২০০৯ সালের ১১ অক্টোবর, শ্রদ্ধেয় সহকর্মী মাহবুব মতিনের মৃত্যুর পরের দিন। অফিসের সবার মন বিষাদগ্রস্ত। আমারও মন খারাপ। নিউজরুমে ঢোকার মুখে কালো ব্যানারে মাহবুব ভাইয়ের ছবি। শোকবইয়ে মনের কষ্ট প্রকাশ করার চেষ্টা করছি সবাই। সারাদিন বসে বসে মৃত্যু সংবাদ ছাপা হয়েছে এমন পত্রিকা, অনলাইনে ঘুরলাম। এক পর্যায়ে মনে হলো সবগুলো লিংক, ছবি এক খানে করে রাখি। পিতার আদর বঞ্চিত ছোট্ট মৌনপ্রিয় বড় হয়ে যদি কখনো লেখাটির সন্ধান পায় তাহলে সে জানবে তার বাবা কেমন মানুষ ছিলেন। কত মানুষ তাকে ভালোমানুষি আচরণ ও পেশাদারিত্বমূলক মানসিকতার জন্য পছন্দ করতেন। সবচে বড় কথা মাহবুব ভাই তার ছেলেকে কতো ভালোবাসতেন তার দৃষ্টান্ত তিনি রেখে যেতে পেরেছেন। নিজ হাতে মৌনপ্রিয়র জন্য ওয়েবসাইট করে গেছেন। ব্লগের অনেক লেখায় ঘুরে ফিরে এসেছে মৌনপ্রিয়র প্রসঙ্গ।
মাহবুব ভাইকে অফিসের সবাই খুব পছন্দ করতেন। দেখেছি সিনিয়ররা তার প্রতি স্নেহসুলভ আচরণ করেন। আর তিনি জুনিয়রদের প্রতি ছিলেন সহযোগিতার দুহাত বাড়ানো। অন্যের প্রয়োজন অনুভব করে নিজ থেকেই আগবাড়িয়ে সহযোগিতা করতেন। তার উপস্থিতি সবার জন্য আনন্দময় ছিলো। সবসময়ই তিনি খুব আন্তরিক ও উচ্ছাসপূর্ণ আচরণ করতেন। যার সঙ্গেই দেখা হতো কোনো না কোনো খুঁটিনাটি মজা করতেন। সহকর্মী মেহেরুন রুনীকে এক কথা বার বার জিজ্ঞেস করলে খেপে যেতো। মাহবুব ভাই তাকে এক কথা বার বার বলে খেপাতেন। রুনি কাগজ কলম নিয়ে তেড়ে আসতো হাসি মুখে ।
সুদীপ্তা মাহমুদের ডাক নাম শম্পা। দেখা হলে শম্পার সঙ্গে মিলিয়ে আরো কয়েকটা শব্দ বানিয়ে বলতেন। শম্পা খুব খুশি হয়ে বলতো, ‘ থ্যাংক ইউ মাহবুব ভাই’। মাহবুব ভাই বলতেন, ‘অয়েল কিউ শম্পা’। মামূনুর রহমান খান রোমেল ভাই দেখা হলে আগে জিজ্ঞেস করতেন,‘ কি খবর মার্টিন ?’ জুলফিকার আলি মাণিক, জুলফিকার আলীর মতো রাশভারি ব্যক্তিত্বের সাংবাদিকদেরও দেখেছি মাহবুব ভাইয়ের উপস্থিতিতে হৈ হৈ করে হাসা হাসি করছেন । রাশেদ কাঞ্চন, রহমান মুস্তাফিজসহ সবার সঙ্গেই ছিল তার ব্যক্তিগত হৃদ্যতা।
বুঝতে পারছি এভাবে স্মৃতিচারণ অসম্পূর্ণ থাকবে। কারো মন ভরবে না। পরিচয় ছিল ব্যক্তিমাত্রই তার ঝলমলে স্মৃতিমুখর থাকেন । গত ছয় বছরে বিভিন্নভাবে দেখেছি।
আমোদপ্রিয় ও স্বপ্নবাজ মানুষ ছিলেন মাহবুব মতিন। পেশাগত কাজে তুমুল মনযোগী ও সৃষ্টিশীল ছিলেন। ২০০১ থেকে ৭ সাল পর্যন্ত প্রায় সব বড় ঘটনা কাভার করেছেন তিনি। জঙ্গী বিষয়ক অনুসন্ধানী রিপোর্টিং-এর জন্য সবার নজর কেড়েছেন অনেকবার। চ্যানেল আইয়ের দর্শক মাত্রই ওইসব রিপোর্ট মনে আছে মনে হয়। মাহবুব মতিনের নাম উঠলেই পরিচিত পরিমণ্ডলে অনেককে নিজ থেকে তার রিপোর্টিং-এর কথা বলতে শুনি। শায়খ আব্দুর রহমান, বাংলা ভাই গ্রেফতার লাইভ কাভার করছিলেন তিনি। কানসাট আন্দোলনও টানা কাভার করেছিলেন। যাত্রাবাড়িতে এমপি সালাউদ্দিন আহমেদের জনতার ধাওয়া খেয়ে পালানোর ভালো ফুটেজ ছিলো মাহবুব ভাইয়ের ক্যামেরায়। পরে এই ঘটনায় ‘দৌড় সালাউদ্দিন’ শব্দটি পরিচিতি পায়।
