সুলতানী আমল থেকে শুরু করে প্রায় ছয়’শ বছরের পরাধীন বাঙালি জাতি ভিনদেশীদের হাতে শাসিত, শোষিত, নিষ্পেষিত হতে হতে নিজের অর্থ, বল, সংস্কৃতি সব কিছুরই অনেকখানি হারিয়েছিল। বৃটিশ রাজ চলে যাওয়ার সময় ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করে দিয়ে গেলে অমুসলমান এবং প্রগতিশীল বাঙালি তাতে একমত না হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান তা আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করে। বাঙালি মুসলমান ভেবেছিল এবার তারা স্বাধীন হয়েছে। নিজেদের মত করে নিজের রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারবে। বাস্তবে তা হয়নি। পাকিস্তান গঠনের পর রাষ্ট্র ক্ষমতা চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর হাতে। পূর্ব পাকিস্তান আগের মতই উপনিবেশ থেকে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসককেরা পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক শোষণ চালাতে থাকে। গণতন্ত্র অধরা থেকে যায়, সামরিকতন্ত্র চালায় রাষ্ট্র ক্ষমতা; পূর্ব পাকিস্তানে উৎপাদিত পণ্যের রপ্তানী আয় জমা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে; কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয়ে যায়; নিষিদ্ধ করা হয় রবীন্দ্র চর্চা; এমনকি উর্দু হরফে বাংলা লেখার কথাও বলা হয়।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে পূর্ববঙ্গে শিক্ষার প্রসার শুরু হয়। বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশক থেকে পূর্ববঙ্গে বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক জাগরণ শুরু হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের পর থেকে সারা পৃথিবীতে কমিউনিজমের প্রভাব পড়তে শুরু করলে এখানেও তার ঢেউ লাগে। ত্রিশের দশক থেকে শুরু হওয়া বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক জাগরণের সঙ্গে কমিউনিস্টদের নিয়ে আসা আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং সাম্যবাদী চিন্তাধারা যোগ হয়ে এখানকার মানুষের সামাজিক চেতনার জগতে একটা বড়সড় পরিবর্তন আসে। দিনে দিনে সে চেতনা শক্তিশালী হতে থাকে। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা বৃটিশদের হাতে তৈরী কলেজগুলো এই চেতনা চর্চার সূতিকাগার হিসেবে কাজ করতে থাকে। এই সময়ে পাকিস্তানীদের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির আড়ালে চালিয়ে যাওয়া রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক শোষণের সঙ্গে দ্বন্দ্ব হয় শিক্ষিত মানুষের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, জাতীয়তাবাদী এবং সাম্যবাদী চেতনার। মুসলিম লীগ থেকে বেড়িয়ে এসে সৃষ্টি হয় জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগের।
প্রথম প্রতিরোধ হয় মাতৃভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। ’৫২ বুঝিয়ে দেয় পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ। পাকিস্তানের মোহ ভাঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের। ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলনের মাধ্যমে শিক্ষিত বাঙালির চেতনা স্ফুলিঙ্গের মত ছড়িয়ে পরে দেশের আনাচে-কানাচে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তৈরী হতে থাকে স্বাধীনতার প্রস্তুতি পর্ব। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা,‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান হয়ে একাত্তরের জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা। ’৩০, ’৪০, ’৫০ এবং ’৬০-র দশকের বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক চর্চা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি সমাজকে এতটাই শক্তিশালী করে তোলে যে তারা কয়েক’শ বছরের পরাধীন একটা জাতিকে সুশিক্ষিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মাত্র নয় মাসে স্বাধীন করে ফেলে। এত অল্প সময়ে স্বাধীনতা অর্জন পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। এই বিরাট কাজ সম্ভব হয়েছিল সে সময়ের মানুষের প্রাণে ধারণ করা গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ আর সমাজতন্ত্র মিলেমিশে যে চেতনার উদ্ভব হয়েছিল তার জন্য। যাকে আমরা এক কথায় বলি “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা”। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের এই মন্ত্রকে ধারণা করা হয়েছে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে।
বাংলাদেশ সৃষ্টির সঙ্গী ছিল প্রতিবেশী ভারত এবং তৎকালীন পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন। সদ্য স্বাধীন দেশটিতে ছিল খাদ্য ঘাটতি। উদ্বৃত্ত খাদ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী আমেরিকার কাছে। খাদ্যের প্রয়োজনে, মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ অবকাঠামো পুনঃনির্মানে সহায়তার প্রয়োজন ছিল আমেরিকার। এসব প্রয়োজন থেকেই বঙ্গবন্ধু আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তান, সৌদি আর আমেরিকার ছিল ভিন্ন চিন্তা। