কানে প্রথমবার বাংলাদেশের কোনো সিনেমা অফিশিয়ালি নির্বাচিত হয়েছে। জুন মাসের শুরু থেকেই সেই আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে ভাসছে বাঙালি সিনেমাপ্রেমী সহ এই সিনেমা সংশ্লিষ্টরাও। কিন্তু যিনি সিনেমাটির মূল কাণ্ডারি, তারই ছিলো না কোনো খবর!
বলছি কানের ‘আনসার্টেন রিগার্ড’ বিভাগে স্থান করে নেয়া ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ এর নির্মাতা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের কথা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ কোথাও তাকে খোঁজে না পাওয়া গেলেও ৭ জুলাই কান উৎসবে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ এর উদ্বোধনী প্রদর্শনীর দিনে দেখা গেলো সাদকে। আড়াল ভেঙে এদিন সামনে আসেন তিনি।
পরবর্তীতে ফ্রান্সের স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমেও সিনেমাটি নিয়ে কথা বলতে দেখা যায় নিভৃতচারী সাদকে। শুক্রবার এই নির্মাতাকে ডয়েচে বাংলার ভিডিও সাক্ষাৎকারেও প্রথমবার কথা বলতে দেখা যায়। সাদকে নিয়ে আগ্রহী পাঠকদের কথা বিবেচনা করে সেই সাক্ষাৎকারটি লিখিত রূপ প্রকাশ করছে চ্যানেল আই অনলাইন:
আপনি কেন গণমাধ্যমের সামনে কথা বলেন না?
এমনিতে আমার জন্য এটেনশন হ্যান্ডেল করা একটু ডিফিকাল্ট, কারণ আমি অস্বস্তি বোধ করি। আমার কাছে মনে হয় এটেনশন পাওয়া উচিত আমাদের ছবিটার, যেখানে আমাদের পুরা টিম কাজ করেছে, এতোটা কষ্ট করেছে। সো, এটেনশন ছবিটা পাইলে আমার বেশি ভালো লাগে কারণ আমার একটু ইনভিজিবল থাকতেই ভালো লাগে।
কানে এসে কেমন লেগেছে? এখন কেমন লাগছে?
আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই উদ্বিগ্ন ছিলাম। স্পেশালি সিনেমাটির স্ত্রিনিং পর্যন্ত। শুধু আমি না, আমরা পুরো টিমই উদ্বিগ্ন ছিলাম, স্ট্রেসফুল ছিলাম মানুষ কীভাবে রেসপন্স করবে সেটা ভেবে। সো, এরপর যেটা ঘটলো সেটা তো আসলে ইনক্রেডিবল। মানে এটা যে চাওয়া যাইতে পারে বা এমন রেসপন্স পেতে পারে সেটাই আমি কখনো চিন্তা করিনি। আমার কাছে ছবিটির ডিসেন্ট একটা স্ত্রিনিং হলেই খুশি হয়ে বাড়ি ফিরে যেতাম। যেটা হইসে সেটা ওভার ওয়েলমিং ছিল যে আমি সেটা এখনও বোঝার চেষ্টা করসি। সবাইতো বাঁধনকে দেখেছেনই, সো আমার মনে হয় ওর জন্য ক্যাথারটিক ছিল ফুল জার্নিটা।
সত্যজিত থেকে সাদ, কানে বাংলা ছবির এই যাত্রা নিয়ে কী বলবেন?
এটা আসলে বিশাল পাওয়া। ছবি বানানোর সময় তো আমরা ওভাবে চিন্তাই করিনি। আমাদের কাছে ছবিটা বানানোটাই ইম্পোর্টেন্ট ছিল। এখন যা হচ্ছে সেটার জন্য আই ফিল লাকি আসলে। আমরা যখন কোন ফিল্ম বানাই তখন তো আসলে ওই বিগার ক্যানভাসের কথা মাথায় রেখে বানাই না। আমি জানি না আসলে, অন্তত আমি ওভাবে চিন্তা করে ফিল্ম বানাইনি। সো, এখন যা ঘটসে তার জন্য আমরা খুবই লাকি, খুবই গ্রেটফুল, খুবই অনার্ড। কিন্তু, ফিল্ম যখন আমরা নির্মাণ করেছি তখন আমরা আমাদের সেরাটাই দিয়ে কাজ করেছি। নিজেদের মত করে নিজেদের ছবিটা নির্মাণ করতে চেয়েছি।
কোন কারণে কি গল্প বদলাতে হয়েছে?
