প্রেম-ভালোবাসা শেষপর্যন্ত নার্সিসিজম-ই। প্রেমের বৈশিষ্ট্য এমন—প্রেমেবন্দী দুইটা মানুষ পরস্পরকে ছাড়া কিছু দেখে না, বুঝতেও চায় না। ‘ইশক’ মালায়ালাম সিনেমায় দেখানো ‘সাচি’ ও ‘বসুধা’র প্রেমসম্পর্ক নিয়ে আলাপ বাড়ানো যেতে পারে। বসুধার জন্মদিন, সাচি পুরো দিনটা বসুধার সাথে কাটাতে চায়। বন্ধুর গাড়ি নিয়ে তাই সে বসুধার সাথে লংড্রাইভে বের হয়। মধ্যরাত, শহর থেকে দূরে অপেক্ষাকৃত নির্জন পার্কিং লটে সে গাড়ি পার্ক করে। এবার উভয়ের প্রবল ইচ্ছা পরস্পরের সাথে কিছু অন্তরঙ্গ সময় কাটানোর। এমতাবস্থায় গাড়িতে তাদেরকে দুজন অপরিচিত লোক দেখতে পায়। এরপর পুলিশ পরিচয়ে তারা গ্রেপ্তারের হুমকি দিয়ে তাদেরকে মানসিক অত্যাচার করতে থাকে।
এবার ঘটনার উল্লেখ থেকে আমরা দুটো প্রসঙ্গের দিকে যেতে পারি। প্রথমত, আমাদের সমাজে বিবাহপূর্ব বা বিবাহ-বহির্ভূত নারীপুরুষের যেকোন মাত্রার শারীরিক সম্পর্ক আইনত অপরাধ। কাজেই একটা দেশের আইনকে কেন্দ্র করে সে দেশের মানুষের মানসিকতা তৈরি হয়। আবার ওইসব আইন উক্ত দেশের সামাজিক ও ধর্মীয় অনুভূতিগুলোকেও ইঙ্গিত করে। অতএব আপনি যেহেতু আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ, তাই ওই সমাজের আইনলঙ্ঘনের যেকোন পরিণতি সম্পর্কে আপনার অবগত থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, দুজন মানুষ তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় কাঠামোর বাইরে ভিন্ন মানসিকতা পোষণ করতেই পারেন। উভয়ের সম্মতিতে ব্যক্তিগত দিক থেকে তারা তাদের সম্পর্ককে যেকোন পরিণতির দিকে নিতে পারেন। কিন্তু ব্যক্তির সাথে সমাজ ও ধর্মের, বিশেষ করে আইনের এই বিরোধ মোটেই নতুন কিছু নয়।
ঘটনার বিশদে এখানে আরও স্তর আছে। সমস্যাগুলো মূলত অনেক গভীরের। পুরুষ মানসিকতা। জন্মের পর থেকে পরিবার-সমাজ-শিক্ষাস্থান পুরুষকে নীতিশিক্ষা দিতে ও মানুষ বানাতে ব্যর্থ। একটা ছেলের বেড়ে উঠা এতটাই একপাক্ষিক হয় যে বন্ধুমহলে ‘হাফ লেডিস’ বা ‘মেয়ে’ ট্যাগ পাওয়া তার পুরুষত্বের সবচেয়ে বড় অপমান হয়ে যায়। মননে ও শরীরে নারী সংবেদনশীলতা চলে আসা সে পুরুষালী স্বভাবের বিরোধ মনে করে। এইসব স্বভাবের কারণে তার মধ্যে তৈরি হতে থাকে নারীবিদ্বেষী মনোভাব। আবার নরম স্বভাবের ছেলেদেরকে মেয়েরাও কাঙ্ক্ষিত পুরুষ ভাবে না। কারণ একই প্যারেন্টিং, শিক্ষা ও সমাজব্যবস্থা থেকে সেও বেড়ে উঠেছে। পুরুষালী স্বভাব নিয়ে একটা ছেলের জন্ম হয় না। তেমনি মুহূর্তে কেউ বদলেও যায় না। এটা সে তার চারপাশের পরিবেশ থেকে শিখে বড় হয়। এভাবে শিখে শিখে একটা পুরুষ মানব থেকে দানবে পরিণত হয়।
