বালিয়াড়িতে উপুড় মৃত শিশু আয়লান কুর্দির আলোকচিত্রটি এখনো আমাদের স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে, তাই না? ছবিটির সীমাহীন ফটো-ভ্যল্যু, ক্যামেরা-ভ্যল্যু ছিল। তাই আয়লানকে ভুলে গেলেও ফটোগ্রাফিটি আমরা ভুলব না। ‘বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি’ স্লোগান আঁকা পোস্টারগুলোর মোক্ষম মৃত মডেল হয়েছিল আয়লান। এনজিওরাও পোস্টারে বা রিপোর্টের কভারে আয়লানকে রেখে ফান্ড ডোনেশন পেয়েছে। তার ছবির মডেল মূল্যমান বাড়ানোর জন্য একটি গল্পও জুড়ে দেয়া হয়েছিল। ক্যামেরার সমান ফোকাস ছিল আয়লানের মাথার কাছে পড়ে থাকা একটি পুতুলের উপর । এটি ‘আয়লানের পুতুল’—ছবির গায়ে এমন গল্পও সেঁটে দেয়া হল। জুড়ে দেয়া গল্প ছবিটিতে একটি হৃদয়গ্রাহী ও উপভোগ্য মাত্রা এনে দিল।
চিন্তাশীল ব্যক্তি মাত্রই বুঝার কথা সাগরের ঢেউয়ের দায়িত্ব নয় আয়লানের পুতুলকেও তার মাথার কাছে পৌঁছে দেয়া।
অনেকেই বুঝতে পারেননি মৃত শিশুর গ্ল্যামারেরও বাজারমূল্য আছে! নির্মমতম সত্যটি হচ্ছে এই মৃত আয়লানই আদুরে জামা-জুতায় উপুড় ভঙ্গি না থেকে রোহিঙ্গা শিশুর মত ময়লা পোশাকে পঁচা গলা শরীরে চিৎ হয়ে থাকলে মিডিয়া, সোস্যাল মিডিয়া, ক্যামেরা কোনো মাধ্যমেই বিশেষ পাত্তা পেতনা। এমনই এক নষ্ট-ক্লিষ্ট সময়ে আমাদের বাস যখন মৃতেরও গ্ল্যামার থাকতে হয়, ক্যামেরা ভ্যাল্যু থাকতে হয় । ধিক! স্বীকার করতে দ্বিধা নেই এই লেখা লিখতে গিয়ে আমাকে কাঁদতে হচ্ছে। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। এলোমেলো আঙ্গুল পড়ছে ভুল কি-বোর্ডে।
দুঃখবোধটি এ’কারণে যে আপাতজীবিত আসলে মৃত আরেকটি গ্ল্যামারও বুঝতে পারছে না সে খুনীদের হাতের পুতুল হয়ে মডেলিং করছে। মডেল সেই শিশুটি গুলিবিদ্ধ হলে তার বেঁচে থাকার জন্য আমরা প্রার্থনারত হয়েছিলাম। সে এখন তরুণী। নাম মালালা ইউসুফজাই। ইউনিসেফের দূত। বিশ্বের শিশু অধিকার নিয়ে কথা বলার দায়িত্বপ্রাপ্ত। তাকে নিয়ে গান, গল্প, কবিতা, সিনেমা, ফটোগ্রাফি, ডকুমেন্টারি, পিএইচডি; তার নিজের আত্মজীবনী, নোবেল পুরস্কার অর্জন, বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব প্রাপ্তি কোনোটিই আর বাকি নেই।
মালালা বোকো হারামের স্কুলছাত্রী অপহরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকে, ফিমেল জেনিট্যাল মিউটিলেশন বন্ধের জন্য কাজ করে—আমরাও এ’সব কাজে তাকে সমর্থন দিই, দিচ্ছি এবং দিব। কিন্তু নির্বিচার শিশুহত্যার যে বীভৎস মচ্ছব তার প্রতিবাদে কেন তার কোনো দায়-দায়িত্ব নাই—এই প্রশ্নটি ছুঁড়ে দিতে আমাদের আর দেরি করার ফুরসত নাই। মার্কিন যুদ্ধবিমানের গোলার আঘাতে বিদ্যালয়ের শ’খানেক শিশু হত্যার মত যুদ্ধাপরাধ তো পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও নাই। দুইটি বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস তন্নতন্ন করে ঘেঁটেও এমন নজির মিলবে না।
সারা দুনিয়ার আমি আপনি আপনারা ফেসবুক-ট্যুইটার সামাজিক মাধ্যমে সারাদিন-রাতভর লিখে যা কিছু করতে পারি তার হাজার ভাগের একভাগ চেষ্টায় তরুণী মালালা বিশ্বকে জানিয়ে দিতে পারে এবারই প্রথম নয়, ২০০৬ হতে এই পর্যন্ত আফগানিস্তানেই প্রায় চার হাজার শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। দ্যা ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম-দেখিয়েছে একই রকম হামলায় ২০০৬ সালেও একটি স্কুলে ৬৯টি শিশুকে হত্যা করা হয়। ২০১১ সালে ক্রিস উডের লেখায় উঠে আসে সাত বছরে বিভিন্ন সময়ে ১৬৮টি শিশুকে সিআইএ’র ড্রোন হামলার মাধ্যমে হত্যা করা হয়। এদের বেশির ভাগই ছিল হয় ঘুমন্ত নয় খেলাধুলারত।
মালালা কি করতে পারে?
