সকালে চোখ মেলার আগেই হাত চলে গেল বালিশের নিচে। হাতড়ে চলছি। খুঁজছি মোবাইল। ক’টা বাজে তা দেখতে তো হবে!
দেয়াল ঘড়ির ব্যাটারিটা বদল করা হয় নি সে তো প্রায় মাসখানেক হলো! ব্যাটারিও ফুলে হয়েছে ঢোল।
তড়াক করে উঠে বসি। ফোন নেই! নেই মানে নেই। লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে সারা ঘর খুঁজলাম তন্ন তন্ন করে। মাথা কাজ করছে না! কোথায় গেল ফোন? কোথায়?
১৫ মিনিট লেগে গেল স্থির হতে। ফোন হারিয়ে যাক আর মন! অফিসে যাওয়ার মাফ আছে কি? ঘরের জানালাগুলো চেক করলাম। কোনো গ্রিলকাটা চোরও আসে নি। এ কোন জ্বালা! তাহলে নিশ্চয়ই খোলা জানালা দিয়ে…
দিনের শুরুর প্রাকৃতিক কাজের আগে নোটিফিকেশন আর ফেসবুকের নিউজফিড ঘাঁটা হচ্ছে না আজ। সেটার জায়গাটা নিলো রোজ দরজার নিচ গলে ঘরে ঢোকা একাকি খবরের কাগজটা। নতুন বৌ এর মত এসে সেভাবেই পুরোনো কাগজের গাদায় ঢোকা অভ্যাস হয়ে গেছে তার। আজ বিপদে পড়ে আমার অভ্যাস যখন পরিবর্তন করতে হলো, খবরের কাগজও ভাঁজ খুলুক!
দু’চারটে হেডলাইন ছাড়া মন কাড়ে না কিছুই। মনে ঢুকে বসে আছে মোবাইল হারানোর চিন্তা।
দ্রুত রেডি হয়ে গিয়ে মনে হলো অফিসের গাড়ির ড্রাইভারকে বলেছিলাম, ‘ফোন করলে তারপর এসো’
কিভাবে ডাকবো ওকে! নাম্বারটাও যে ওই ফোনে!
নাস্তার পর্বটা আজ ডিলিট করেই রওনা দিলাম অফিসের উদ্দেশে।
হেঁটে রাস্তার মোড় পর্যন্ত যেতেই অসহায় লাগলো পাঠাও বা উবার ডাকারও উপায় নেই। ওই যে ফোনে…
অদূরে দাঁড়ানো সিএনজিওয়ালাকে দেখে মনে হলো লোকটা মনে মনে বলছে…” পেয়েছি *লাকে”
– ভাই, বারিধারা যাবেন?
– যামু না কেন্?
– ভাড়া কত?
– ৪০০ টাকা।
– ২০০ টাকায় যাবা?
– উভারে যান! (কুৎসিত হাসি)
কেন যানি মনে হলো লোকটা জানে আমার মোবাইল খোয়া গেছে আজ। কাকতাল হয়ত।
সিএনজিতে উঠে সময় কাটতে চাইছে না। অন্য সময় হলে হেডফোনটা কানে গুঁজে গান শুনে সময় পার করে দিতাম।
বিজয় সরনীর কাছে এসে জ্যামে। হঠাৎ চোখ পড়ল একটা ছোট বাচ্চার দিকে। ফুল বিক্রি করছে। গোলাপ।
কৈশোরে দেখা একটা টিভি নাটক মনে পড়ে গেল ‘প্রতিদিন একটি গোলাপ’
আর আমাদের জীবনে? এক গোলাপে হয়ত পার হয়ে যায় বছরের পর বছর।
মোবাইলে বাচ্চাটার একটা ছবি তুলতে চাইলাম। উপায় নেই। মনে পড়লো। অফিস থেকে ফেরার পথে একবার থানায় যেতে হবে।জিডি করা দরকার।
গোলাপটা হাতে নিয়ে হাতের মধ্যেই নাড়াচাড়া করতে করতেই মনে হলো, কত বছর পর গোলাপ হাতে নিলাম? রিমির জন্মদিনে শেষবার। একগুচ্ছ গোলাপ। লাল গোলাপ। রিমিরা চলে যায়। গোলাপরা প্রতিদিন জন্মায়।
অফিসের সামনে এসে সিএনজিটা থামলো।
-ভাই, কয়টা বাজে বলেন তো?
সিএনজি চালক পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখে বললো, ক্যান? ১২টা!
১২টা? বেজে গেছে বারোটা। আমার, ঘড়ির, কপালের…সবকিছুর।
অন্য সব দিনের মতো মোবাইলের অ্যালার্ম তোলে নি ঘুম থেকে। তাই বলে ১২ টা! কি বলবো বস্ কে???
