চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

মুক্তিযুদ্ধে বন্ধুরাষ্ট্রের ভূমিকা

জনযুদ্ধে পরিণত হওয়া মুক্তি সংগ্রামে বাঙালিদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছিল অনেক রাষ্ট্র। এদের মধ্যে কোন কোন রাষ্ট্র শুধু বন্ধুত্বের হাতই বাড়াইনি, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছিল বাঙালির মুক্তিকে ত্বরান্বিত করতে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এহসানুল হক চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ভারতসহ অন্যান্য বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর যে ভূমিকা ছিল তা সত্যিই অনস্বীকার্য। তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা ছাড়া আমাদের বিজয় অর্জন কঠিন হয়ে যেত।

প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ভারত
বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের দেশে আশ্রয় দেয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া, মুক্তিযুদ্ধে সেনা সহায়তা দেয়াসহ সব ধরনের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহায়তা দিয়েছিল ভারতের ইন্দিরা গান্ধি সরকার।

মুক্তিযুদ্ধের সময় শরনার্থী শিবির পরিদর্শনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী

মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের শেষদিক পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যক্তিত্বকে আশ্রয় দেয়। কলকাতায় একটি প্রবাসী সরকার গঠনের ব্যবস্থা করে। মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়ার জন্য ভারত কূটনীতিক প্রচারণাও অব্যাহত রাখে।

মে মাসের শুরু থেকে জুনের শেষ পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করে। জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশের সমস্যার প্রত্যাশিত সমাধানের জন্য কূটনীতিক ও সামরিক প্রচেষ্টা জোরদার করে। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি দল বাংলাদেশে মোতায়েন করা হয়। ভারতের পাঠানো তিনটি সৈন্যবহরের দুটি ছিল সপ্তম পদাতিক এবং অপরটি ছিল নবম পদাতিক; যাদের ভারত পূর্ববাংলার সীমান্ত এলাকায় মোতায়েন করে। ভারতের সামরিক বাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করতে সক্ষম হয়।

চূড়ান্ত বিজয়ের আগে ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। ভারতের এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে আরো বড় ভূমিকা রেখেছিল। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে লেখা ইন্দিরা গান্ধীর চিঠি স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষের দিনগুলোয় মুজিবনগর সরকারকে তাৎপর্যপূর্ণ প্রেরণা যুগিয়েছিল।

বড় মিত্র হিসেবে এগিয়ে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের অন্যতম মিত্রশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় রাশিয়া (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন)। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়া সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করে। বাংলাদেশের পক্ষে রাশিয়া ছিল বলেই পাকিস্তানের পক্ষে বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌ-বহর পাঠানোর সাহস পায়নি যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধের পর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাইন ও ধ্বংসাবশেষ অপসারণে রাশিয়ার সামরিক বিশেষজ্ঞরা ব্যাপক  অবদান রাখে। এতে অনেক রাশিয়ানকে জীবনও দিতে হয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদে। বাংলাদেশের বিজয় অনিবার্য দেখে পাকিস্তানের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব তুললে রাশিয়া সেই প্রস্তাবে ভেটো দেয়।

অধ্যাপক এহসানুল হকের মতে, তখন রাশিয়া যদি ভেটো না দিতো, তাহলে হয়তো আমাদের বিজয় অর্জনের ব্যাপারটি বিলম্বিত হওয়া ছাড়াও নেতিবাচক কিছু ঘটার আশঙ্কা ছিল।

কেবল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধেই নয়, বাংলাদেশের পুনর্বাসন কাজেও সোভিয়েত ইউনিয়ন পাশে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আট দিনের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৭১-এর ৩ এপ্রিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি একটি চিঠি লিখেছিলেন। সে চিঠিতে শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারের খবরে উদ্বেগ, শক্তি ব্যবহার না করে রাজনৈতিক পথেই সংকট মোকাবেলার পরামর্শ ও মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার কথা ছিলো।

ইয়াহিয়ার কাছে পদগোর্নির চিঠি বাংলাদেশের পক্ষে সরাসরি সমর্থনের এক অনন্য নজির হিসেবে আখ্যায়িত করেন বিশেষজ্ঞরা।

বহুমাত্রিক সহায়তা দেয় যুক্তরাজ্য
প্রত্যক্ষভাবে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে ভুমিকা না রাখলেও বহুমাত্রিক সহযোগিতার মাধ্যমে যুক্তরাজ্য মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বন্ধুর ভূমিকা পালন করে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যরা জোরালোভাবে বাঙালির স্বাধীনতার লড়াইকে সমর্থন জানান। শরণার্থীদের জন্য অর্থ ও ত্রাণসহায়তা দেয়। একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাক্রম সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে জানাতে যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রবাসী বাঙালিদের বড় একটি অংশ যুক্তরাজ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে।