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ব্যর্থ করে দিয়ে আবারো তারা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের উপনিবেশ বানানোর পাঁয়তারা করছিল। সে চিন্তা থেকে চুয়াত্তরে বাংলাদেশের টাকায় কেনা খাদ্য ভর্তি জাহাজ বাংলাদেশে না পাঠিয়ে সৃষ্টি করা হয় কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ। আমেরিকার সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে না বুঝে বঙ্গবন্ধু ১৮০ ডিগ্রী টার্ন নেন তাঁর রাজনৈতিক কৌশলে। বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক লীগ গঠন করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে চালু করেন সোভিয়েত ইউনিয়নের মত একদলীয় শাসন। এই টার্নিং তাঁর জীবনাবসানের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমেরিকার কূটকৌশলে হত্যা করা হয় বাংলাদেশর স্থপতিকে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যথার্থ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া থেমে যায় স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা এবং জাতীয় চার নেতাকে জেলখানায় হত্যার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা চলে যায় স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের হাতে। তারা সামরিক ফরমান জারী করে সংবিধান থেকে বাদ দেয় সাম্যবাদ; যুক্ত করে রাষ্ট্রধর্ম; সমাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়ে টানা ২১ বছর ধরে স্বনামে, বেনামে চলে সামরিক শাসন। আমেরিকার চক্রান্তে তথাকথিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচনের নামে রাষ্ট্র শাসনভার তুলে দেয়া হয় স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের হাতে। যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে তুলে দেয়া হয় ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত আর ৪ লক্ষ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া জাতীয় পতাকা। নতুন করে এরা ব্যাপকভাবে চাষাবাদ করে ধর্মান্ধতার। এদের শক্তি যোগায় পরাজিত পাকিস্তান, তাদের দোসর সৌদি আরব এবং পরাশক্তি ইউরোপ, আমেরিকা। ধীরে ধীরে নির্বাসনে যেতে থাকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। শক্তিশালী হয়ে ওঠে সাম্প্রদায়িকতা। বর্বর নির্যাতন করে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয় বিপুল সংখ্যক সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে।
মুক্তিযুদ্ধে শুধু বাঙালিরাই নয়, স্বতঃস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিল সকল ক্ষুদ্র ণৃ-গোষ্ঠী। সঙ্গত কারণেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্থলে সংবিধানে যুক্ত হল বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ আজ দুইভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি এই জাতীয়তাবাদকে আবহমানকাল থেকে চলে আসা বাঙালি জাতিসত্তার পাশাপাশি ক্ষুদ্র ণৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক স্বকীয়তাকে অক্ষুণ্য রেখে নাগরিকত্ব অর্থে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে বুঝে থাকে। অন্যদিকে স্বাধীনতা বিরোধী এবং ইসলামী মৌলবাদীরা ইসলামিক সংস্কৃতি প্রভাবিত পাকিস্তানী ভাবধারায় লালিত এক নতুন জাতিসত্তা হিসেবে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে ব্যাখ্যা করে থাকে। বর্তমান বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের দ্বন্দ্ব প্রবল। যতদিন এই দ্বন্দ্বের অবসান না হয় ততদিন বাংলাদেশের প্রগতি পদে পদে বাঁধাগ্রস্থ হতে থাকবে।
বিগত শতাব্দীর ৭৫ সাল থেকে ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি বাংলাদেশে প্রকৃত অর্থে আর পাওয়া যায়নি। দীর্ঘ সামরিক শাসনে এবং সামরিক শাসকদের ক্ষমতালোভী চরিত্রের কারণে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, দুর্নীতি বাংলাদেশে শিকড় গেঁথেছে। এই শিকড় সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এতটাই বিস্তৃত হয়েছে যে তা সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে গণতান্ত্রিক ভাবধারাকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। গণতন্ত্র কোথাও ঠিকমত পাওয়া যায় না। গণতন্ত্র নেই বাসের টিকেটের লাইনে, ব্যাংকের লাইনে; সামাজিক সংগঠনে; রাজনৈতিক দলে; নির্বাচনে। জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ এখন মনে করে, গণতন্ত্র যদি স্বাধীনতা বিরোধী, যুদ্ধাপরাধী চক্রকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনে তবে সে গণতন্ত্র চাই না। একাত্তরের ঘাতক-দালালদের চিরতরে নির্মূলের আগে দেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের যথাযথ শাস্তি প্রদান সম্পন্ন করে এবং একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলো থেকে দুর্বৃত্তদের বহিষ্কার করে তৃণমূল থেকে গণতন্ত্রের চর্চা শুরু করে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে মুক্তিযোদ্ধাদের কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র।
