বয়স প্রায় ৭৬! কিন্তু এই বয়সেও দাপট দেখিয়ে যাচ্ছেন ছোট ও বড় পর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী দিলারা জামান। ক’দিন আগে প্রচ্ছদকন্যা হয়েও দেশব্যাপী সাড়া ফেলেছেন তিনি। আর এই অভিনেত্রী এবার কাজ করতে চলেছেন একটি স্বপ্নের প্রজেক্টে! তার ভাষায়, মৃত্যুর আগে স্মরণে রাখার মতো একটি কাজ করতে চলেছি।
মুক্তিযুদ্ধের একটি বাস্তব কাহিনি নিয়ে মাসুম রেজার চিত্রনাট্যে নির্মিতব্য ‘ওমর ফারুকের মা’ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটিতে কাজ করতে চলেছেন দিলারা জামান। সরকারি অর্থায়নে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করছেন এম জাহিদুর রহমান বিপ্লব।
ইতিহাস থেকে নেয়া গল্পে একাত্তরে ২১ বছরের তরুণ ছিলেন ওমর ফারুক। ছিলেন পিরোজপুর সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি। যুদ্ধের সময় এক রাতে মাকে কথা দিয়ে গিয়েছিলেন, রাতে ফিরে মায়ের হাতে ভাত খাবেন। ওমর ফারুকের আর ফেরা হয়নি। সেই রাতে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। তার কাছে বাংলাদেশের সাতটি পতাকা পায় পাকিস্তানি সেনারা। হানাদার বাহিনীর হাতে মৃত্যু হয় ফারুকের। হাতুড়ি পেটা করে একটি পতাকা ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তার মাথায়। শহীদ ওমর ফারুকের লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় কীর্তনখোলার জলে।
এরপর ৪৬ বছর পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি ওমর ফারুকের মায়ের অপেক্ষা। মা আজও ছেলের অপেক্ষায় তিনবেলা হাড়িতে ভাত বসান, রাতে সদর দরজা খোলা রাখেন ছেলের অপেক্ষায়। ছেলে আসবে সেই বিশ্বাস এখনো পুষে রেখেছেন নব্বই উর্ধ্ব বয়সী ওমর ফারুকের মা। আর এই ঐতিহাসিক একটি চরিত্রেই অভিনয় করতে যাচ্ছেন দিলারা জামান।
আসছে ১৫ সেপ্টেম্বর ‘ওমর ফারুকের মা’ চলচ্চিত্রটির শুটিং। এরমধ্যে চরিত্রটি নিয়ে ডুবে আছেন তুখোড় এই অভিনেত্রী। বললেন, এমন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হইনি কখনো।
ওমর ফারুকের মায়ের চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তুতি নিয়ে জানতে চাইলে চ্যানেল আই অনলাইনকে দিলারা জামান বলেন, ওমর ফারুকের মায়ের চরিত্রটিতো আসলে চরিত্র না। এটা একটা বাস্তব ইতিহাস। জীবন্ত কিংবদন্তি ওমর ফারুকের মা। যিনি নব্বই-বিরানব্বই বছরের একজন মা। এখনো তার সন্তানের প্রতীক্ষায় আছে। এটা যেমন একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার, তেমনি অবিশ্বাস্য সত্যিও বলা যায়। এখনো তিনি দরোজাটা সব সময় খুলে রাখেন যে, তার ছেলে ফিরবে। ভাবা যায়!