ফিল্ম রাইটিং তো এমনিতে একটা লং প্রসেস। আমি আসলে কোন সিনেমাটা বানাতে চাই সেটা ফিগার আউট করতেও কিন্তু একটা প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আমি আসলে কি চাই, কোন কোশ্চেনগুলো রেইজ করতে চাই, কোন কমপ্লেক্স ক্যারেক্টারটা নিয়ে আমি কাজ করতে চাই সেটা ফিগার আউট করাও কিন্ত একটা লম্বা সময়ের ব্যাপার। সো, আমি এটা চিন্তা করেই আগাই। আমার পক্ষে আসলে এটা চিন্তা করে ফিল্ম বানানো সম্ভব না বাজারে কোন ফিল্মটি চলবে কিংবা মানুষ কোন স্টোরিতে রিয়েক্ট করবে। আমার কাছে আসলে এটা স্ট্রাগল ছিল আমি কোন ছবিটি বানাতে চাই, কোন স্টোরি চাই সেটা ফিগার আউট করা। সেটা বুঝতে আমাকে প্রায় দুই-আড়াই বছর সময় নিতে হয়েছে। সো, অনেক ড্রাফটের পর এই স্টোরি মাথায় আসে। একটা টাইমে বাঁধন যখন এই প্রজেক্টে যুক্ত হয় তখন ওর সাথেও স্টোরিটি নিয়ে আলোচনা করা শুরু করি। সো এরপর ডেপথ ডেভেলপ করতে করতে ফাইনালি যখন আমার কাছে মনে হয়েছে এই ছবিটা আমি বানাতে চাই, তারপরই প্রোডাকশনে যাই। কিন্তু এখানে কোন এক্সটার্নাল ইনফ্লুয়েন্স কিংবা অন্য কোন চিন্তা ভাবনা থেকে লেখার চেষ্টা আমি করিনি।
আপনি যে গল্পটি বলতে চেয়েছেন সেটা কি পর্দায় তুলে ধরতে পেরেছেন?
আই হোপ আমি চেষ্টা করেছি। এখানে আপনারা জুরি, আপনারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে আমরা পুরো টিম আমাদের সেরাটা দিয়েই সিনেমাটি নির্মাণের চেষ্টা করেছি।
রেহানা আপনার মনস্তত্ত্বেরও কি প্রতিফলন?
নরমালি আমি পার্সোনাল এক্সপেরিয়েন্সের বাইরে তেমন লিখতে পারিনা। যদি এমন কিছু লিখেও থাকি তবে সেটা সাম হাউ এমন হয় লাইফে কোন না কোন ফর্মে আমি পার্সোনালি সেটা দেখেছি কিংবা অবজার্ভ করসি এমন কিছু থেকেই লেখা। সেক্ষেত্রে আমি বলবো আমি আমার চিন্তা ভাবনা রেহানার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে চেয়েছি ঠিক তা না। কিন্তু, ডেফিনেটলি এটা একটা পার্সোনাল প্রসেস।
গল্প লেখার সময় দর্শকের প্রতিক্রিয়া ভেবেছেন?
আমি যেভাবে দেখেছি আমি সেভাবেই ওকে পোট্রে করেছি। সেক্ষেত্রে আসলে কীভাবে পোর্ট্রে করলে এটা অডিয়েন্সের কাছে কি ইমপ্যাক্ট ক্রিয়েট করবে সেই ক্যালকুলেশন করে আসলে লেখা হয়নি। ওভাবে আমি কখনো এপ্রোচও করিনা আমার কোন গল্প কিংবা ক্যারেক্টারকে। ছোটবেলা থেকেই অনেককে দেখসি স্কার্ফ পরতে এমনকি আজান দিলে আপুদেরকে মাথা কাপড় কিংবা স্কার্ফ দিতে সো এসব ছোট খাটো ডিটেইল আসলে লাইফ থেকেই নেওয়া।
রেহানা ছাড়া অন্য চরিত্রকে গুরুত্ব কম দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন?