কিছু কিছু সময় কিছু বলা লাগে না। শুনতে হয়।
বসের রুমের তাকে রাখা একটা ক্রেস্টের দিকে তাকিয়ে পুরো এক কাব্যগ্রন্থ ঝাড়ি শুনলাম।
শুধু মনে আছে…
– পরশ, তোমাকে ১০-১৫ বার কল দিলাম তোমায়।মোবাইল বন্ধ। কর টা কি????
বসের রুম থেকে বের হয়েই ড্রাইভার সেলিমের খপ্পরে।
-স্যার, আইজ ডাকলেন না তো।
কোনো জবাব না দিয়ে সোজা আমার ডেস্কে।
কি কি করতে হবে তার তালিকাও ফোনে। বাধ্য হয়ে ডেস্কটপে স্মৃতি থেকে টাইপ করে প্রিন্ট দিলাম। আজ কেন জানি মনে হচ্ছে, হার্ডকপির ওপর কোনো কপি নেই।
মন দিলাম কাজে। দেহঘড়ি কয়টা বাজে তা না জানাতে পারলেও ক্ষুধার জানান টা ভালোই দিতে পারে।
অন্যদিন হলে অনলাইনে ফুডপান্ডা বা হাঙ্গরি নাকিতেই অর্ডার দিতাম। ফোন না থাকায় ডেস্কটপে এসব ঝামেলা করতে মন চাইলো না।
নিজেই বের হয়ে গেলাম বাইরে।
অফিসের পাশে যে এত গোছানো বাংলা খাবারের রেস্টুরেন্ট আছে তা নজরেই আসে নি এতোদিন!
ধোঁয়া ওঠা ভাতের সাথে মুরগির ভুনা আর ভর্তা-ভাজি।আহা।
যাক! মোবাইল না থাকার একটা ভালো দিক তো পাওয়া গেলো! অফিসে ফিরে কাজে মন দিলাম।
হঠাৎ পকেটে ভাইব্রেশন টের পেলাম।পকেটে হাত দিয়ে দেখি ওয়ালেট ছাড়া কিচ্ছু নেই। তাহলে?
অভ্যাস। এতদিনের অভ্যাস।
ডেস্কটপে ফেসবুক লগইন করতে গিয়ে হুঁশ হলো। অফিসে ফেসবুক ব্লক করা। কি আজব কারবার। এতদিন তো মোবাইল দিয়েই ফেসবুক চালাতাম।
বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেড়ো!কলিগের মোবাইল নিয়ে ফোন দিলাম জয়ীকে। মোবাইল হারানোয় কোথায় সমবেদনা পাবো…পেলাম বেদনা।
– মোবাইল হারাইসে?নাটক? নতুন কোন সিম ভরসো বলো।তুমি জীবনেও আমাকে আর ফোন দিবা না।
লাইনটা কেটে যায় ওপার থেকে।
কেটে যায় দিনের ছন্দটাও।
গাড়ি নিয়ে বাসায় ফেরার পথে থানায় যেতে মন চায় না। মন চায় না বাসায় ফিরতেও। নেমে যাই হাতির ঝিলে। যন্ত্রবিহীন এক গোধুলীতে সূর্যটাকে ডুবতে দেখি। প্রাণ আছে। প্রাণ। একমুঠো মুঠোফোনবিহীন প্রাণ।
ঠোঙ্গাভর্তি ঝালমুড়ি শেষ। টাকা দিতে গিয়ে দেখলাম ওয়ালেটের দশা। দশ টাকাই ছিল।
ওহ্ হো। কাল রাতেই ভাবছিলাম বিকাশ থেকে টাকা তুলতে হবে! আশেপাশে ব্র্যাকের এটিএমও নেই।
হাঁটতে হাঁটতেই বাসায় ফেরা।
পথেই নামলো ঝুম বৃষ্টি। ভিজলাম। কাকভেজা। আজ আর টেনশন হলো না। মোবাইল ভেজার ভয় তো নেই! বাসায় ফিরে আরেক দফা খুঁজলাম সাধের মোবাইল। পাওয়ার কোনো কারণ আছে কি?
বাসায় ফিরে কি যেন না ছুঁতে কিংবা ধরতে পারার অপূর্ণতা। বুঝতে দেরি হলো না।
রুমমেট ফিরতেই চাইলাম ধার। কিনতেই হবে আরেকটা মোবাইল। তুলতেই হবে সিম।
প্রেয়সীর জন্য, বসের জন্য, বিকাশের জন্য, পাঠাওয়ের জন্য আর কিছু হোক না হোক আর সবার মতো ‘স্বাভাবিক’ জীবনে ফেরত আসার জন্য।
রোদে পোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা গোলাপটি বুক পকেটে বসেই এক ফোঁটা অশ্রু ঝরালো কি? নাহ্। ওসব কিছু না। মোবাইলের ভাইব্রেশনের মতো ভ্রম হবে কোনো…