফোর্ট বিচারক। বিচারে ১৫টি বেত্রাঘাত মারার হুকুম দিলেন তিনি। রক্তাক্ত হলেন সুশীল সেন। দুঃসহ যন্ত্রণায় কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। খবরটি দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়লো। সকল তরুণ বিপ্লবী এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে ইংরেজকে বিতাড়িত করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলেন। বিপ্লববাদী দলের সুবোধ মল্লিক, হেমচন্দ্র, চারুদত্ত, বারীন ঘোষ ও অরবিন্দ সিদ্বান্ত নিলেন কিংসফোর্টকে হত্যা করার। মিটিংয়ে প্রশ্ন উঠলো একাজের দায়িত্ব কাকে দেয়া হবে? প্রফুল্ল চাকী বলে উঠলেন, ‘আমি প্রস্তুত। বলুন কি করতে হবে আমাকে।’ কিন্তু সবাই ভাবলেন, একাজের জন্য আরো একজন দরকার। ভেবেচিন্তে ক্ষুদিরাম বসুর নাম ঠিক হলো।
ক্ষুদিরামের অভিভাবক সত্যেন বসুর কাছে চিঠি লিখে পাঠানো হলো। চিঠি অনুযায়ী ১৯০৮ সালের ২৫ এপ্রিল ক্ষুদিরাম কলকাতায় এসে পৌঁছালেন। গোপীমোহন দত্তের ১৫ নম্বর বাড়ি ছিলো বিপ্লবীদের তীর্থক্ষেত্র। এখানে বসেই হেমচন্দ্র ও উল্লাসকর শক্তিশালী ‘book bomb’ তৈরি করলেন। এ বোম বইয়ের ভাঁজে রাখা যেত। বেশ কৌশলে একটি বই কিংসফোর্টের কাছে পাঠানো হলো। কিন্তু কিংসফোর্ট বই না খোলার কারণে সে যাত্রায় বেঁচে গেলেন। শুরু হলো আবার নতুন প্রস্তুতি। প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম কলকাতা রেলস্টেশনে পৌঁছার পর বারীণ ঘোষ তাদের কাছে কিংসফোর্টকে মারার জন্য বোমা পৌঁছে দিলেন। বোমার সঙ্গে রিভলবার কেনার জন্য কিছু টাকা ও মজফফরপুরে যাওয়ার মানচিত্র দেয়া হলো তাদেরকে। প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম প্রথমে একত্রিত হলেন রেলস্টেশনে। এর আগে কেউ কাউকে চিনতেন না। কথা হলো। কিংসফোর্টকে হত্যা করার জন্য ইস্পাত দৃঢ় সংকল্প করলেন তারা। এরপর সতর্কতার সাথে চলে যান মজফফরপুরে। কারণ এখানেই বাস করেন কিংসফোর্ট। প্রতিদিন ক্লাব হাউজ থেকে সন্ধ্যার পর সাদা ফিটন গাড়িতে করে নিয়মিত বাড়ি ফিরে আসেন কিংসফোর্ট। পাঁচ দিন অতিবাহিত হলো, কিন্তু তাকে হত্যা করার উপযুক্ত সুযোগ পেলেন না। ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল, ষষ্ঠ দিন এলো সেই সুযোগ। ক্লাব হাউজ থেকে তার বাড়ি পর্যন্ত যে পথ, সেই পথের মাঝখানে ঝোপ-ঝাড়ে ঢাকা একটি জায়গায় ওঁত পেতে ছিলেন তারা। সন্ধ্যার পর সাদা ফিটন গাড়িটি তাদের কাছে পৌঁছামাত্র গাড়িটি লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু ওই গাড়িতে সেদিন কিংসফোর্ট ছিলেন না। ছিলেন অন্য দু’জন বিদেশী। বিদেশী দু’জন মারা গেলেন। অতিদ্রুত ওই স্থান ত্যাগ করলেন তারা। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না তাদের। কারণ কিছুদূর যাওয়ার পর পথে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী। প্রফুল্ল চাকী ধরা পড়ার সাথে সাথে নিজের মাথায় রিভলবারের গুলি ছুঁড়ে আত্মহত্যা করেন। আর ধরা পড়ে যান ক্ষুদিরাম।
ক্ষুদিরামের ফাঁসি
১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট, সময় তখন ভোর ৫টা। ক্ষুদিরামকে ফাঁসি দেওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন। যারা ফাঁসিতে ঝুলাবেন তারাও প্রস্তুত। লোহার গরাদ দেওয়া গেটটি তখনো বন্ধ। হঠাৎ গেটটি খুলে গেল। সেই গেট পেরিয়ে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে আসছেন একটি কিশোর, তিনি আর কেউ নন, ক্ষুদিরাম।
