মান্তা । বলতে গেলে এক ‘জলে ভাসা’ সম্প্রদায়। বরিশাল-পটুয়াখালীর গলাচিপা, তেঁতুলিয়া, আন্ধার-মানিক ইত্যাদি নদীতে এ সম্প্রদায়ের দেখা মেলে। এরা এই নদীগুলোর আশপাশের এলাকায় ২০-৫০টি পরিবার নৌকায় জলে ভেসে ভেসে কাটিয়ে দিচ্ছে জীবন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। ছোট্ট একটা নৌকাই যাদের ঘর-বাড়ি-সংসার। নৌকাতে জন্ম, শৈশব, কৈশোর, যৌবন, বার্ধক্য আর সেই নৌকাতেই মৃত্যু।
নৌকায় করে মাছ ধরে তাদের জীবিকা নির্বাহ। চর মন্তাজ পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার একটি ইউনিয়ন। চারদিকে তেঁতুলিয়া নদী ঘেরা। চর মন্তাজ আসলে একটি দ্বীপ। অদূরেই যার সমুদ্রের গর্জন। সেই চর মন্তাজে চ্যানেল আই অনলাইনের আলোকচিত্রে ধরা পড়ল ‘মান্তা’দের দৈনন্দিন জীবন। নদীর তীরে নৌকা আর নৌকা। প্রতিটি নৌকায় এক একটি সংসার, এক একটি পরিবার। সেখানে জমে আছে হাসি-কান্নার জীবনের গল্প।
কোহিনূর, বয়স বিশ বা বাইশ। আক্কেল সরদারের মেয়ে। নৌকায় যার জন্ম। এখানেই বড় হয়েছেন। নৌকা চালনায় পারদর্শী। নদীতে মাছ শিকার করতে পারেন সহজাতভাবেই। প্রেম যেমন নদীর সাথে, বেঁচে থাকার লড়াইটাও সেই নদীর সাথেই। দেখেছেন নদীর বিধ্বংসী রূপ, ঢেউয়ের তছনছ করে দেওয়ার শক্তি। নদীতেই সব হারিয়েছে বহুবার। শৈশব কৈশোর পেরিয়ে স্বামী বসারের সাথে তার সংসার। বাবার নৌকা ছেড়ে সংসার পেতেছেন স্বামীর নৌকায়। এই নৌকাটিই তার শ্বশুড়বাড়ি। রান্না-বান্না। ঘর-গেরস্তি। একমাত্র সন্তান সুজন। ভালোই কাটছে কোহিনূরের জীবন, স্বামী আর ছেলেকে নিয়ে।
কোহিনূরের নৌকায় দুপুরে রান্না হচ্ছে শুধু ডাল ভাত। বিকেলে যদি মাছ ধরা পড়ে আর বিক্রি’র পর যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে তাহলে মাছ রান্না হবে রাতে। ছেলে সুজনের প্রিয় আইড় মাছ।
পান-সুপারি খাওয়া তাদের অভ্যাস। ছেলে-বুড়ো সবারই পানে-জর্দায় লাল ঠোঁট। পান খেতে খেতে রান্না-বান্নার আয়োজন, সন্তান সামলানো, আরও কতো কাজ কোহিনূরের।
যদি হঠাৎ কোন দুর্ঘটনায় বাচ্চাটা পানিতে পড়ে যায়! এই ভয় কি নেই কোহিনূরের? কিছুক্ষণ চুপ থেকে জানায়— এটাই তাদের জীবন। গত বর্ষায় প্রতিবেশী রুজিনার বাচ্চাটা তেঁতুলিয়ায় ডুবে মারা যায়। হারিয়ে যায় চিরতরে। জাহেদার শিশুটাও একইভাবে শেষ। কী করবে এই মান্তা মায়েরা? প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অনেক মৃত্যু দেখেছে তারা। অনেক মানুষ ডুবে যাওয়ার খবর শুনেছে ওরা।
সমতল ভূমি কেনার টাকা নেই। দুঃখ, জরা, জীর্ণতা, অভাব, অনটন জীবনকে এতোটাই ভারী করে তুলেছে যে সে জীবন পরিণত হয়েছে এক পাথর জীবনে। যেন আর ভাসতে চায় না। সামনে এগোবার ঢেউ এসে এই মান্তা জনপদে দোলা দেয় না আর ।
বাচ্চাদের জন্য স্কুল নেই। শৈশব থেকে তারা শেখে ঢেউয়ের সাথে কী করে যুদ্ধ করতে হয়। কী করে নদী থেকে, সমুদ্র থেকে তুলে আনতে হয় রূপালি জীবিকা। এছাড়া আর কোন স্বপ্ন দেখতে শেখেনি ওরা।
স্বাস্থ্য সমস্যাও প্রকট। নদীর পানিতেই রান্না-বান্নার থাল-বাসন ধুয়া, কাপড় ধোয়া। নদীতেই মল-মূত্র ত্যাগ। সোহাগ বলছিলেন রান্না ও খাবারের পানি আনতে হয় স্থল থেকে। সেখানেও একটা মাত্র টিউবওয়েল। সরকারি টিউবওয়েল হলেও পানি আনতে দিতে হয় প্রতি মাসে পঞ্চাশ টাকা।
চর মন্তাজের মান্তারা জিম্মি মহাজনদের কাছে। নৌকা বা জালের প্রয়োজনে মহাজনদের কাছেই তাদের হাত পাততে হয়। এই হাতপাতা শুধু তাদের শেকলে বন্দী করে।সুদের কঠিন শেকল। ঘাম ঝরা শ্রমে ধরা মাছ নির্দিষ্ট মহাজনের আড়তেই দিতে হয়।পায় না ন্যায্য মূল্য।
জীবনের মৌলিক অধিকার বঞ্চিত এক জনগোষ্ঠী যেন এই মান্তা সম্প্রদায়।
দিন পাল্টাচ্ছে। উন্নত হচ্ছে দেশ। কিন্তু সে উন্নয়নের স্রোতে মান্তাদের জীবন-নৌকা কী ততোটা ভাসছে- যতোটা ভাসার কথা ছিল বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে? তার প্রতিফলন পাওয়া যায় না তাদের যাপনে, জীবনমানে।
মান্তা জনগোষ্ঠী পাল্টে ফেলতে চায় তাদের জীবনধারা। ভবিষ্যত প্রজন্মকে দিতে চায় নিশ্চিত ভবিষ্যত। তারা চেয়ে থাকে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের মানুষের দিকে।