যেহেতু ছবিটির কাহিনী সিঙ্গেল একটি ক্যারেক্টারকে কেন্দ্র করে এবং রেহানার চোখ থেকেই দেখা সেক্ষেত্রে আমার চেষ্টা ছিল ওর পয়েন্ট অব ভিউ থেকেই পুরো কাহিনীকে তুলে ধরা। আমি সে চেষ্টাই করেছি। অনেকের কাছে সেটা সফল মনে হতে পারে আবার অনেকের কাছে নাও মনে হতে পারে।
এই সিনেমার গল্প কোন বিতর্কের জন্ম দিতে পারে?
আমি যেহেতু কোন পলিটিক্যাল ফিল্ম মেইক করিনা সেক্ষেত্রে আমি ডেফিনেটলি আমি কোন পলিটিক্যাল স্টেটমেন্ট দেওয়ার জন্য এই সিনেমাটি বানাইনি। আমি খুবই ক্যারেক্টার রিভেইন। আমি রেহানাকে ফলো করতেছিলাম সো ওকে পুশ করতে যেয়ে, ওকে বিভিন্ন সিচুয়েশনে প্লেস করতে যেয়ে আমার যেই কোশ্চেনগুলো এড্রেস করা উচিত আমার মনে হয় আমি সেগুলোই করেছি। আমার মনে ফিল্মটি তখনই সাক্সেসফুল হবে যখন এটা থেকে মানুষ ভাবতে শুরু করবে। ফাইনালি আমার মনে হয় এই ফিল্ম কোশ্চেনগুলোই এর আউট কাম হবে র্যাদার দেন এর অ্যান্সার।
পুরো সিনেমাতে নীল রংয়ের ছোঁয়া কেন?
আমরা যখন ফার্স্ট টাইম কালার স্ক্রিন নিয়ে কথা বলতেছিলাম তখন আমার অবজেক্টিভ ছিল কী ধরনের কালার স্ক্রিন কিংবা কী কালার প্যালেট করলে আমরা রিয়েলি রেহানার ইনার টার্মালটা ক্যাপচার করতে পারবো। ওর ভেতরকার অ্যাঙ্গার, ওর ভেতরকার কনফ্লিক্টগুলো, ওর ক্যারেক্টারের পুরোটা কীভাবে অনেক ফ্ল্যাশব্যাক না দিয়ে কিংবা অনেক ইনফরমেশন না দিয়েও অডিয়েন্সের কাছে ওই ফিলিংটা পর্দায় তুলে ধরতে পারবো। একটা পর্যায়ে আমরা ফিল করি এই কালারটি দ্বারাই আমরা ছবিটির আসল এটমসফিয়ার পর্দায় তুলে ধরতে পারবো।
ক্যামেরা, সাউন্ড ও এডিটিংয়ের অন্যরকম কেন?
ফার্স্ট অফ অল, হ্যাঙ্গেল ফটোগ্রাফির ডিসিশানটা এই কারণে আমি যেহেতু ক্যারেক্টার রিভেইন তাই আমার সেন্স অব এসথেটিক আমি চাই খুব ক্লোজ রেঞ্জে ক্যাপচার করতে। সেক্ষেত্রে আমার ছবির ল্যান্ডস্কেপ থাকে আমার মেইন ক্যারেক্টারের ফেইস। সেক্ষেত্রে তার প্রত্যকটা এক্সপ্রেশন, তার মুভমেন্টকে ক্যাপচার করাই লক্ষ্য থাকে। শুধুমাত্র পারফর্ম করার জন্য যা প্রজেক্ট করতেসে সেটি না, যেটা ও প্রজেক্টও করতেসে না ওই ফিলিংটা কনভে করার জন্য এই ধরনের ফটোগ্রাফি আমার চয়েস। আমার কম্পজিশন ও ফ্রেমিং নিয়ে প্রচুর অবসেশন আছে। আজকে আমরা খুবই প্রিসাইজ, কিন্তু তুহিনকে অনেক সাফার করতে হয়েছে এটার জন্য।