চাইলে বলে দিতে পারে অনেক কিছুই । সে এখন প্রাপ্তবয়স্ক। শিশুটি নয়। স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেবার আইনানুগ ক্ষমতার অধিকারী। সে প্রতিবাদে নোবেল প্রত্যাখ্যান করতে পারে। অক্সফোর্ড ছাড়তে পারে। জাতিসংঘের দুতিয়ালি ছাড়তে পারে। তার সংস্থা ইউনিসেফই ২০১৭ সালকে ঘোষণা করেছে “অ্যা নাইটম্যের ইয়ার ফর চিল্ড্রেন ক্যট ইন ওয়্যার জোনস’। এ’নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে কেন বিশ্বের রিফিউজি শিশুদের ৯৬ ভাগই মুসলিম দেশের? শুধু ২০১৭ সালেই ইরাকে ও সিরিয়ায় ৭০০ এবং ইয়েমেনে ৫০০০ শিশুকে হত্যা করা হয়। দক্ষিন সুদানে ১৯,০০০ শিশুএখন শিশুযোদ্ধা যাদের সামনে মৃত্যু এবং হত্যাকাণ্ড ব্যতিত আর কোনো ভবিষ্যত নাই। ২০১৫ সালের ইউনিসেফ রিপোর্ট দেখিয়েছিল বিশ্বময় ২৩০ মিলিয়ন শিশু যুদ্ধরত দেশগুলোর যুদ্ধক্ষেত্রে আটকা পড়ে আছে। এ’সব তথ্যগুলো তো অন্তত সারা বিশ্বকে জানান দিতে পারে।
প্রশ্ন উঠতে পারে কাজটির জন্য মালালাকেই উপযুক্ত ভাবতে হবে কেন?
উত্তরটি একেবারেই সহজ। এটি মডেলিং ফেটিশিজম এবং ব্রান্ড ফেটিশিজম এর সময়। মালালাকে বিশ্বময় শিশুদের জন্য একমাত্র আইকন হিসেবে পরিচিত করে তোলা হয়েছে। অতটা পরিচিত আর কেউ কি আদৌ আছে কোথাও? নিশ্চিত নাই। তা’হলে শিশুহত্যার প্রতিবাদের বেলায় মালালা কেনইবা ক্ষীণকন্ঠ বা কন্ঠবিরতিতে থাকছে?
বিশ্বরাজনীতির ক্রীড়ণক হয়ে মডেলিং করার বদলে শিশুদের জীবন রক্ষায় সত্যিকারের মডেল হবার জন্য মালালাকে অনুরোধ করাই আমাদের দায়িত্ব। (যাঁরা যেই ভাষায় দক্ষ—ইংরেজি, আরবী, উর্দু, হিন্দি, ফরাসি, পর্তুগিজ—দয়া করে লিখুন। অনায়াসে এই লেখাটিও অনুবাদ করতে পারেন।) মালালা যদি শিশু হত্যাযজ্ঞ বিষয়ে খানিকটা বিশ্বদৃষ্টিও আকর্ষণ করতে পারে, অনেকগুলো শিশুজীবন রক্ষা পাবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)।