অন্য দুটি টিভির ক্যামেরাম্যান রাস্তার উপর দাঁড় করিয়ে রাখা মালবাহী ট্রাকের উপর দাঁড়িয়েছিলেন ভালো ফুটেজ পাওয়ার জন্য। পানি বিদ্যুতের দাবিতে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী এমপিকে ধাওয়া দিলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে যায়। ভাংচুরের ভয়ে ট্রাকগুলো এলাকা ছেড়ে যায় দ্রুত। সেই সঙ্গে অন্য টিভির ক্যামেরাম্যানরাও দূরে চলে যান। প্রসঙ্গ উঠলে এই ঘটনা বলে মাহবুব ভাই খুব হাসতেন।
তখন পুলিশ ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের মধ্যে প্রায়ই হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে বড় ধরনের ও দীর্ঘ সময়ের সংঘর্ষ হতো। মাহবুব ভাই এসবের ভালো ফুটেজ পেতেন। কখনো গা বাঁচানো কাজ করতেন না। তখন পুলিশ প্রায়ই আওয়ামী লীগ কর্মীদের পাশাপাশি সাংবাদিকদেরও পিটিয়ে দিতো। এরকম আন্দোলনের সময় একাধিকবার পুলিশের মার খেয়ে হাসপাতালে পর্যন্ত ভর্তি হতে হয়ে হয়েছে মাহবুব ভাইকে। একবার প্রেসক্লাবের পাশে মাহবুব মতিনের সঙ্গে প্রচণ্ড মার খেলেন ক্যামেরাম্যান জাহিদ সিদ্দিকী।
মাহবুব মতিনের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে তার নিজেরই আপলোড করা ভিডিওগুলো স্মৃতিকাতর করে তুলবে। হলিফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি মাহবুব ভাইকে এখনকার তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা দেখতে গিয়েছিলেন। সেসময় নিয়মিত রাজপথে আন্দোলন নেতৃত্বকারী আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের মধ্যে (সিনিয়র ধারাক্রমে বলছি না, যেভাবে স্মরণ হচ্ছে লিখছি) মোহাম্মদ নাসিম, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, উপাধ্যক্ষ্ আব্দুস শহিদ, অধ্যাপক আবু সায়ীদ, হাজী সেলিম, মোহাম্মদ হানিফ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ অনেককে দেখেছি তাকে রিপোর্টার হিসেবে পছন্দ করেন এমন মনোভাব প্রকাশ করতে। মাহবুব ভাই ইন্টারভ্যু বা পেশাগত কাজে যোগাযোগ করলে তারা আন্তরিকভাবে সাড়া দিতেন।
মাহবুব ভাই সবসময় শেষ মুহূর্তে রিপোর্ট ফাইল করতেন। সব সময়ই তার রিপোর্ট গুরুত্বপূর্ণই থাকতো। ঠিকমতো অন এয়ার হবে কিনা এ নিয়ে সবাই চিন্তিত থাকতেন। তখনকার চিফ রিপোর্টার, বর্তমান এডিটর সাইফুল আমিন ভাই বারবার তাগাদা দিতেন। সিএনই শাহ আলমগীর ভাই টেনশন লুকিয়ে হাসিমুখে মাহবুব ভাইয়ের মাথায় টোকা দিয়ে বলতেন, তাড়াতাড়ি মাহবুব। শেষ মুহূর্তে রিপোর্টের ক্যাসেট নিয়ে স্টুডিওতে দৌড় মারার জন্য তৈরি থাকতেন মোস্তফা ভাই। মাহবুব ভাই ঠিকঠাক নির্দিষ্ট সময়ের আগেই এডিটিং শেষ করতেন। ভিডিও এডির খোকন ভাই বা ইমরান ভাই ক্যাসেট ডাউনলোড দিয়ে বলতেন, ‘বাচাইলেন ভাই !’
