১৯৭২ সন থেকে প্রথমে সাপ্তাহিকে পরে দৈনিকে কম বেশি কলাম লিখি। মাঝে মধ্যে প্রতিবেদনও। বাইরে হলে সাংবাদিক সমাজের একজন হিসাবে গণ্য হতাম। এদেশে একটি শক্তপোক্ত সাংবাদিকতার তকমা না থাকলে ‘সাংবাদিক’ পরিচয় হয়না, জাতীয় প্রেস ক্লাবে কখনো ঢুকলে ক্লাবপ্রহরী এমন কটমট করে তাকান যেন বিজাতীয় কেউ, গটমট উল্টো হেঁটে চলে আসি। প্রেস ক্লাবের সদস্য হলে সস্তায় ভালো খাবার মেলেনি ক্লাবের কল্যাণ ভূমিকার শুরুতেই এমন কথা শুনি।
অবশ্য কেন যেন নিজেকে এ সমাজেরই পরোক্ষ, গোপন, নিভৃত একজন মনে করি। একজন নিষ্ঠাবান সাংবাদিককে গভীর শ্রদ্ধার চোখে দেখি, সমাজে লুটপাট যতো বাড়ে, প্রকৃত পেশাজীবী সাংবাদিকের জীবন ততোই বিপন্ন হতে থাকে। আমাদের খুলনার মানিক নামের সাংবাদিক বন্ধুকে প্রায়শঃ হুঁশিয়ারি দিতাম। তিনি এখন সকল হুঁশিয়ারির উর্ধে। হত্যাকারীরা বোমা মেরে ওনার মগজশুদ্ধ মস্তকটাই উড়িয়ে দিয়েছিল। ঐ মস্তকটি খুলনার লুটপাটি চক্রের জন্য তীব্র মাথাব্যাথার কারণ হয়েছিলো। অতএব ওরা মানিকের মস্তকটাকেই টার্গেট করেছিলো।
এই বয়ানটুকু খুবই জরুরি। কারণ এর পরের কথাটুকু ওই মিডিয়াকর্মীদের উদ্দেশ্যেই মূলত নিক্ষিপ্ত হবে। একটি সংবাদ কিংবা একটি মন্তব্য হতে হবে সত্য তথ্যনির্ভর। যথাসম্ভব, যথাসাধ্য, যথাযথ। প্রকৃত সত্য এবং তথ্যে যদি নিকটজনও বিড়ম্বিত হয়, তাতে কারোই কিছু করার নেই। সততা, দৃঢ়তা, পেশাগত দক্ষতার মিশেলে একটি খবর, ফিচার বা প্রতিবেদন হতে হবে নৈতিকতায় উত্তীর্ণ। সারাদেশে এখন প্রিন্ট আর অনলাইন মিলিয়ে হাজার হাজার সাংবাদিক গিজগিজ। প্রথমত: এরা চলেন কী করে? স্ব স্ব কর্তৃপক্ষ থেকে কতো টাকা পারিশ্রমিক পান? লোকে বলে নাম না জানা শত শত পত্রিকার ‘সাংবাদিকেরা’ রিপোর্ট-অ্যামবুশ করে থাকেন। একটি রিপোর্ট তৈরি করে যাদের সম্পর্কে ওটা গঠিত, তাদেরকে দেখান। অবশেষে সেই রিপোর্ট প্রকাশ না করার শর্তে নৈতিকতা গর্তে ফেলেন। সাংবাদিকের নাম এখন ‘সাংঘাতিক’। সাংবাদিক এখন খবর বিক্রি করে। বিজ্ঞাপন তোলে চাকুরির আইডি কার্ড বাঁচানোর জন্য। সাংবাদিক বাড়ির ফাউন্ডেশন দেয়, সে বাড়ি গড়ে ওঠে শনৈ শনৈ। সাংবাদিকেরা পেশার শুরুতেই এখন সম্পত্তি বিক্রির লেনদেন মাধ্যম। সাংবাদিকেরা ব্যবসায়ী গ্রুপের বাদ-বিসম্বাদের সালিশী প্রান্তরে। আমাদের লুটপাট-প্রধান অর্থনীতিতে আমাদের মিডিয়া জনাব এবং বেগমদের মূল ভাবমূর্তি যদি এরূপ হয়, এই ভাবমূর্তি মুছে ফেলার উদ্যোগ কিংবা কর্মধারা কই?
