চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মাহাথির মোহাম্মদ: এক বুড়ো বীরের ফিরে আসা

আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার হিসেবে আমরা সকলেই মাহাথির মোহাম্মদকে চিনি এবং জানি। বিশ্ব রাজনৈতিক অঙ্গনে মাহাথির মোহাম্মদ ইতিমধ্যে নিজের কারিশমা দেখিয়ে মালয়েশিয়াকে একটি যোগ্যতম স্থানে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। সততা, সৎ চিন্তা, বুদ্ধিদীপ্ত মানসিকতা এবং নেতৃত্বের প্রগাঢ়তার কারণে মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ার সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন।

মালয়েশিয়ার জনগণও মাহাথির মোহাম্মদকে বিভিন্ন সময়ে প্রায়োগিক মূল্যায়ন এবং ভালবাসার প্রতীক হিসেবে বারংবার পরীক্ষায় (নির্বাচন ও দেশ পরিচালনায় গ্রহণকারী যে কোন সিদ্ধান্ত) উত্তীর্ণ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন। কাজেই, মাহাথির মোহাম্মদের সাথে মালয়েশিয়ার জনগণের বিশেষ আত্মিক এবং গাড় সম্পর্ক বিদ্যমান তা সহজেই প্রতীয়মান। মালয়েশিয়ার জনগণের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে মাহাথির মোহাম্মদ কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপও বৈশ্বিক অঙ্গনে সার্বিকভাবে সফলতার বাষ্প হিসেবে গৃহীত হয়েছে। শুধু বৈশ্বিক অঙ্গনেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার ইতিবাচক অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সারথি হিসেবে, দক্ষ সংগঠক হিসেবে এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক নেতা হিসেবে মাহাথির মোহাম্মদের প্রথিতযশা ভূমিকা অগ্রগণ্য।

মালয়েশিয়া-মাহাথির মোহাম্মদ-শপথ গ্রহণ

মালয়েশিয়ার নির্বাচনে মাহাথির মোহাম্মদই প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাপকাঠি হিসেবে কাজ করেছেন। ব্যক্তি মাহাথির যেখানে নির্বাচনে জয়লাভের ক্ষেত্রে ফ্যাক্ট হিসেবে কাজ করেছেন, সেখানে দলের ভূমিকা কিয়দংশ হলেও গৌণ ছিল। কারণ, মাহাথির যে দলের হয়ে দীর্ঘ ২২ বছর দেশ শাসন করেছিলেন সেই দলের বিরুদ্ধে এবং তাঁর প্রাক্তন শিষ্যের বিরুদ্ধে ব্যক্তিক কারিশমা দেখিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। সুতরাং বলা চলে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সফল রাষ্ট্রনায়ক মাহাথির মোহাম্মদকে মালয়েশিয়ার জনগণ পুনরায় রাজনীতিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এবং দেশ পরিচালনার দায়িত্বও প্রদান করেছেন দেশের কল্যাণার্থে।

৯২ বছর বয়সী মাহাথির মোহাম্মদকে কেন পুনরায় রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিলো মালয়েশিয়ার জনগণ? এ সংক্রান্তে খবর পড়ার এবং দেখার সময় বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। প্রায়োগিক ক্ষেত্র বিবেচনায় বেশ কিছু কারণ আমার মাথায় এসে ভর করে।কারণ, স্বাভাবিকভাবেই একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে উপদেষ্টা হিসেবে রাখা যেতে পারে, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদান অনেকাংশেই অমূলক হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ব্যক্তিটি যেখানে মাহাথির সেখানে সব হিসাব নিকাশ, পরিসংখ্যান এবং গবেষণালব্ধ ফলাফল অগ্রাহ্য হয়ে যায়। পাশাপাশি, মালয়েশিয়ায় যে দুর্নীতি এবং অরাজকতার সংস্কৃতি বিরাজ করেছিল তার থেকে পরিত্রাণের জন্য মালয়েশিয়ার জনগণ নানাবিধ উপায় কিংবা প্রক্রিয়ার অনুসন্ধান করেছিল। অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার শেষে মালয়েশিয়ার জনগণ ব্যালট বাক্সকেই বেছে নেয় প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের মাধ্যম হিসেবে এবং সেখানে তাদের প্রিয় মানুষ মাহাথির মোহাম্মদকে নির্বাচিত করে পরবর্তী সরকার পরিচালনার জন্য। এছাড়াও আমার নিকট মোটা দাগে বেশ কিছু কারণ বের হয়ে এসেছে যার কারণে মাহাথির মোহাম্মদকে রাষ্ট্রক্ষমতায় এনেছেন মালয়েশিয়ার জনগণ।

মালয়েশিয়া-মাহাথির মোহাম্মদ-শপথ গ্রহণ

প্রথমত: চলতি সরকারের সময়ে মালয়েশিয়ার মধ্যে যে দুর্নীতির মাত্রা এবং বিষ-বাষ্প ছড়িয়ে পড়েছিল তা থেকে পরিত্রাণের জন্য বিকল্প নেতৃত্বের সন্ধানে ছিল মুক্তিকামী জনগণ। সরকার দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে পড়েছিল এবং পাশাপাশি সরকারের নিজের লোকজনের দুর্নীতির সাথে সখ্যতা তৈরি হওয়ার গুজব ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিক। কাজেই, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে সরকারের পরিবর্তন জরুরী হয়ে পড়েছিল এবং নির্বাচনের ব্যালট বাক্সে জনগণ সেটি করে দেখিয়েছে। আবারও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য পরীক্ষিত রাষ্ট্রনায়ক মাহাথিরের হাতে রাষ্ট্রভার সমর্পণ করে জনগণ।