আমাদের দেশে স্যাটেলাইট টিভি রিপোর্টিংএর প্রথম অর্ধ যুগ ক্রাইম রিপোর্টিংয়ে সন্তোষ মণ্ডল, এটিএন বাংলার মাহমুদুর রহমান, ইটিভির সুপন রায়, সোহেল মাহমুদ ভাইয়ের পাশাপাশি মাহবুব মতিনেরও উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিলো।
২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত পরিচালিত ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’-এও সন্তোষ দা’র পাশাপাশি মাহবুব ভাই ধারাবাহিক ছিলেন রিপোর্টিংয়ে।
তাঁর কাছে আমার ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা জানানোর কিছু আছে। শুধু এই-ই নয় যে, তিনি আমাকে তার স্নেহধন্য করেছেন ।
মাহবুব মতিনের মৃত্যুর পর তার পাঠানো পরম মমতামাখা কিছু উপহার আমার কাছে পৌঁছেছে। এই উপহার হলো কিছু মানুষ, কিছু সম্পর্ক। তার ঘনিষ্ঠ ছিলেন এমন অনেকে তার প্রিয়ভাজন ছিলাম বলে আমাকে নিজের আস্থায় নিয়েছেন। তাকে সংবাদ দিতেন পুরো বিশ্বাসে, আমাকেও জানাতে শুরু করেন। আজো অনেকের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা আছে যাদেরকে আমার দিকে ঠেলে দিয়ে গেছেন মাহবুব ভাই।
কিশোরগঞ্জের কাকন ভাই, ২০০২ সালের ডিবি ইন্সপেক্টর জাকারিয়া ভাই চাকরি জীবন শেষ করেছেন তিন বছর । এখনও যোগাযোগ আছে। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মাহবুব ভাই। মাহবুব ভাই মারা যাওয়ার মাস খানেক পর হবে। সহকর্মী ও গীতিকার রাজীব আহমেদ আমাকে স্বভাবসুলভ গোপন কথা ফাঁস করছে এমন করে নিচু স্বরে গাঢ় গলায় জানালো, মাহবুব ভাই তার সবচে কাছের বড় ভাই ছিল, আমাকে সেই জায়গায় ভাবে ও।
মাহবুব ভাই রাজীবকে বলেছেন, তিনি আমাকে পছন্দ করেন। প্রতিদিন রাজীবের সাথে দেখা হয়, প্রতিদিন মাহবুব ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক জাহিদ নেওয়াজ খান জুয়েল ভাই বললেন, মাহবুব ভাইয়ের উপর একটা লেখা দিতে।
জুয়েল ভাই নিজেই মৌনপ্রিয় শিক্ষা তহবিলের কোষাধ্যক্ষ। শ্রদ্ধেয় প্রণব সাহা ট্রাস্টের আহ্বায়ক। আমি সদস্য সচিব। মাহবুব ভাইয়ের মৃত্যুর পর তার শিশু সন্তানের ভবিষ্যত ও পড়াশোনা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে চ্যানেল আইয়ের এডিটর, নিউজ এন্ড কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, সাইফুল আমিন উদ্যোগ নিয়ে আমাদের প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও নিউজরুমের সহকর্মীদের কাছ থেকে ৮ লাখ টাকা সংগ্রহ করে ফান্ড করে এফডিআর করে দিয়েছেন।
ওই বছর চ্যানেল আই ডিআরইউ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ৫০ হাজার টাকার যে প্রাইজমানি পায় তাও এই তহবিলে যোগ করা হয়েছে। মাহবুব ভাইয়েরও ওই টুর্নামেন্টে খেলার কথা ছিলো। কিন্তু টুর্নামেন্টটি পিছিয়ে যাওয়ায় মাহবুব ভাইয়ের আর খেলা হয়নি। ফান্ডটি পরিচালনা করার দায়িত্ব আমাদের তিনজনকে দেওয়া হয়েছে। ভাবতে খুব কষ্ট হলেও এই ছোট কাজটি করে মনে হয় মাহবুব ভাই আমাদের সঙ্গেই আছেন।
তহবিলের বিষয়টি এজন্য বলছি না যে আমরা বড় কিছু করে ফেলেছি। এজন্য বলছি, এরকম উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে কারণ মাহবুব ভাই সেই ভালোবাসা আমাদের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছেন ভালোবাসা দিয়ে।
ভবিষ্যতে মৌনকে দেখানোর জন্য রাখা লিংকগুলোর অনেকগুলো কাজ করছে না দেখলাম আজ। যেগুলো আছে, যদি পৌঁছায়, বাবা বিষয়ে এতটুকু ভালোলাগার অনুভূতি যদি মৌনর মনে কোনোদিন তৈরি হয়; সেটা হবে মৌনর জন্য তার বাবার বন্ধুর উপহার।