চারপাশে পুলিশ প্রহরায় কিশোর ক্ষুদিরাম এগিয়ে চলেছেন গেট থেকে একটু দূরেই ১৫ ফুট উঁচুতে তৈরি করা ফাঁসির মঞ্চের দিকে। দুই দিকে দুইটি খুঁটি আর একটি লোহার রড আড় দ্বারা যুক্ত, মাঝখানে বাঁধা মোটা এক গাছা দড়ি। এখানেই ঝুলানো হবে ক্ষুদিরামকে। শেষ হাসি দিয়ে মঞ্চে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন ক্ষুদিরাম। জল্লাদ মাথা থেকে গলা পর্যন্ত ঢেকে দিল সবুজ রঙের পাতলা টুপি দিয়ে। এখন অপেক্ষা কেবল মৃত্যুর। উপস্থিত এক প্রহরীর হাত ততক্ষণে বসে আছে কোনায় স্থাপন করা হ্যান্ডেলের ওপর। উডমেন সাহেব ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উড়িয়ে দিলেন তার হাতে থাকা সাদা রঙের একটি রুমাল। নিমেষের মধ্যে ক্ষুদিরাম হারিয়ে গেলেন কোনো এক অতল গহ্বরে। ভারতীয় দণ্ডবিধি আইনের ৩০২ ধারা মোতাবেক ক্ষুদিরামের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়।
মৃত্যুর শেষ সময় পর্যন্ত ক্ষুদিরামের মনোবল ছিল দৃঢ়। ফাঁসিতে ঝোলানোর আগে কারা কর্তৃপক্ষ তার কাছে শেষ ইচ্ছা জানতে চাইলে, ক্ষুদিরাম এক সেকেন্ড অপেক্ষা না করেই বলে উঠলেন, ‘আমি ভালো বোমা বানাতে পারি, মৃত্যুর আগে সারা ভারতবাসীকে সেটা শিখিয়ে দিয়ে যেতে চাই।’
উপস্থিত কারা কর্তৃপক্ষ সেদিন বিস্মিত হয়েছিল ক্ষুদিরামের মানসিক দৃঢ়তা আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতি তীব্র ঘৃণাবোধ উপলব্ধি করে। সেসময় ক্ষুদিরামের পক্ষের আইনজীবি ছিলেন শ্রী উপেন্দ্রনাথ সেন। তার ভাষ্যমতে: “ফাঁসির মঞ্চে ক্ষুদিরাম নির্ভীকভাবে উঠে যান। তার মধ্যে কোনো ভয় বা অনুশোচনা কাজ করছিল না। এদেশের নবীন যৌবনের প্রতীক হয়ে হাসিমুখে তিনি উঠে যান ফাঁসির মঞ্চে।”
১২ আগস্ট কলকাতার ‘দৈনিক অমৃতবাজার’ পত্রিকায় লেখা হয়: ‘মোজাফফরপুর, ১১ই আগষ্ট, অদ্য ভোর ছয় ঘটিকার সময় ক্ষুদিরামের ফাঁসি হইয়া গিয়াছে। ক্ষুদিরাম দৃঢ় পদক্ষেপে প্রফুল্লচিত্তে ফাঁসির মঞ্চের দিকে অগ্রসর হয়। এমনকি যখন তাহার মাথার উপর টুপিটা টানিয়া দেওয়া হইল, তখনো সে হাসিতেছিল।’
পীতাম্বর দাশের সেই গান
‘একবার বিদায় দে-মা ঘুরে আসি।
হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে জগৎবাসী।
কলের বোমা তৈরি করে
দাঁড়িয়ে ছিলেম রাস্তার ধারে মাগো,
বড়লাটকে মারতে গিয়ে
মারলাম আরেক ইংল্যান্ডবাসী।
শনিবার বেলা দশটার পরে
জজকোর্টেতে লোক না ধরে মাগো
হল অভিরামের দ্বীপ চালান মা ক্ষুদিরামের ফাঁসি
দশ মাস দশদিন পরে
জন্ম নেব মাসির ঘরে মাগো
তখন যদি না চিনতে পারিস দেখবি গলায় ফাঁসি’
এই গানের মধ্যে দেশমাতাকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য যার আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে এবং যার কথা উঠে এসেছে তিনি এ উপমহাদেশেরই সূর্যসন্তান, ক্ষুদিরাম। এই গানটি আজও বিভিন্ন গণ আন্দোলনে অনুপ্রেরণা যোগায়, উৎসাহিত করে দেশপ্রেমের অগ্নিমন্ত্রে শপথ নিতে।
বিপ্লবী ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগের প্রতিচ্ছবি চেতনার আয়নায় চিত্রায়ন করে, সেটি গান হিসেবে রচনা করেছিলেন বাঁকুড়ার লোককবি পীতাম্বর দাস। এই বিপ্লবীর আত্মত্যাগের উপাখ্যানকে কেন্দ্র করেই গানটি রচিত হয়েছে। বাউল শিল্পী ঝুমুরের বাউল সুরে গাওয়া গানটি সারা বাংলার জনগণের অন্তরে গেঁথে রয়েছে।
এই মহাবিপ্লবীর প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ সালাম ও বিপ্লবী অভিবাদন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)