স্বাধীনতা বিরোধীদের রাজনীতিতে পুর্বাসনের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন করে শুরু হয়েছে মৌলবাদী এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। এখানে তারা রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত সম্প্রতি জানিয়েছেন, মৌলবাদী অর্থনীতির বিগত চার দশকের নিট মুনাফার পরিমাণ আনুমানিক প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকা। এই বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছে মৌলবাদী এবং জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য। ফলাফল হয়েছে এই যে ’৬০-র দশকের ধর্মনিরপেক্ষ মানসিকতার বাংলাদেশ পরবর্তী চার দশকে অনেকখানী সাম্প্রদায়িক হয়ে গিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এর প্রমাণ দেখতে পাই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালি নারীর হিজাব গ্রহণে এবং সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গি হামলায়। ২০০১ সালের নির্বাচনে জিতে নৌকা মার্কায় ভোট দেয়ার অপরাধে এবং ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য জামায়াত-বিএনপি’র লোকেরা বহু সহিংস হামলা চালিয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর। রামু এবং নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর বর্বর হামলায় শুধু মৌলবাদী এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক বিএনপি নয়, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা কর্মীরাও অংশ নিয়েছে। নাসির নগরে সাম্প্রদায়িক হামলার পরিকল্পনাকারী হিসেবে গণমাধ্যমে নাম এসেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের। সাম্প্রদায়িকতা স্থান করে নিয়েছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সমাজের বিবেকবান মানুষেরা বলছেন, দেশের এক নম্বর সমস্যা এখন সাম্প্রদায়িকতা। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রথমেই দরকার অতীতের সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আইনগত শাস্তি নিশ্চিত করা এবং আওয়ামী লীগের ভেতরে থাকা সাম্প্রদায়িক মানসিকতার লোকদের দল থেকে বহিষ্কার করা। যুগপৎভাবে চালিয়ে যেতে হবে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক অভিযান।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সামরিক ফরমানে সংবিধান থেকে বাদ দেয়া হয় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূলনীতি ‘সমাজতন্ত্র’। দেশে চালু করা হয় পশ্চিমা স্টাইলের পুঁজিবাদ। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা সামরিক শাসকদের মাধ্যমে পুঁজিবাদ চালু করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এক কালের লাভজনক শিল্প কারখানাগুলোকে পানির দরে বেসরকারী খাতে বিক্রি করে দেয়া হয়। দেশে শুরু হয় ধনিক শ্রেণীর রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের মহোৎসব। সৃষ্টি হয় একটি পুঁজিপতি শ্রেণী। এমতাবস্থায় ’৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়ানোর জন্য দলীয় গঠনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্র বাদ দেয়। সংবিধানে সমাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে অপেক্ষা করতে হয় ৩৬ বছর। ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের প্রস্তাবনায় ফেরত আসে সমাজতন্ত্র। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে এখনো ফেরত আসেনি সমাজতন্ত্র। সংবিধানে ফেরত আসলেও রাষ্ট্রীয় নীতি এবং আইন প্রনয়ণের ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রের চর্চা অনুপস্থিত। এখনো দেশে আইন প্রণয়ণ হচ্ছে পুঁজিবাদী ভাবধারায়। সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক উন্নতি এবং জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি তরান্বিত হয়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, দারিদ্র কমেছে। মাথাপিছু জাতীয় আয় যতটুকু বেড়েছে ততটুকু আয় বাড়েনি দরিদ্র এবং নিম্ন আয়ের মানুষদের। মাথাপিছু জাতীয় আয়ের চেয়ে বহুগুণ আয় বেড়েছে মধ্যবিত্তের; তার চেয়েও বেশী পরিমাণে বেড়েছে ধনিক শ্রেণির। বেড়ে চলছে আয় ও সম্পদ বৈষম্য। বর্তমানের মত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরও বাড়বে। এখনই যদি সমাজতন্ত্রকে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে সমাজতন্ত্রকে যথাযথভাবে গ্রহণ করে জাতীয় আয় বণ্টনের দিকে যথার্থ গুরুত্ব দেয়া না হয় তবে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি শুধু ধনী মানুষদের দিকেই ধাবিত হবে।
২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে দেশ। এই জয়যাত্রা যেকোন সময় থেমে যেতে পারে সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গি হামলায়। জঙ্গিবাদ দমনের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জন হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা রোধে সরকারের পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। নাসির নগর এবং গোবিন্দগঞ্জে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়ে সচেতন মানুষদের দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়েছে। রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিয়ে এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে না পারলে ভেঙ্গে পড়বে রাজনৈতিক ভারসাম্য; থেমে যাবে অর্থনৈতিক উন্নতি। জাতীয় আয় বণ্টনের নীতিগুলোর মধ্যে সাম্যবাদী ভাবধারার যোগ না হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে না; বৈষম্যহীন সমাজের রূপকল্প “সোনার বাংলা” অধরাই থেকে যাবে। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের ধারণাগুলো বাস্তব রূপ নিতে থাকলে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারণা বহু নয়, এক হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)