স্বীকৃতিহীন সম্পর্ক। আমাদের সমাজ-ধর্ম-আইনে প্রেম যেহেতু অবৈধ, তাই তাদের বিরুদ্ধে যেকোন অন্যায় করা সহজ। যেহেতু প্রেমিকযুগল এই সমাজেরই অংশ, তাই তাদের সাথে হওয়া অন্যায়ের কোন ধরনের প্রতিবাদ তারা করতে পারে না। প্রেমিক-প্রেমিকাকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখামাত্রই তাই তৃতীয় ব্যক্তিটি মেয়েটির চরিত্র নিয়ে নেতিবাচক সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়। একইকারণে সে ভেবে দেখতে পারে না এই অন্তরঙ্গতা উভয়ের সম্মতিতে হচ্ছে। কাজেই তাদের অবৈধ সম্পর্কের শুদ্ধি পরীক্ষা দেয়া লাগে চূড়ান্ত অপদস্ত কিংবা ধর্ষিত হয়ে। যেহেতু সম্পর্কটা অবৈধ তাই সেইসূত্রে ধর্ষকরা ধর্ষণ করার লাইসেন্সও পেয়ে যায়। আবার একটা পুরুষের সেক্সুয়াল ফ্রাস্ট্রেশন কোন পর্যায়ের সেটা তার সেক্সুয়াল পারফরম্যান্সের ঘাটতি নিয়ে দুশ্চিন্তা থেকে টের পাওয়া যায়। চেহারা দেখে তো আর ধর্ষক শনাক্ত করা যায় না, তবে এদের আড্ডার চৌম্বক বিষয় থাকে নারীদেহ বা বিকৃত যৌনতা। এইসব আড্ডা শোনামাত্র আপনি বুঝে নিতে পারেন আড্ডায় থাকা সবার মধ্যেই কম-বেশি পটেনশিয়াল ধর্ষক লুকিয়ে আছে। উপযুক্ত সুযোগের অভাবে কেবল সেই অবয়ব বেরিয়ে আসছে না।
এখন পর্নো দেখে উত্তেজিত হয়ে বা কাউকে উত্ত্যক্ত করে তো কাঙ্ক্ষিত যৌনতা মিলছে না। তখন সে সম্মতি ছাড়াই যৌনতায় লিপ্ত হতে চাইবে। এসবক্ষেত্রে দেখা যায় হয়ত সে মেয়েটিকে প্রপোজ করে সম্মতি পায়নি অথবা মেয়েটির সান্নিধ্য পাবার কোন ধরনের যোগ্যতা তার নেই। এতে করে তার মধ্যে তৈরি হয় একধরনের হীনম্মন্যতাবোধ। যোগ্যতা হয়ত নেই কিন্তু লিঙ্গসূত্রে সে নিজেকে সুপিরিয়র মনে করে বলেই জোরপূর্বক পথে যায়। আপনি কার উপর শারীরিক আক্রমণ করেন? যাকে আপনি দুর্বল ভাবেন। ইনফেরিয়র ও ভোগবস্তু মনে করা একইরকম মানসিকতা। যৌনতা গোপনীয় কার্যকলাপ। যেহেতু ধর্মে-সমাজে যৌনতাকে রাখঢাক করে রাখার ব্যাপার আছে তাই নারীসঙ্গ পাওয়াটা হয়ে যায় সুযোগ-নির্ভর বিষয়। আবার সুযোগটা নিতে হলে আপনাকে পাওয়ার-গেমে এগিয়ে থাকতে হবে। একটা মেয়েকে তাই কতটা নির্জনে পাওয়া গেল এবং ওই অবস্থায় মেয়েটির সাথে পাওয়ার-গেমে কতটা শক্ত ও স্বস্তিদায়ক অবস্থায় থাকা গেল- এগুলো শক্ত বিষয়। ক্ষমতা এমনই, নারী কিংবা পুরুষ ক্ষমতা পাওয়া মাত্রই হিংস্র হয়ে যেতে পারে।