সিনেমাটির এডিটিং নিয়ে যদি বলি তবে এটা সত্যি যে আমার এডিটিং ঠু হার্স। ফার্স্ট অফ অল আমি চাইনা আমার ন্যারেটিভ অনেক বেশি সেন্টিমেন্টাল হোক। আমি সাধারণত সব কিছু এক্সপ্লেইন করতে চাই না একটু স্পেস রাখতে চাই যেন অডিয়েন্স এন্টারপ্রেট করতে পারে। সো এই টেনডেনসি থেকে অ্যাপ্রোচ করলে এডিটিং হার্স হবেই। এবং হার্স হওয়ার আরো একটি কারণ হলো আমার সিনেমার ক্যারেক্টারের লাইফটাই যেহেতু হার্স। সেহেতু ওই রিয়েলিটিটা ক্যাপচার করতে হলে কালার থেকে শুরু করে লেন্স প্রত্যেকটি ব্যাপারই খুব ইমপোর্টেন্ট।
সাউন্ড ডিজাইনের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। এটি নিয়েও আমরা অনেক কাজ করতে হয়েছে। আরেকটা বিষয় আমি সাউন্ডে অনেক বিশ্বাসী। আমি মনে করি দেখার থেকে শোনাটা আমার কাছে বেশি ইমপোর্টেন্ট। আর যেহেতু কোন সাউন্ড ট্র্যাক আমার ছবিতে নাই সেক্ষেত্রে সাউন্ড ট্র্যাক নিয়ে আমার অভিমতটা এমন যে, আমার কাছে মানে সাউন্ড ট্র্যাক দিয়ে অডিয়েন্সের ফিলিংসকে গাইড করা হয়ে থাকে। যেমন, তোমার এখন মন খারাপ করতে হবে, এখন হ্যাপী হতে হবে। সো আমার কাছে সাউন্ড ট্র্যাক দেওয়া মানে অডিয়েন্সের ফিলিংসকে গাইড করা। যদিও অন্য ফিল্ম মেকার নিয়ে আমার কোন আপত্তি নেই। তবে আমি চাইনা অডিয়েন্সের ফিলিংসকে গাইড করতে।
বড় বাজেট পেলে কি শব্দ, রং, সম্পাদনার কাজ বিদেশে করতেন?
ফার্স্ট অফ অল আমি একটা কথা বলে রাখতে চাই আমার সিনেমার যেই টেকনিক্যাল টিম রয়েছে এর বাইরে আমি এখনো কারো সাথে কাজ করিনি। সেক্ষেত্রে এই সিনেমাটি যদি কোটি কোটি টাকার সিনেমাও হতো তাহলেও এই একই টিম কাজ করত। কারণ তাদের সাথে আমার যেই আন্ডারস্ট্যান্ডিং সেটি আমি অন্য কোথাও পাবো কিনা জানিনা। আমি খুবই ডিপেন্ডেন্ট এই টিমের প্রতি। তারা প্রত্যকেই খুবই ব্রিলিয়ান্ট। একই সাথে আমরা পুরো টিমের প্রত্যেকেই একজন আরেকজনকে এতটাই বুঝি যে আমার মনে হয় না আমার অন্য টিমের প্রয়োজন আছে।
ছবিটা কেন দেখা উচিত?
কেন দেখতে হবে কিংবা কেন দেখা উচিত সেটা আমরা বলতে পারবো না। ওটা আমাদের কাজও না। আমাদের কাজ ছিল আমাদের বেস্ট এফোর্ড দিয়ে ছবিটা তৈরী করার, আমরা সেটাই করেছি। এরপর বাকিটা আশা করতে পারি, আমি আশা করি আমাদের অডিয়েন্সরা আসবে, ট্রাই করবে, ছবিটাকে চান্স দিবে, এটাই আশা করি।
সিনেমাটি নিয়ে কতদূর যাওয়ার আশা?
যেটা পেয়েছি সেটা অনেক বেশি হয়ে গেছে আমার জন্য। আমার ধারণা, ওটা ডিল করতেও টাইম লাগবে আমার। অনেস্টলি যদি বলি, আমি এখন চিটাগাং ব্যাক করতে চাই। আমার জন্য এটা অলরেডি ঠু মাচ। কিন্তু, মানুষ তো পাইলে আরো পাইতে চায়। সেক্ষেত্রে অ্যাওয়ার্ড পেলে ডেফিনেটলি আমার ভালো লাগবে।