এ ধরনের অনেক ‘ছোটভাইয়ের’ সঙ্গে একান্তে আলাপ করেছি। কথা বলে সমস্যার গভীরে যেতে চেয়েছি। এদের অনেকেই ‘কলম-সন্ত্রাসী’ ভূমিকায় নিজেদের সম্মানিত বোধ করছেনা। কিন্তু কী আর করা যাবে? ঘর সংসার, বাবা-মা, ভাই বোন, স্ত্রী-সন্তান সবার চাহিদা যোগান দিতে যে ক্রমশ: ‘সাংঘাতিক’ হয়ে যেতে হচ্ছে। আমাদের সামাজিক সম্মান নেই জানি, এক ধরনের ‘নিউজ ঠেকবাজ’ হিসেবে আমাদের জানে, কিন্তু উপায় নেই! কোথাও কোন অপরাধ-ধর্ষণ-দুর্নীতি হলে আমরাও আইনশৃংখলা রক্ষাবাহিনীর মতোই ঝাঁপিয়ে পড়ি। ওখানেইতো আমাদের ভাগ্য রোশনাই! লোকে আসলে আমাদের ঘৃণা করে, ছোট চোখে দেখে। একটি মহৎ পেশা আজ দুর্বৃত্ত প্রধান অর্থনীতিতে অধঃপতিত।
মফঃস্বল শব্দটি এখন অচেনা অজানা। ঢাকার বাইরের সবটুকুই ছিল মফঃস্বল। পত্র-পত্রিকা প্রকাশের একদিন-দুইদিন পর মফঃস্বলে পৌঁছাতো। পত্রিকা পৌঁছাতে যোগাযোগ ব্যবস্থা হেতু বিলম্ব হতো বিধায় পত্রিকার ‘মফঃস্বল সংস্করণ’ প্রকাশিত হতো। ‘মফঃস্বল সংবাদদাতা’ নামে তখন পদায়ন ছিলো, আর আজকাল! সকালে কতো তাড়াতাড়ি পাঠকের হাতে সারাদেশে পত্রিকা পৌঁছানো যায়, সেজন্য যে স্মার্ট-চৌকশ যোগাযোগ ব্যবস্থা, দুঃসময়ের আমরাই চমৎকৃত হয়ে যাই। মতামতের স্বাধীনতা? জনগণের জানার সুযোগ? আগের তুলনায় এখন বলা যায় ঘটে গেছে ‘বৈপ্লবিক পরিবর্তন’।
আজ এসব কথা বলার জন্য লিখতে বসিনি। বুকের ভিতর খুবই দুঃখ, খুবই কষ্ট। এ আমরা সবাই মিলে কী করলাম। কেন, কি জন্য, কিভাবে আমরা এই রাজধানীর অনেক বুদ্ধিমান-ঝানু লোকেরা বাংলাদেশের মফঃস্বলের একজন সরল, সহজ, নিরহংকার, পরোপকারী ধরনের সামন্ত-সংস্কৃতির মানুষকে আমাদের রাজধানী-মহানগর সম উঁচু নাসিকা দ্বারা এভাবে অপমানপিষ্ট করলাম? অন্ততঃ সাংবাদিক সমাজের মানুষতো সবার আগে অবহিত থাকবেন একজন জনপ্রতিনিধির ভালো-মন্দ-বৈশিষ্ট্য-সবলতা-দুর্বলতা সম্পর্কে?
কেন ওভাবে ওই লোকটিকে আমরা মিডিয়া-কাঠগড়ায় তুলে মানহানি করলাম। মিডিয়া ভুবনে কে কোথায় কেমনভাবে কী কাজ করেন, এসবতো অজানা থাকেনা। ব্যাংক থেকেই খবর প্রকাশিত হয়, কে কোথায়, কত অংক কত ‘টংক’ জমিয়েছে। অথচ একটি ‘ঘটনা’ পেয়ে গেলেই সমাজের অন্য পেশার উঁচু উঁচু দায়িত্বের মানুষগুলোর ইন্টারভিউ নেওয়ার নামে হ্যারাস কিংবা অবমাননার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতার ন্যূনতম নৈতিকতাকেও আমরা ছুঁড়ে ফেলে দিই বর্জ্যভান্ডারে।
মানুষটি এখন নেই। তখন তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ছিলেন। অনেকেরই টার্গেট প্রধানমন্ত্রী অর্থাৎ শেখ হাসিনা। বিশেষত: ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে নবগঠিত সরকারটিকে হাস্যকর-তুচ্ছ করে তোলার জন্য তক্কে তক্কে ছিলেন মিডিয়ার একদল সুচিহ্নিত মানুষ। এই সমাজকল্যাণ মন্ত্রী মানুষটি যে আসলে হাওর প্রান্তরের আরেকজন বাউল কর্মী এলোমেলো মানুষ, এটিতো মিডিয়া জানবে সবার আগে। পত্রিকায় মঞ্চে বসে সিগারেট খাবার ছবি ওঠার পর পরই আমাকে বেশ কয়েকজন বললেন, আওয়ামী ঘরানায় এমন জনদরদী মানুষ কিন্তু কমই আছে। বললামও কাছের কয়েকজন মিডিয়া মানুষকে। এদিকে ধূম প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। কার থেকে কে কতো বেশি ওনাকে নিয়ে বিদ্রুপাত্মক, হাস্যকর এপিসোড গড়তে পারেন! একপর্যায়ে তিনি মেজাজ হারিয়ে সাংবাদিকদের একাংশকে ‘খবিশ’ বলে গালমন্দ পাড়লেন। সেটা নিয়ে শ্রীহট্ট কান্ড! এবং একসময় মিটমাট।
