বাস চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় করা মামলায় রায় দিতে গিয়ে আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, পরিবহন সেক্টরে প্রচুর খামখেয়ালিপনা দেখা যায়, মালিকরা চালকদের একটা নির্দিষ্ট জমা টাকা টার্গেট দিয়ে দেয়। এ কারণে মালিকদের খুশি করতে তারা বেপরোয়া গাড়ি চালায়।
রোববার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ইমরুল কায়েশ ওই মামলার রায়ে জাবালে নূর পরিবহনের দুই গাড়ির দুইজন চালকসহ তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত।
পাশাপাশি তাদেরকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেন। জরিমানা দিতে ব্যর্থ হলে তাদেরকে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে বলে জানান আদালত।
যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- দুই চালক মাসুম বিল্লাহ ও জুবায়ের সুমন এবং তাদের সহকারী কাজী আসাদ। আসাদ পলাতক রয়েছেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক ইমরুল কায়েশ আরো বলেন, এই মামলাটি দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায় হয়েছে যার সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এর চেয়ে বেশি শাস্তি দেয়ার সুযোগ নেই। আপনারা (সাংবাদিক) সংবাদগুলো এমনভাবে প্রচার করবেন যাতে ছাত্রসমাজ ও জনগণের মধ্যে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি না থাকে।
আদালত বলেন, পরিবহন সেক্টরে অনেক খামখেয়ালিপনা দেখা যায়। বাসের বেপরোয়া চলাচলের কারণে চাকার নিচে পিষ্ট হওয়া থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরাও। এ ঘটনায় ট্রাফিক পুলিশকে সচেতন হতে হবে।
‘‘মালিকরা চালকদের একটা নির্দিষ্ট জমা টাকা টার্গেট দিয়ে দেয়। যেটা তাদের জটিল হয়। এ কারণে মালিকদের খুশি করতে বেপরোয়া চালায়। মালিকদেরও সচেতন হতে হবে।’’
এর আগে ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ইমরুল কায়েশ ১ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেন। এ মামলায় ৪১ সাক্ষীর মধ্যে ৩৭ জন সাক্ষ্য দেন।
২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে এমইএস বাসস্ট্যান্ডে জাবালে নূর পরিবহনের দুই বাসের রেষারেষিতে বাসচাপায় নিহত হন শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আবদুল করিম রাজীব (১৭) ও একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিম (১৬)।
ঘটনার দিনই নিহত মিমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করেন।
২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক কাজী শরিফুল ইসলাম অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দেন। ২৫ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ইমরুল কায়েশ আসামিদের অব্যাহতির আবেদন না মঞ্জুর করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ঘটনার দিন-দুপুরে চালক ও তাদের সহকারীরা বেশি লোক ওঠানোর লোভে যাত্রীদের কথা না শুনে এবং তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে জিল্লুর রহমান উড়াল সড়কের ঢালের সামনে রাস্তা ব্লক করে দাঁড়ান। এ সময় আরেকটি বাসের চালক মাসুম বিল্লাহ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ১৪-১৫ শিক্ষার্থীর ওপর গাড়িটি উঠিয়ে দেন। ঘটনাস্থলেই দুই শিক্ষার্থী নিহত হন। আহত হন নয়জন।
জাবালে নূরের যে তিন বাসের রেষারেষিতে ওই দুর্ঘটনা ঘটে, সেগুলোর নিবন্ধন নম্বর হলো- ঢাকা-মেট্রো-ব-১১-৯২৯৭, ঢাকা-মেট্রো-ব-১১-৭৬৫৭ এবং ঢাকা-মেট্রো-ব-১১-৭৫৮০। এর মধ্যে ঢাকা-মেট্রো-ব-১১-৯২৯৭ নম্বর বাসের চাপায় নিহত হয় দুই শিক্ষার্থী। বাসটি চালাচ্ছিলেন মাসুম বিল্লাহ।
ঢাকা-মেট্রো-ব-১১-৭৬৫৭ নম্বর বাসের চালক ছিলেন জুবায়ের এবং ঢাকা-মেট্রো-ব-১১-৭৫৮০ নম্বর বাসের চালক ছিলেন সোহাগ। মামলায় আসামি করা হয় ছয়জনকে। তাদের মধ্যে জাবালে নূর পরিবহনের মালিক জাহাঙ্গীর আলম, দুই চালক মাসুম বিল্লাহ ও জুবায়ের সুমন এবং তাদের সহকারী এনায়েত হোসেন কারাগারে। জাবালে নূর পরিবহনের আরেক মালিক শাহাদাত হোসেন জামিনে রয়েছেন। তার পক্ষে মামলা উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। চালকের সহকারী কাজী আসাদ এখনও পলাতক।
রাজীব-দিয়ার নির্মম ওই মৃত্যুর প্রতিবাদে এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা শহরের প্রধান প্রধান সড়কগুলো অবরোধ করেন তারা। এমনকি কীভাবে সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে হয় সেটিও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন তারা।
ওই সময় শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর অন্যতম ছিল- বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে দুই শিক্ষার্থীকে হত্যাকারী চালকের ফাঁসির দাবি, সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি না চলা, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা এবং হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করা।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গত বছর ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে জাতীয় সংসদে সড়ক পরিবহন বিল-২০১৮ পাস হয়। পাস হওয়া আইনে সড়কে ‘ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে’ প্রাণহানি ঘটালে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়।
এছাড়াও কোনো ব্যক্তির বেপরোয়া ও অবহেলাজনিত গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে এবং সেই দুর্ঘটনায় কেউ আহত বা নিহত হলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে এবং সেই দুর্ঘটনায় কেউ আহত বা নিহত হলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।