ওমর ফারুকের মায়ের চরিত্রটির ডেপথ নিয়ে প্রবীন এই অভিনেত্রী আরো বলেন, ওমর ফারুকের বোনের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি তার মা’কে অন্যান্য সন্তানেরা কোথাও নিয়ে যেতে পারে না। কোথাও নিয়ে গেলেও সেখানে এখনো দরোজা খোলা রাখতে হয়। কারণ তার মা মনে করে, দরোজা বন্ধ করে ঘুমালে ওমর ফারুক যদি এসে ফিরে যায়! এখন বুঝেন, সন্তানের জন্য একজন মায়ের কি রকম কষ্ট! আমারতো চোখ ভিজে যায় এরকম গল্প শুনে। ওমর ফারুকের মায়ের রক্তের কণায় কণায় যে বিশ্বাস, ছেলে ফিরবে। এটা আমি জানি না কীভাবে ফুটিয়ে তুলবো।
চরিত্রটিকে গোটা অভিনয় জীবনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন জানিয়ে দিলারা আরো বলেন, আমি জানি না এমন তীক্ষ্ণ আর দৃঢ় একটি চরিত্র আমি কীভাবে ফুটিয়ে তুলবো! কঠিন একটি চরিত্রের চ্যালেঞ্জ এখন আমার সামনে। বিশ্বাসযোগ্য করে পর্দায় তুলতে পারি কিনা এটা একটা চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া ওমর ফারুকের মা এখনো জীবিত।
বয়স হয়ে যাওয়ায় এখন আর দূরে কোথাও শুটিংয়ে যান না দিলারা জামান। কিন্তু ‘ওমর ফারুকের মা’-এর মতো প্রজেক্টে কাজ করতে পিরোজপুর যাচ্ছেন তিনি। কেন যাচ্ছেন তার কারণ জানিয়ে এই অভিনেত্রী বলেন, আমার শরীরও খুব বেশি ভালো না। এখন আর আগের মতো দূরে কোথাও শুটিং হলে যেতে পারি না। কিন্তু ‘ওমর ফারুকের মা’ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি করতে পামি পিরোজপুর যেতে রাজি হয়েছি। কাজতো অনেক-ই করি, আমার মনে হয়েছে মৃত্যুর আগে একটা ভালো কাজ করে যেতে চাই। যে কাজগুলোর জন্য মানুষের মনে বেঁচে থাকা যাবে।
এদিকে ‘ওমর ফারুকের মা’ নির্মাণে হাত দেয়ার আগে তরুণ নির্মাতা এম এম জাহিদুর রহমান বিপ্লব শনিবার সকালে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্রটির শিল্পী ও কলাকুশলীসহ চলচ্চিত্র বোদ্ধা হাশেম সুফি ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুকের আপন ছোট বোন সালমা রহমান হ্যাপি।
সরকারি অনুদানে নির্মিতব্য ‘ওমর ফারুকের মা’ স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিতে মায়ের চরিত্রে অভিনয় করবেন দিলারা জামান এবং ওমর ফারুকের চরিত্রে সাঈদ বাবু। এ ছাড়া অন্যান্য চরিত্রে দেখা যাবে বন্যা মির্জা, শাহেদ শরীফ খান, খাইরুল আলম সবুজ, নাজনীন হাসান চুমকি, সালমা রহমান, আইনুন পুতুল, রিপন চৌধুরী, কাজী রাজু, সৈয়দ শুভ্র, মুকুল সিরাজ, এ বি এম মোতাহারুল ইসলাম, প্রণব ঘোষ, রোশেন শরিফ ও তুহিন আহমেদকে।
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে পিরোজপুরে শুটিং শুরু করছেন নির্মাতা এম এম জাহিদুর রহমান বিপ্লব। তবে সরকারি অনুদানের এই স্বল্প বাজেট নিয়ে কিছুটা বিড়ম্বনায় তিনি। সরকারি অর্থায়নের টাকা দেয়া হচ্ছে তিন কিস্তিতে। আর এ কারণে পরিকল্পনা মতো অনেক কিছুই হচ্ছে না জানিয়ে বিপ্লব বলেন, সব মিলিয়ে পরিকল্পিত বাজেট থেকে অনেক বেশি টাকা খরচ হয়ে যাবে। এত খরচের পরও ছবিটি দেখাতে হবে টেলিভিশনে। স্বল্পদৈর্ঘ্য হলেও সিনেমা কখনও নাটক বা টেলিফিল্ম নয়। ছোটপর্দার সাথে বড়পর্দার ফারাক বিস্তর বলে মনে করেন নির্মাতা বিপ্লব। তিনি বলেন, ফিল্মের এক্সপোজার/ প্রদর্শন বড় পর্দায় না হওয়াটা দুঃখজনক! স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমার প্রদর্শনী নিয়ে এই দিকে সরকার, সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা সংশ্লিষ্ট মহল বিশেষ নজর দিয়ে বিবেচনা করলে এই শিল্প মাধ্যম আরো সমৃদ্ধ হতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
‘ওমর ফারুকের মা’-এর মধ্য দিয়ে দর্শকের জন্য ভালো কিছু দেয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করে নির্মাতা বলেন, ফেস্টিফ্যাল বা অ্যাওয়ার্ডের কথা মাথায় নিয়ে আমি চলচ্চিত্র নির্মাণ করছি না। পুরস্কারের প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশপ্রেমের জায়গা থেকে ভালো কিছু করার জন্যই একান্ত চেষ্টা করছি।
চ্যালেঞ্জ অনেকখানি জেনেও মনোবল নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী নির্মাতা এম এম জাহিদুর রহমান বিপ্লব বিশ্বাস করেন যে, ‘ওমর ফারুকের মা’ নির্মাণের মধ্য দিয়ে একটি ভালো মানের চলচ্চিত্র দর্শকদের উপহার দিতে পারবেন।
ফিচার ছবি: আবু সুফিয়ান জুয়েল