মিয়ানমার বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে এমন এক আশ্বাস দিয়েছে। আজ মিয়ানমার-বাংলাদেশের মধ্যে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে একথা বলেছেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি’র দপ্তরের মন্ত্রী কিউ টিন্ট সোয়ে। আজই বাংলাদেশে এসে সভা করেন তিনি।
সভা শেষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী জানান একটি যৌথ ওয়ার্কিং কমিটির তত্ত্বাবধানে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে। দুদেশের মন্ত্রী পর্যায়ের সভায় মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার যে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে আপাতদৃষ্টিতে সেটি অবশ্যই মহামূল্যবান। তবে আগামীতে মিয়ানমার নতুন করে কোনো কৌশল অবলম্বন করে কিনা সেটাও বিবেচ্য বিষয় হিসেবে রাখতে হবে। কেননা এখন পর্যন্ত খবর আসছে রাখাইন রাজ্যে বেপরোয়া সেনাবাহিনীর জ্বালাও-পোড়াও অভিযান থেমে নেই। প্রতিদিনই নতুন নতুন কায়দায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর বর্বর হামলা চালানোর হচ্ছে।
গত ২৫ আগস্ট কিছু সেনাচৌকিতে আরসার বিদ্রোহীদের হামলার কথিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যের নিরীহ রোহিঙ্গাদের উপর বর্বর হামলা শুরু করে। সেই বর্বরতা থেকে জীবন বাঁচাতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-শিশু মিয়ানমারের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় গ্রহণ করে। এখনও নির্যাতিত আশ্রয়হীন রোহিঙ্গারা প্রতিদিনই আসছে। না এসে উপায়ও নেই। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে কেবল জীবন বাঁচানোর জন্যেই রোহিঙ্গারা নিরাপদ স্থানের জন্যে বাংলাদেশের দিকে ছুটে আসছে। সর্বশেষ হিসেব মতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আর স্থানীয় বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের নির্মম হামলায় নতুন করে দেশ ত্যাগ করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। এটি অবশ্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার হিসাব। তবে এর চেয়ে আরো বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে বলেই অনুমিত।
পৃথিবীর এখন সবচেয়ে সংকটাপন্ন জাতির নাম রোহিঙ্গা। কয়েক শত বছর ধরে মিয়ানমার তথা বার্মার রাখাইন রাজ্যে বসবাস করলেও নিজ রাষ্ট্র কর্তৃক তারা এখন চরমভাবে নির্যাতিত, নিপীড়িত, অপমানিত। রাষ্ট্রের নির্মম ও নিষ্ঠুর আচারণের কারণে গোটা জাতিই এখন অস্তিত্বহীন হয়ে রাষ্ট্রবিহীন হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গারা এখন দেশহীন মানুষ। রাষ্ট্র নিজেই রোহিঙ্গা নামের একটি জাতিকে নিজ দেশ থেকে মুছে ফেলার দৃঢ় প্রত্যয়ে হত্যা, বাড়ি পুড়িয়ে, নারীদের ধর্ষণ করে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছে।
উইকিপিডিয়াতে বলা হয়েছে রোহিঙ্গা হলো পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি রাষ্ট্রবিহীন ইন্দো-আরিয়ান জনগোষ্ঠী।
২০১৬-১৭ মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের পূর্বে অনুমানিক এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা মিয়ানমারে বসবাস করত। অধিকাংশ রোহিঙ্গা ইসলাম ধর্মের অনুসারী যদিও কিছু সংখ্যক হিন্দু ধর্মের অনুসারীও রয়েছে। ২০১৩ সালে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের বিশ্বের অন্যতম নিগৃহীত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করেছে। ১৯৮২ সালের বার্মিজ নাগরিকত্ব আইন অনুসারে তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্যমতে, ১৯৮২ সালের আইনে ‘রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা অর্জনের সম্ভাবনা কার্যকরভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ৮ম শতাব্দী পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া সত্ত্বেও, বার্মার আইন এই সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে তাদের জাতীয় নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করছে। এছাড়াও তাদের আন্দোলনের স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় শিক্ষা এবং সরকারি চাকুরীর ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা ১৯৭৮, ১৯৯১-১৯৯২, ২০১২, ২০১৫ ও ২০১৬-২০১৭ সালে সামরিক নির্যাতন এবং দমনের সম্মুখীন হয়েছে। জাতিসংঘ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের উপর চালানো দমন ও নির্যাতনকে জাতিগত নির্মূলতা হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
প্রতিদিনই উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের ঢল দেখে দেশের সাধারণ মানুষও এখন ভীষণ উৎকণ্ঠিত। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, রোহিঙ্গাদের ঢল নিয়ে অনেকেই নিজ দেশের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় ব্যক্ত করছেন। অনেকেই বলছেন কূটনৈতিক তৎপরতা সঠিকভাবে চালানো গেলে এই সমস্যা আশু সমাধানের সম্ভাবনা খুবই কম। বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদে চীন এবং রাশিয়ার ভূমিকা এবং ভারত কার্যত মিয়ানমারের পক্ষ নেওয়ায় বিশ্লেষকরাও মনে করছেন দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হওয়া খুবই জটিল এক বিষয়। এখানে অনেকেরই স্বার্থ থাকায় মিয়ানমার প্রচ্ছন্ন সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে।
আসলে রোহিঙ্গা সমস্যার অনেকগুলো বাস্তবতা দৃশ্যমান। যে বাস্তবতাগুলোকে বৈশ্বিক অনুসঙ্গের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। প্রথমত: বাংলাদেশের অন্যতম তিন মিত্র ভারত, চীন, রাশিয়া মিয়ানমারের পক্ষ অবলম্বন করায় বাংলাদেশের জন্য অনেকগুলো বিষয়ই জটিল রুপ ধারণ করেছে। উল্লিখিত তিনটি দেশের মধ্যে ভারত এবং চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের বৃহৎ বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। মিয়ানমারে নিজেদের ব্যবসা এবং বাণিজ্য সুবিধাকে এগিয়ে নিতে ভারত কিছু কৌশলও অবলম্বন করেছে। সম্প্রতি সেদেশে আইএমসিসি তথা ইন্দো-মিয়ানমার চেম্বার অফ কমার্সও গড়ে তোলা হয়েছে। মিয়ানমার টাইমস-এ দেওয়া এক সাক্ষাতকারে আইএমসিসির প্রেসিডেন্ট সুনীল শেঠ বলেছেন আগামীতে দুদেশের মধ্যে বাণিজ্যে বিনিয়োগ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। ভারত একইসঙ্গে মিয়ানমারের অবকাঠামো এবং সোলার এনার্জি খাতকে এগিয়ে নিতে সব ধরণের সহায়তা প্রদান করবে। বুঝতে অসুবিধা নেই যে এরকম একটি প্রেক্ষিতে ভারত এই মুহূর্তে আগ বাড়িয়ে মিয়ানমারের উপর কোনো ধরণের চাপ প্রয়োগ করতে আসবে না।
তবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘের ভূমিকা অবশ্যই অতুলনীয়। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা নিধনের বিষয়ে সবচেয়ে সোচ্চার মানুষটি হলেন জাতিসংঘের প্রেসিডেন্ট আন্টনিও গুতেরেস। অনেকেরই হয়তো মনে থাকার কথা ১ জানুয়ারি বান কি মুনের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার আগে তিনি প্রথম প্রতিক্রিয়াতে বলেছিলেন, সবার আগে অসহায়দের জন্য কাজ করবেন। রোহিঙ্গাদের অধিকারের বিষয়ে সোচ্চার হয়ে এ বিষয়টি তিনি স্পষ্টত প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি সত্যিকার অর্থেই অসহায় রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সবকিছু উপেক্ষা করে সবসময় ঘটে যাওয়া ঘটনার সত্যটা উচ্চারণ করেছেন। জাতিসংঘের সভায় সবসময়ই বলেছেন মিয়ানমার যে কাজটি করেছে সেটা শতভাগ অপরাধ। রোহিঙ্গা নামের জাতিটিকে নিধন করতেই মিয়ানমার এই অপরাধ কর্ম সংঘটিত করে চলেছে। তিনি বারবার মিয়ানমারকে সতর্কবার্তাও পাঠিয়েছেন। উল্লেখ্য যে, জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এর আগে পোলান্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। পোলান্ডের সোসালিস্ট পার্টির সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘসময়। এ ছাড়াও ১০ বছর জাতিসংঘের শারণার্থী বিষয়ক কমিশনের নেতৃত্ব দেন এই মানুষটি।
মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলার অং সান সুচির দপ্তরের মন্ত্রী কিউ টিন্ট সোয়ে বাংলাদেশ সফরে এসে রোহিঙ্গা শরণার্থী ফিরিয়ে নেবেন বলে ঘোষণা দিলেও এখানেই থেমে থাকার অবকাশ নেই। এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের যে গতিবিধি তাতে করে মনে হয় না তারা যে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্যে যে বর্বরতা চালিয়েছে তার জন্য সামান্য অনুতপ্ত। উল্টো মিত্রদের অভয়ে মিয়ানমারের আচারণ ভয়ংকরই মনে হচ্ছে। এমতাবস্থায় মিয়ানমারের উপর ক্রমাগত চাপ তৈরি ছাড়া বাংলাদেশের কাছে বিকল্প কোনো পদ্ধতি নেই। রোহিঙ্গা ইস্যুতে এখনও মিয়ানমার বড় ধরণের অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়নি। কোনো দেশ বা ফোরাম এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের অবরোধের ঘোষণাও দেয়নি। ইউরোপিয়ার ইউনিয়নের পার্লামেন্টে অবরোধ প্রস্তাব গৃহীত হলেও তার বাস্তবায়ন এখন দেখা যায়নি। তবে এর বাইরে বাংলাদেশ কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুকৌশলে কাজ করে মিয়ানমারের উপর চাপ তৈরি করতে পারে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে মিয়ানমারকে নিষিদ্ধ করার এজেন্ডাকে সামনে আনা যেতে পারে।
বর্তমানে মিয়ারমারের কয়েক লাখ শ্রমিক থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, কাতার, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে কাজ করে। শ্রমিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ করে থাইল্যান্ডে। সে দেশে এখন মিয়ানমারের শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখের উপরে। এরপরেই মালয়েশিয়াতে প্রায় ৫ লাখের মতো মিয়ানমারের শ্রমিক কাজ করে। এর বাইরে দক্ষিণ কোরিয়াতে প্রায় অর্ধলক্ষ শ্রমিক কাজ করে। মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মিয়ানমারের শ্রমিক রয়েছে। ইতোমধ্যে মিয়ানমার মধ্যপ্রাচ্যকে টার্গেট করে তাদের জনশক্তির বাজার বিস্তৃত করতে কিছু কৌশল তৈরি করেছে। মিয়ানমার যাতে কোনোভাবেই তাদের জনশক্তির বাজার বিস্তৃত করতে না পারে এর জন্য বাংলাদেশকে মধ্যপ্রাচ্যসহ মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। যদি আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারে মিয়ানমারকে নিষিদ্ধ করা যায় বা কোনো শর্তের মধ্যে আটকানো যায় তাহলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের উপর কিছুটা হলেও নতুন চাপ তৈরি করা সম্ভব হবে। গণহত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত মিয়ানমার যাতে কোনো দেশে শ্রমিক পাঠাতে না পারে এর জন্য অবশ্যই প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক তৎপরতা এখনই চালাতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)