দ্বিতীয়ত: আইনের শাসনের অবনমন পরিলক্ষিত হচ্ছিল সর্বত্র। মানুষের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি চালু হয়েছিল এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে জনসাধারণের দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। পরিবর্তনের দাবিটা গোড়া থেকে শুরু হয়েছিল এবং মানুষও পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছিলেন এবং পুনরায় রাজনীতিতে এসে মাহাথির মোহাম্মদ তাদের দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। সব সুর এক গাঁথায় মিলিত হয়ে নির্বাচনের ফলাফলে প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে।

তৃতীয়ত: মাহাথির মোহাম্মদের শাসনামলে সামগ্রিকভাবে দেশের যে উন্নয়ন এবং অগ্রযাত্রা মসৃণ ধারার মতো চলমান ছিল তা অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়ে দুর্নীতি এবং আইনের শাসনের অভাবে। তাই মাহাথির মোহাম্মদ রাজনীতিতে আসার ঘোষণা প্রদানের সাথে সাথে জনগণ তা গ্রহণ করে এবং নির্বাচনেও পরিবর্তনের সাপেক্ষে মতামত প্রদান করেন। কারণ, সকলেই দেশের অগ্রগতি এবং অগ্রযাত্রার জন্য মাহাথিরের মতো কর্মপাগল এবং তেজোদৃপ্ত বীরদের প্রত্যাশা করে থাকে। সেক্ষেত্রে, দেশ এবং দশের উন্নয়নের স্বার্থ রক্ষার নিমিত্তে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল হয়ে থাকে। মালয়েশিয়ার জনগণও দেশের উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার প্রয়াস খুঁজে বেড়ায়।

চতুর্থত: উন্নয়ন এবং অগ্রযাত্রার জন্য মালয়েশিয়ার সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন জরুরী হয়ে উঠেছিল। কারণ, একনাগাড়ে একজন অজনপ্রিয় শাসক রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলে দেশের ভেতরে জনরোষ ও অশান্তির সৃষ্টি হয়ে থাকে। মালয়েশিয়াতেও তেমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। নির্বাচনের প্রচারণার সময়েও আমরা দেখেছি বুড়ো মাহাথিরের জনসভাগুলোতে জনস্রোত নেমে এসেছিল সেখানে প্রতিপক্ষ শিবিরের নির্বাচনী প্রচারের সময়েও কেমন যেন নিরুত্তাপ ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল। আসলে মালয়েশিয়ার রাজনীতির মাঠ কেমন যেন একটু নিরুত্তাপই ছিল, সেখানে উত্তাপ তথা প্রজ্বলনের শিখা তথা দীপ শিখা জ্বেলেছিলেন বুড়ো মাহাথির।

পঞ্চমত: ব্যক্তিক কারিশমা, জনগণের নিকট জবাবদিহিতা, রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা তথা আধুনিক ও উন্নত রাষ্ট্রের মননশীলতার পতাকাবাহী ব্যক্তিক সমীক্ষায় অন্য যে কোন প্রার্থীর চেয়ে মাহাথিরের জনপ্রিয়তা ছিল তুলনামূলকভাবে উর্ধ্বমুখী। তবে মাহাথিরের রাষ্ট্র পরিচালনাকালিন সময়ে বেশকিছু সমস্যাও উদ্ভূত হয়েছিল কিংবা তার বিরুদ্ধে বর্ণবাদের মতো নেতিবাচক প্রচারণাও ছিল। তবে তিনি সংগ্রাম করেছেন সতত, রাজনীতির মাঠের পাকা খেলোয়াড় মাহাথির দল থেকে বহিষ্কৃতও হয়েছিলেন। পরে আবার দুর্দান্ত প্রতাপের মাধ্যমে দলে ফিরে এসে জনগণের মন জয় করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় এবারও ৯২ বছর বয়সে নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে জয়লাভ করে বিশ্ব রাজনৈতিক ইতিহাসে নজির সৃষ্টি করেছেন রীতিমত।

শেষত: পরিবর্তনটা জরুরী হয়ে উঠেছিল মালয়েশিয় জনগণের জন্য। আর সেই মোক্ষম সময়ে মাহাথিরের মতো ব্যক্তিত্বকে কোনভাবেই হাতছাড়া করতে রাজি হয়নি মালয়েশিয়ার জনগণ। ক্ষমতার মসনদে তাকেই বসানোর জন্য চেষ্টা করেছিল দেশের অধিকাংশ মানুষ। যদিও তিনি পূর্বোক্ত নিজ দলের বিরুদ্ধে জোটের সাথে একত্রিত হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তথাপি পরিবর্তনের মৌলবাদে বিশ্বাসী জনগণ মাহাথিরের পক্ষেই তাদের মতামত ব্যক্ত করেন।

উপর্যুক্ত আলোচনা এবং ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ, বিচক্ষণতা, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা, কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের চিন্তা তথা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন এবং জনগণের মঙ্গলার্থে যে কোন রাজনীতিবিদের জন্য জনগণ তাদের নিজেদের সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছেন মাহাথির মোহাম্মদ। তাছাড়া, ৯২ বছর বয়সে কাউকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসায় জনগণ! মাহাথিরের মধ্যে পূর্বোক্ত গুণগুলোর সমন্বয় থাকায় মালয়েশিয়ার জনগণ তাদের পছন্দের মানুষটিকেই রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছেন।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।