ঈদ আরবি শব্দ। ‘আইন-ইয়া-দ্বাল’ এর সমষ্টিতে গঠিত। অর্থ একের পর এক, ধারাবাহিক, বার বার আসা। অর্থাৎ যে আনন্দ বার বার (প্রতি বছর) ফিরে আসে, সেটাই ঈদ।
সাধারণ অর্থে ঈদ মানে আনন্দ, উল্লাস, খুশি ইত্যাদি। আলোচ্য বিষয় কেবল ঈদুল ফিতর তথা রমজান পরবর্তী ঈদ। মুমিন ব্যক্তির এ ঈদের আনন্দ উদযাপন কেমন হওয়া উচিৎ, এ ব্যাপারে আলোচনার প্রয়াস পাচ্ছি।
ঘটনা-১
এক ঈদের দিন হযরত আবু হোরায়রা (রা.) ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ফারুক (রা.) এর ঘরে প্রবেশ করে দেখলেন যে, মুসলিম বিশ্বের রাজাধিরাজ সৈয়্যদেনা উমর ফারুক (রা.) কান্নাকাটি করছেন। হযরত আবু হোরায়রা (রা.) ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আমিরুল মু’মিনিন! আজ ঈদের দিন। লোকেরা আনন্দোল্লাসে মেতে আছে, অথচ আপনি ঘরে দরজা বন্ধ করে কান্নাকাটি করছেন, এর হেকমত কী?’ এবার উমর ফারুক (রা.) জবাব দিলেন, ‘আনন্দিত লোকেরা যদি জানতো, তবে এমনটা করতো না’। এটা বলতে বলতে তিনি পুনরায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এবং বলতে লাগলেন, “তাদের (রমজানের রোযা, নামায, ইবাদাত, রিয়াজত) যদি আল্লাহ তায়ালা কবুল করে থাকেন, তবে তাদের আনন্দ উদযাপনে দোষের কিছু নাই। কিন্তু এর বিপরীত হলে আনন্দ উদযাপন না করা উচিৎ। আমি তো নিশ্চিত না যে, আমার ইবাদত-রিয়াজত কবুল হয়েছে কিনা? (আর এজন্যেই আমি কাঁদছি)”।
ঘটনা-১
এক ঈদের দিনে হযরত আলী (রা.) শুকনো রুটি খাচ্ছিলেন। এমন সময় তাঁর খেদমতে এক আগন্তুক উপস্থিত হলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, আজ ঈদের দিন অথচ আপনি শুকনো রুটি খাচ্ছেন কেন? উত্তরে মাওলা আলি (রা.) বললেন, “আজ ঈদের দিন তাদের জন্য, যাদের রোযা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছে। যার পরিশ্রম সফল হয়েছে। যার গুনাহসমূহ ক্ষমা করা হয়েছে। আজকের দিন, আগামী দিন এবং প্রত্যেক দিন আমাদের জন্য ঈদ হবে, যখন আমরা আল্লাহর নাফরমানি করবো না” (গুনিয়াতুত ত্বালেবিন)।
ঈদ আনন্দ কেবল তাঁদের জন্য, যাঁরা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত দায়িত্ব তথা আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি হাসিল করেছে। হযরত আনাস (রা.) হতে হাদিসে পাকে বর্ণিত আছে, “যখন ঈদুল ফিতরের দিন উপস্থিত হয়, তখন আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের জিজ্ঞেস করেন, যারা স্বীয় দায়িত্ব স্বেচ্ছায় পালন করেছে, তাদের প্রতিদান কী হওয়া উচিত? ফেরেশতারা সুপারিশ করে বলেন, ‘তাদেরকে পূর্ণ প্রতিদান দেয়া উচিৎ’। তখন আল্লাহ বলতে থাকেন ‘যারা আমার বিধান পরিপূর্ণ পালন করেছে, এবং তাকবিরের সাথে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে, আমার ইজ্জত, জালালিয়্যত ও উচ্চ মর্যাদার শপথ! আমি অবশ্যই তাদের দোআ কবুল করব। হে লোকেরা! তোমরা ফিরে যাও। আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি। পাপকে নেকিতে পরিবর্তন করে দিয়েছি’। রাসুলে পাক ইরশাদ করেন, ঐ সব লোকেরা ঈদগাহ থেকে নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসবে” (মিশকাত)।
