রমজান ও সিয়াম সাধনা পরস্পর সমার্থক হলেও আল্লাহ পাক রমজান মাসের পরিচয় দিতে গিয়ে ইরশাদ করেছেন, ‘রমজান এমন মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী প্রমাণ।’ (সূরা বাকারা:১৮৫) তাছাড়া অন্য আয়াতে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আমি একে অর্থাৎ কোরআনকে লাইলাতুল কদরে নাজিল করেছি। (সূরা কদর: ১) আর লাইলাতুল কদরও রমজানে অবস্থিত। তাই সহজেই অনুমেয় রমজানের সাথে কোরআন মাজীদের সম্পর্ক আল্লাহ পাক কর্তৃক স্বীকৃত। শুধুমাত্র কোরআনই নয়; বরং) বিভিন্ন তাফসীরে রয়েছে, ইবরাহীম (আ.)–এর সহীফা রমজানের প্রথম রাতে, মূসা (আ.)–এর তাওরাত এ মাসের ষষ্ঠ রাতে, ঈসা (আ.)–এর ইনজীল এ মাসের ত্রয়োদশ রাতে এবং যাবুর অষ্টাদশ রাতে নাজিল হয়েছিল। (কুরতুবী: ২/২৯৮) অর্থাৎ সমস্ত আসমানী কিতাব নাজিল হওয়ার জন্য বিখ্যাত মাস রমজান।
পূর্ববর্তী উম্মতসমূহের কাছেও আল্লাহ পাকের হেদায়াতের বাণী এ রমজানে এসেছিল। এই দৃষ্টিকোণ থেকে রমজান হল মহাকল্যাণ ও হেদায়াতে ভরা মওসুম। এ কারণে মাহে রমজান কোরআন পাঠ, শিক্ষা গ্রহণ ও শ্রবণের এক মহালগ্ন। সালফে সালেহীন আওলিয়ায়ে কেরাম রমজানে কোরআন তেলাওয়াত করতেন খুব বেশি। তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান (রা.) রমজানের প্রতিদিন একবার কোরআন খতম করতেন। ইমাম মালেক (র.) রমজান আসলে অন্য সকল কাজ-কর্ম ছেড়ে কেবল কোরআন তেলাওয়াতে মগ্ন থাকতেন। দরস-তাদরীস, ফাতওয়া প্রদান ছেড়ে তিনি বলতেন এটা কোরআনের মাস। ইমাম আবূ হানীফা (র.) প্রতি রমজানে ৬০ বার কোরআন খতম করতেন। তাছাড়া তারাবীহ নামাজের খতম তো ছিলই।
কোরআন তেলাওয়াতের ফজিলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে কোরআন শরীফের একটি হরফ পাঠ করবে, তার জন্য এর বিনিময়ে দশটি সাওয়াব রয়েছে।’ (মুসনাদে বাজ্জার: ২৭৬১) আর রমজানে তো প্রতিটি আমলের সাওয়াব আল্লাহ পাক সত্তর থেকে সাতশ গুণ বাড়িয়ে দেবেন। সেজন্য রমজানের দাবি হলো, কোরআন তেলাওয়াত শিক্ষা করা, শিক্ষা দেওয়া আর কোরআন শ্রবণ করা। প্রতি রমজানের লাইলাতুল কদরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে জিবরাইল (আ.) কে কোরআন তেলাওয়াত করে শোনাতেন এবং জিবরাইল (আ.) রাসূল সা. কে তা তেলাওয়াত করে শোনাতেন।
রমজানে কোরআন তেলাওয়াত করা এবং শ্রবণ করার এক মহা সুযোগ হলো সালাতুত তারাবী হতে কিয়ামরত অবস্থায়। হাফেজে কোরআনগণ তারাবীহ নামাজে কোরআন তেলাওয়াত করেন আর মুসল্লীগণ পেছনে দাঁড়িয়ে তা শ্রবণ করে থাকেন। উমর (রা.) এ দৃশ্য দেখে বলেছিলেন, কতই না উত্তম পদ্ধতি এটি। (বুখারী: ১৮৭১)
কোরআন তেলাওয়াত করা যেমন সাওয়াবের কাজ, তেমনি এটা শ্রবণ করাও সাওয়াবের আমল। এ প্রসঙ্গে নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘রোজা এবং কোরআন কেয়ামতে আল্লাহর কাছে বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে ইয়া আল্লাহ! আমি তাকে পানাহার ও স্ত্রী সম্ভোগ থেকে বাধা দিয়েছি, অতএব আমার সুপারিশ কবূল করুন। কোরআন বলবে ইয়া আল্লাহ! আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বাধা দিয়েছি, অতএব আমার সুপারিশ কবুল করুন। এরপর তাদের সুপারিশ কবুল করা হবে। (মুসনাদে আহমদ: ৬৬২৬) অন্য হাদীসে রয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোরআন মাজীদের একটি আয়াত মনোযোগ দিয়ে শুনলো, তার জন্য বর্ধনশীল সাওয়াব রয়েছে আর যে তা তেলাওয়াত করলো, কেয়ামত দিবসে তা তার জন্য আলোকবর্তিক হবে। (মুসনাদে আহমদ: ৮৪৭৫)
তাই আসুন আমরা রমজানের বাকি দিনগুলো কাজে লাগাই বেশি বেশি করে কোরআন তেলাওয়াত করি। যারা তেলাওয়াত করতে জানি না, তারা তা শিক্ষা করি আর এর দ্বারা আমাদের পরকালীন জিন্দেগি সুখময় করি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা বেশি করে কোরআন তেলাওয়াত করো। কেননা, এটা তেলাওয়াতকারীর জন্য কেয়ামতের দিনে সুপারিশকারী হয়ে আগমন করবে। (মুসলিম: ১৯১০)
লেখক: মাওলানা মোহাম্মদ বদরুজ্জামান রিয়াদ