একাত্তরে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ সারা পৃথিবীর সভ্য মানুষদের নাড়া দিয়েছিল; বিশেষতঃ বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে পাকিস্তানিদের পরিচালিত গণহত্যা। সারা পৃথিবীর বিবেকবান মানুষরা তাদের অবস্থান হতে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। আজ তেমনই একজন বিবেকবানের কথা বলবো; বাঙালির জন্মবন্ধু জার্মান বংশোদ্ভূত উল্লি বেইয়ার। তার কথা বলতে গেলে একটি দেশের কথাও বলতে হবে- দেশটির নাম পাপুয়া নিউগিনি।
পাপুয়া নিউগিনি নামে একটি দেশ আছে, এই কথা হয়তো আমরা অনেকেই জানি না। দেশটি অবস্থিত ওশেনিয়ায় মানে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে, রাজধানী পোর্ট মর্সবি। দেশটার একদিকে ইন্দোনেশিয়া, অন্যদিকে সলোমন দ্বীপপুঞ্জ। দেশটির মোটামুটি পরিচিতি দিলাম।
এবার আসুন বলছি, কেন এই দেশটি প্রসঙ্গ অবতারণা করলাম। একাত্তরে বাঙালিদের উপর পাকিস্তান বাহিনীর বর্বরতা সারা বিশ্ববাসীকেই হতবাক করে দিয়েছিল। কি করে মানুষ এতটা বর্বর হতে পারে! এই সময় সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষরা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় পাপুয়া নিউগিনি হতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন জানাতে ও পাকিস্তান দ্বারা বাঙালি গণহত্যার প্রতিবাদে ‘To Each My Blood & Other Hymns’ নামে বাঙালি কবিদের একটি কবিতা সংকলন পাপুয়ান পকেট বুক সিরিজের ২৬ নং বই হিসেবে প্রকাশিত হয়। সংকলনে ছিল ১৫ জন বাঙালি কবির ১৬ টি কবিতা এবং সবগুলোই ইংরেজীতে অনুবাদ করা হয়েছিল। সংকলনের শুরুতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ ও কবি নজরুলের ‘ কান্ডারী হুশিয়ারের’ ইংরেজী অনুবাদ অনুবাদ সংযোজন করা হয়েছিল। সংকলনটি ৫২’র ভাষা শহীদ ও ৭১’ র মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসর্গ করা হয়।
যাদের কবিতা সংকলিত হয়েছিলঃ
১. পল্লীকবি জসিমউদ্দিন। ২. সনৎ বন্দোপাধ্যায়। ৩. কবি আহসান হাবিব। (দু’টি কবিতা) ৪. কবি শামসুর রাহমান। ৫. হাসান হাফিজুর রহমান। ৬. আনিসুজ্জামান। ৭. রাম বসু। ৮. সিদ্বেশ্বর সেন। ৯. কায়সুল হক। ১০. সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ১১. আবদুল গণি হাজারী। ১২. আসাদ চৌধুরী। ১৩. তুষার মৌলিক। ১৪. আলাওল জয়। ১৫. আল মাহমুদ।
সংকলনটি সম্পাদনা করেছিলেন জার্মান বংশোদ্ভূত উল্লি বেইয়ার ও পৃথ্বিন্দ্র চক্রবর্তী। পৃথ্বিন্দ্র চক্রবর্তী, নাম শুনেই বুঝা যায় বাঙালি, থাকতেন পোর্ট মর্সবিতে, পাপুয়া নিউগিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত ছিলেন, কবিতা লিখতেন।
উল্লি বেইয়ার একজন জার্মান বংশোদ্ভূত ধ্বনিতত্ত্ববিদ, সাহিত্য সম্পাদক ও লেখক। তাঁর জীবন ছিল বড় বর্ণাঢ্য। জন্মেছিলেন বর্তমান পোল্যান্ডে একটি জার্মান-ইহুদি পরিবারে ১৯২২ সালে, পুরো নাম হর্স্ট উলরিখ বেইয়ার। ত্রিশের দশকে জার্মানীতে হিটলারের নাজী পার্টির কারণে ইহুদি বিদ্বেষ ব্যাপক আকার ধারণ করলে উল্লির পরিবার ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত প্যালেস্টাইনে চলে যান। পরে উল্লি বেইয়ার ধ্বনিতত্ত্বের উপর পড়াশুনো করতে লন্ডনে যান। ১৯৫০ সালে নাইজেরিয়ার ইবাদান বিশ্ববিদ্যালয়ে ধ্বনিতত্ত্বের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৬ সালে নাইজেরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে তিনি পাপুয়া নিউগিনিতে চলে যান; সেখানে পাপুয়া নিউগিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাপুয়ান সাহিত্যিকদের পাপুয়ান সাহিত্য উন্নয়নে কাজ করেন। পাপুয়ান সাহিত্য উন্নয়নে উল্লি বেইয়ারের অবদান অনস্বীকার্য।
পাপুয়া নিউগিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথ্বিন্দ্র চক্রবর্তীর সাথে উল্লির পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। আর্ন্তজাতিক সংবাদমাধ্যম ও পৃথ্বিন্দ্রের কাছ হতে বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম ও পাকিস্তানিদের বর্বরতা কথা বিস্তারিত জানতে পারেন। হিটলারের জার্মানীর হাতে নির্যাতিত পরিবারের সন্তান উল্লি বাঙালির প্রতি সহমর্মী ছিলেন; কারণ, বাঙালির বিরুদ্ধে পাকিস্তানিদের সহিংসতা ছিল জাতিগত বিদ্বেষের চুড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। পাকিস্তানিদের দ্বারা সংঘটিত বাঙালি গণহত্যা তাঁকে ব্যাথিত করে। উল্লি ভাবতে থাকেন যে, মানবতার চরম বিপর্যয়ের এই মুহুর্তে কিছু একটি করা দরকার। ফলশ্রুতিতে, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ও পাকিস্তানিদের সংঘটিত বাঙালি গণহত্যার প্রতিবাদে উল্লি ও পৃথ্বিন্দ্র মিলে প্রকাশ করেন ১৬ টি বাংলা কবিতার ইংরেজী অনুবাদের সংকলন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ও বাঙালি গণহত্যার বিরুদ্ধে পাপুয়ান এবং বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে উল্লি বেইয়ার ও পৃথ্বিন্দ্র চক্রবর্তীর সংকলনটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
আশির দশকে উল্লি জার্মানির বেইরিউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আর্ট সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ২০১১ সালের ০৩ এপ্রিল ৮৮ বছর বয়সে বাঙালির জন্মবন্ধু উল্লি বেইয়ারের জীবনাবসান হয়।
ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় উল্লি বেইয়ার ও পৃথ্বিন্দ্র চক্রবর্তীকে স্মরণ করছি।
কবি আলাওল জয়ের সংকলিত কবিতার শেষ লাইন দিয়ে লেখাটি শেষ করছিঃ “Jai Bangla for each drop of blood”…
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)