কিন্তু ভিতরে ভিতরে যে ওনার শরীর এতো দুর্বল এবং অচল হয়ে আসছে, সেটা কেউ আমরা খেয়াল করিনি। এক ধরনের বেতালা-বেসামাল হয়ে পড়ছিলো সবকিছু। তারপর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সিঙ্গাপুর গেলেন। চিরতরেই।
এবার একেবারে ভিন্ন চিত্র, এক অসাধারণ অপরূপ অধ্যায়। মৌলভীবাজারের সাধারণ মানুষ তাদের প্রিয়তম জনপ্রতিনিধির আকস্মিক প্রয়াণে যেন মহা অনাথ হয়ে গেছেন। স্বজনের জন্য শোকের যে বিষাদমূর্চ্ছনা, হাওরের বাতাসে বাতাসে বৃষ্টির কান্না। উন্মোচিত হচ্ছে এক একটি অধ্যায়।
কতো মানুষ বিশেষত: যারা অসুস্থ, কীভাবে দেশে বিদেশে নিয়মিত চিকিৎসার সুযোগ পেতেন ঐ বেসামাল আবেগী মানুষটির উদ্যোগে এবং তত্ত্বাবধানে। হে মিডিয়া মানুষ, আপনারা বলুনতো, এদেশের ইতিহাসে আর একজন মফঃস্বল জনপ্রতিনিধিও কোথাও কখনো এরূপ চিকিৎসাবিন্যাস করেছিলেন কিনা! ঢাকায় স্বীয় মন্ত্রীনিবাসকে অসুস্থদের ওয়েটিং রুমে পরিণত করেছিলেন কিনা! শেষ সিঙ্গাপুরযাত্রার সময় বলে গিয়েছিলেন কিনা, ওরে, আমার লোকগুলোকে দেখিস, ওদের যেন যত্ন-আত্তির ত্রুটি না হয়।
হে মিডিয়া মানুষ, একজন মানী লোকের মানহানি ঘটালে মূল সরকার প্রধানকে বিব্রত করা যায়, এমন প্রকল্প সবার যে ছিলো তা নয়। এমন প্রকল্প ছিলো কারো কারো। বাকীরা ভেসেছেন মিডিয়া-চমকের স্রোতে। রাজনীতিবিদদের হেয় করার মুফতে সুযোগ নিয়েছেন অনেক আমোদিত হয়ে। কোন অসাধারণ মানুষকে সামান্য ত্রুটির জন্য কি কঠিন, কি মারাত্মক মিডিয়া ট্রায়ালে মিডিয়া শাস্তিতে একশেষ করে দিলেন! যে হাওরের বাউল সন্তান পাঁচ হাজারের বেশি গানের প্রতিটি কলি মুখস্ত জানতেন, একসময় সুরেলা কণ্ঠে তা পরিবেশনও করতেন, পড়ন্ত বেলায় ভাঙ্গা গলায় ভাঙ্গা সুরেও গাইতেন, সেই মানুষটিকে আমরা না জেনে না শুনে না বুঝে এমনভাবে ‘গ্রিল’ করলাম?
তিনি তিনবার পৌরসভায় প্রধান পদে বিপুল জনসমর্থনে জিতে আসা মানুষটি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীকে নির্বাচনে হারানো মানুষটি, ‘মৌলভীবাজার-বন্ধু’ বললে এতটুকু কম বলা হয়না যাকে, আমরা এমন মিডিয়া-ট্রায়ালে মিডিয়া-অবমাননায় মিডিয়া শাস্তি কেমন করে দিলাম?
১৯৮৯ সনের সেপ্টেম্বরে যুব ইউনিয়নের সিমিটার বিরোধী ঢাকা-সিলেট পদযাত্রায় যখন মৌলভীবাজার উপস্থিত হয়েছিলাম, এই সৈয়দ মোহসিন আলী পৌরসভার দরজা খুলে দিয়েছিলেন তার অফিসের ল্যান্ড টেলিফোনে ঢাকা-সিলেটে নানারূপ যোগাযোগের জন্য। এরশাদ সরকারের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে।
এহেন জনপ্রতিনিধিকে যারা মিডিয়া মানহানি করেছেন, একযোগে ক্ষমা চান কি না চান, দয়া করে তাঁর অসাধারণ জনসেবার ন্যূনতম দশটি এপিসোড প্রচার করে নৈতিক কাফ্ফারা দিন। ভবিষ্যতেও কাউকে নিয়ে কিছু বলার আগে ভেবে চিন্তে বুঝে শুনে করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করুন।
এতো কিছুর মাঝে নীতিবান যে সব সাংবাদিক নীরবে নিঃশব্দে স্রোতের বিপরীতে কাজ করে চলেছেন তাদের সালাম জানাই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)