এদেশের মেয়েরা যে ধর্ষিত হবে সেটা এদেশের সমাজ-ধর্ম-পরিবার-আইন-রাজনীতি অনেক আগেই ব্যবস্থা করে রেখেছে। ধর্ষণ মূলত নারীর প্রতি সহিংসতাবোধ ও সুযোগসন্ধানী আচরণের চূড়ান্ত প্রকাশ। পথেঘাটে, গণপরিবহনে, কর্মস্থলে অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে, আকার-ইঙ্গিতে উত্ত্যক্ত করা সুযোগসন্ধানী আচরণেরই নানা প্রকাশ। বিচারহীনতার দীর্ঘ ইতিহাস, অপরাধীকে রাজনৈতিকভাবে আশ্রয় দেয়া, অন্যায়ে ভিক্টিমের চুপ থাকা- এগুলো ধর্ষককে তার অপকর্মের পরিণতি নিয়ে সজাগ থাকতে সাহায্য করে।
এই উপরের পয়েন্টগুলোর চর্চা আমরা দীর্ঘদিন ধরে সযত্নে পালন করে আসছি। একটা মেয়ের সাথে অন্যায় হলে তার পরিবার তাকে চুপ থাকতে বলে। কেন? সমাজে গ্রহণযোগ্যতা না পাওয়ার ভয়ে। এই চেপে যাওয়া রীতিতে তাই সমাজের অদৃশ্য চাপ আছে। সমাজই শিখিয়েছে যে ধর্ষিত হয়েছে তার সম্মান চলে গেছে, যে ধর্ষণ করেছে তার নয়। ধর্ষণ করছে কে? পুরুষ। কাজেই একটা মেয়েকে ঘরে বন্দি রেখে ধর্ষণের কোন সমাধান হবে না। কারণ ঘরের ভেতরেও সে ধর্ষিত হচ্ছে। পরিবারের উচিত ছেলেটির বেড়ে উঠায় নজর রাখা।
যখন আপনি অনুভূতিহীন হয়ে যান, যখন আপনার ভেতরের ‘মানুষ’ মরে যায় সেখান থেকে তৈরি হয় হিংস্রতা। এই হিংস্রতা বা যৌন অসুস্থতা থেকে ছয় মাসের শিশু কিংবা ষাট বছরের বৃদ্ধা, কেউ রেহাই পায় না। অধিকন্তু এইধরণের হিংস্র ধর্ষকেরা নির্যাতনের মাত্রা ঠিক করে পরিণতি চিন্তা করে। যেমন ২০১২ সালের দিল্লি-ঘটনায় ধর্ষকদের নির্যাতনের মাত্রা এতটাই পাশবিক ছিল যে মেয়েটিকে শেষপর্যন্ত মারা যেতে হয়। সম্ভবত তাদের শক্ত সন্দেহ ছিল মেয়েটি পরবর্তীতে মুখ খুলতে পারে। মেয়েটা হয়ত নির্যাতিত হবার সময় প্রতিশোধ নেবার ইঙ্গিত দিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু এমসির ঘটনায় ধর্ষকেরা হয়ত ভেবেছে স্বামী-স্ত্রী সম্মানের ভয়ে মুখ খুলবে না, সেজন্যেই মেয়েটি প্রাণে বেঁচে গেছে। এখানে পাত্রপাত্রীর সম্পর্ক সিনেমা থেকে ভিন্ন হলেও ঘটনার পরিণতি আরও ভয়ংকর হয়েছে।
সিনেমায় আমরা নায়ক-নায়িকার সাথে ঘটতে থাকা মানসিক ও শারীরিক হয়রানিতে তাদের সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে দেখি। অপরাধ-পরবর্তী সামাজিক নির্যাতনের আগে আমরা তাদেরকে ব্যক্তিক মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে দেখি। পুরুষতন্ত্রের আধিপত্য আদিকাল থেকে নারীর সম্মান তার স্ত্রীযোনি দিয়ে নির্ধারণ করে এসেছে। বাস্তবের মত সিনেমাতেও আমরা অভিন্ন কিছু ঘটতে দেখি না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)