ব্রিটিশ সরকার মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থী শিবিরে দুর্গত বাঙালিদের ত্রাণ দিয়ে সহায়তা করেছিল। ১৯৭১ সালের ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত শরণার্থীদের জন্য ব্রিটিশ সরকারের সহায়তার পরিমাণ ছিল এক কোটি ৪৭ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড। এ ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানেও ব্রিটিশ সরকার দুই মিলিয়ন পাউন্ড অর্থের ত্রাণ সহযোগিতা পাঠিয়েছিল।

ব্রিটিশ সরকার ছাড়াও বেসরকারিভাবে ব্রিটিশ জনগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল ছিল।

ব্রিটিশ জনগণ পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর আক্রমণ ও নিষ্ঠুরতার নিন্দা জানিয়েছিল; রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। বাংলাদেশে নির্যাতন বন্ধে লর্ড সভার সদস্য লর্ড ফ্রেনার জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। পূর্ব বাংলায় গণহত্যা প্রসঙ্গে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের লেবার পার্টির সদস্য ডগলাস মান বক্তব্য দিয়েছিলেন। তিনি পূর্ব বাংলায় দ্রুত হত্যা ও নির্যাতন বন্ধ করার জন্য আহ্বান জানান। বাঙালিদের হত্যা ও নির্যাতন করায় পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করারও দাবি জানান তিনি।

অধ্যাপক এহসানুল হক

এ ছাড়া ১৯৭১ সালের জুন মাসে ব্রিটিশ লেবার পার্টির ১২০ জন এমপি বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে দাবি জানান। ২৫ জুন ব্রিটেনের কনওয়ে হলে লেডি গিফর্ডের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি জনসভায় ‘ইন্টারন্যাশনাল ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার বিচার করার জন্য সিকিউরিটি কাউন্সিলকে একটি আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করার দাবি জানায়।

ব্রিটেনে ‘অপারেশন ওমেগা’ নামে আরেকটি সংগঠন বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানিদের গণহত্যা ও ভারতের মাটিতে বাঙালি শরণার্থীদের দুর্দশার কথা প্রচার করে। অপারেশন ওমেগা বাংলাদেশে প্রবেশ করে মানবিক সাহায্যকাজ পরিচালনার চেষ্টাও চালিয়েছিল।

ছোট দেশ ভুটানের বড় অবদান
একটি ছোট দেশ হলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশি দেশ ভুটানের ছিল বড় অবদান। ভারতের পরপরই স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ভুটান। যা বাংলাদেশকে বিজয় অর্জনের পথে অনুপ্রেরণা যোগায়।

ভারত আগে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিলো নাকি ভুটান এ বিষয়ে অধ্যাপক এহসানুল হক বলেন, স্বীকৃতিদান একটি অনেক বড় বিষয়। ভুটানের পক্ষে এত বড় ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই ভারত স্বীকৃতি দেওয়ার পরপরই ভুটানও স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে।

সরকার ছাড়া ভুটানের জনগণও বাংলাদেশের প্রতি তাদের নৈতিক সমর্থন জানায়। ১৯৭১ সালে একজন সমাজকর্মী হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন জানানোর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন উগিয়েন তেসারিং। তিনি ছাড়াও ভুটানের আরও বেশ কিছু সমাজকর্মী এবং সংবাদ মাধ্যম নৈতিকভাবে বাংলাদেশকে সমর্থন জানিয়েছিল।

মুসলিম বিশ্বের অসহযোগিতার মধ্যে পাশে দাঁড়ায় মিশর ও ইরাক
মুসলিম এবং আরব রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের পাশে না দাঁড়ালেও দুই আরব রাষ্ট্র মিসর ও ইরাক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করে। আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইরাকই বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দেয়। স্বীকৃতিদানকারী প্রথম দিকের রাষ্ট্রগুলোর একটি মিসর।

সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে কায়রোর আধাসরকারি সংবাদপত্র আল আহরামে সম্পাদক ড. ক্লোভিস মাসুদ ভারত থেকে শরণার্থীদের নিরাপদ এবং নিঃশঙ্কভাবে দেশে ফেরার একটি ব্যবস্থা করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তাগিদ দেন। এর পাশাপাশি একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানের কথাও বলেন।

সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো ছিল বাংলাদেশের পাশে
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন করেপাশে থেকেছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোসহ আরও কিছু রাষ্ট্র। কিউবা, যুগোস্লাভিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, পূর্ব জার্মানিসহ অনেক দেশ বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন এবং যুদ্ধকে সমর্থন করে।