মুমিন ব্যক্তির ঈদের আগের রাতে রাত্রিযাপন করা উচিৎ। কেননা রাসুলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি পাঁচটি রাত জাগ্রত থেকে খোদা তায়ালার রিয়াজতে মশগুল থাকবে, তার জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে যাবে। যথা- ১, রজব মাসের প্রথম রাত। ২, আশুরার রাত। ৩, ঈদুল আযহার রাত। ৪, ঈদুল ফিতরের রাত। ৫, শা’বানের পঞ্চদশ রজনী তথা শবে বরাত” (তারগীব ওয়াত তারহীব)। বছরের যে পাঁচটি বিশেষ রাতের কথা হাদিসে পাকে বর্ণিত হয়েছে, তন্মধ্যে একটি হলো ঈদুল ফিতরের রাত। অথচ এ ব্যাপারে আমরা পরিপূর্ণ বেখবর। বেখবর শুধু এমনটা নয়, বরং অধিকাংশ লোকেদের এ রাত কাটে বিভিন্ন মার্কেটে। যে সময় খোদা তায়ালা বান্দার জন্য দয়ার ঝুড়ি প্রদর্শন করে ঠিক সে সময়েই অভাগা মুসলিমগণ মার্কেটে সস্তা পণ্য কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকে।
মুমিনরা ঈদের দিন পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে এক কাতারে আসতে হবে। বছরের পর বছর চলে আসা শত্রুতা এ দিন ভুলে গিয়ে পরস্পর পরস্পরের কাঁদে কাঁদ মিলিয়ে এক কাতারে আসাই ঈদের অন্যতম শিক্ষা। রাসুলে পাকের হাদিসে এসেছে- “এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই”। দুঃখজনক বিষয় এই যে, মুসলিম স¤প্রীতি বাড়ানোর এই মহোৎসবে আমরা আমাদের হিংসা বিদ্বেষ বিসর্জন দিতে পারি না। জামাতে এক কাতারে দাঁড়াই ঠিকই কিন্তু আন্তরিকতার কাতার ঠিকই উঁচু-নিচু বিভেদপূর্ণ থেকে যায়। তাই এই বৈশিষ্ট্য মুমিনের হতে পারে না। মুমিন ব্যক্তির এ আনন্দ হওয়া উচিৎ পরস্পরের কলহ দূর করার মাধ্যমে। নজরুল এ ব্যাপারেও অতি অনন্য বলেছেন-
“আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন হাত মেলাও হাতে
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্বনিখিল ইসলামে মুরিদ”
ইসলামের চির বিজয় আনতে যে সকল মহাবীরের পরস্পর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিলো, তাঁদের স্মরণপূর্বক তাঁদের সে শিক্ষা গ্রহণ করে জামাতে দাঁড়ানোই হবে মুমির ব্যক্তির ঈদ আয়োজন। ঠিক কাজী নজরুল যেমনটি লিখেছেন-
“আজ পড়বি ঈদের নামাযরে মন সেই সে ঈদগাহে
যে ময়দানে সব গাজী-মুসলিম হয়েছে শহিদ”
নজরুলের এ দুলাইনের ভাবার্থ হলো মুমিন-মুসলিম ভাই-ভাইয়ের এ সম্প্রীতির ময়দান কায়েম হয়েছে শহীদ-গাজীদের ত্যাগের মাধ্যমে। তাই ঈদ আনন্দ হওয়া চাই ত্যাগ ও স¤প্রীতির মাধ্যমে।
ঈদের দিনের করণীয় কিছু বিষয়, যা সুন্নাত হিসেবে সাব্যস্ত-
(১) প্রত্যুষে উঠে মিসওয়াক করা।
(২) উত্তমরূপে গোসল করা।
(৩) সুগন্ধি ব্যবহার করা।
(৪) চোখে সুরমা লাগানো।
(৫) পবিত্র ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড় পরিধান করা।
(৬) যত শিগ্রই সম্ভব ঈদগাহে যাওয়া।
(৭) সামার্থনুযায়ী উত্তম খাবারের ব্যবস্থা করে নিজে, পরিবার, দারিদ্র ও প্রতিবেশীদের খাওয়ানো।
(৮) ঈদগাহে যাবার পূর্বে মিষ্টি জাতীয় কিছু খাওয়া।
(৯) ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বেই সদকায়ে ফিতর আদায় করা।
(১০) পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া এবং দুটি ভিন্নপথ দিয়ে যাওয়া-আসা।
(১১) আবহাওয়া ঠিক থাকলে খোলা ময়দানে ঈদের জামাত করা।
(১২) ঈদগাহে যাবার পথে নিম্নস্বরে তাকবীরে তাশরিক পড়া। সর্বোপরি আল্লাহ এবং তাঁর প্রিয় রাসুলের সন্তুষ্টি আদায়ের মানসে যাবতীয় গর্হিত কাজ থেকে বেঁচে থেকে দিনাতিপাত করা।
ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। তবে ইসলাম এ খুশি উদযাপনের নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। তাই মুমিনরা যাচ্ছে-তাই করে ঈদ আনন্দ করতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা আমাদের মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত করে ইসলামী বিধি অনুযায়ী ঈদ আনন্দ উদযাপন করার তাওফিক দিন। আমিন! কাজী নজরুলের সেই চির পরিচিত লাইন দুটির মাধ্যমেই শেষ করা যাক-
“ও মন রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাগিদ…।”
(যদি শনিবার ঈদ হয় তাহলে নিচের অশংটুকো শুক্রবারেই যাবে। তখন শিরোনামহবে “মুমিনের ঈদ আনন্দ ও মাহে রমাদানের শিক্ষা)। ঈদ রবিবার হলে শনিবার যাবে।
মাহে রমাদানের শিক্ষা:
মহান আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের দরবারে লক্ষ-কোটি তথা অসংখ্য কৃতজ্ঞতা-শুকরিয়া যিনি আমাদেরকে শ্রেষ্ঠতম মাস পবিত্র মাহে রমাদান প্রদান করেছেন, আরো শুকরিয়া যিনি আমাদেরকে হাজার মাস থেকে উত্তম পবিত্র লাইলাতুল কদর দান করেছেন, আল-হামদুলিল্লাহ। একজন শিক্ষক ৫-৬বছর অন্তর অন্তর একবার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নতুন কিছু শিক্ষা নিয়ে থাকেন। একজন কর্মী বছরে ১-২বার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে তার সাংগঠনিক জীবনে নতুন জ্ঞানের জগত উন্মোচিত করে থাকেন। একজন শিক্ষক বা অধ্যাপক পিএইচ.ডি ডিগ্রী অর্জনের একটি বিষয়ে একটি পর্যায়ে পৌছার জন্য। একজন সাধক একটি নির্দিষ্ট সময় সাধনা করেন চমৎকারভাবে বাকী জীবন আরাধনায় কাটানোর জন্য।
শ্রেষ্ঠতম মাস মাহে রমাদান। আর এ মাস আমাদের কাছে নানা শিক্ষা নিয়ে হাজির হয়ে থাকেন। তবে পবিত্র কুরআনের ভাষা অনুযায়ী মোটাদাগে একটি শিক্ষা উল্লেখ করা যেতে পারে তা হলো ‘তাকওয়া অর্জন করা’ তথা খোদাভীতি, আত্মশুদ্ধি। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা খোদাভীতি অর্জন করতে পারো” (সূরা বাকারা- ১৮৩)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, “যে আত্মশুদ্ধি অর্জন করেছে, সেই সফলকাম” (সূরা আল আ’লা-১৪)। এছাড়াও মাহে রমাদানের অসংখ্য পরোক্ষ শিক্ষা রয়েছে।
যিনি তাকওয়াবান, তিনিই খোদা ভয়কারী, আত্মশুদ্ধি অর্জনকারী। একজন তাকওয়াবান কখনো সালাত পরিত্যাগ করতে পারে না, মিথ্যা বলতে পারে না, গিবত করতে পারে না, হারাম খেতে পারে না, বেয়াদবী হবে পারে না, পরের অধিকার বক্ষণ করতে পারে না, এতিমদের মাল গ্রহণ করতে পারে না, বেপর্দা চলা ফেরা করতে পারে না, পিতা-মাতাকে কষ্ট দিতে পারে না, যাকাত অস্বীকার করতে পারে না, ঘুষ গ্রহণ করতে পারে না, সুদ খেতে পারে না, অযথা সময় নষ্ট করতে পারে না, অপরের ক্ষতির চিন্তা করতে পারে না, ঝগড়া লাগাতে পারে না, মন্দ বাক্যালাপ করতে পারে না, সমাজ-দেশ জন্য অকল্যাণজনক এমন কাজ করতে পারে না। অর্থাৎ কুরআন-সুন্নাহ তথা ইসলাম পরিপন্থী কোনো কাজ করতে পারে না।
সম্মানিত পাঠক! আমরা যদি এ মাহে রমাদানে তাকওয়া অর্জন করতে পারি আর বাকি ১১মাস যদি এ তাকওয়ার চর্চা করতে পারি তাহলেই সফলকাম হতে পারবো। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে মাহে রমাদানের শিক্ষার আলোকে বাকি জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন, আমিন।