সমাজে বাড়তে থাকা হিংসা, ঘৃণা, লোভ আর অসহিষ্ণুতার হাজারো গল্পের ভিড়ে মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও সহযোগিতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে একটি দেয়াল। যার নাম ‘মহানুভবতার দেয়াল’।
সে এক ছোট্ট স্কুল। চারপাশে শিশুদের কোলাহলে মুখর। স্কুলের আঙিনায় ঢুকে একটু এগিয়ে হাতের ডান পাশে চোখে পড়ে একটি দেয়াল। অন্য দেয়াল থেকে একটু ভিন্ন। এর বামপাশে লেখা ‘তোমার যা প্রয়োজন নেই তা এখানে রেখে যাও’, আর ডানপাশে আরেকটি লেখা, ‘তোমার দরকারি জিনিস পেলে নিয়ে যাও’। এই দুইপাশ ছাড়াও উপরে লেখা ‘মহানুভবতার দেয়াল’।
শুধু এমন লেখাই নয়, সেখানে দেখা গেল ছোট ছোট শিশুদের পোশাক ঝুলছে। রয়েছে স্কেল, পেন্সিল, প্রসাধন সামগ্রী, জুতোসহ নিত্য প্রয়োজনীয় নানান উপকরণ।
এই দৃশ্য কিশোরগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার মকসুদপুর গ্রামের দক্ষিণ মকসুদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তানজিনা নাজনিন মিষ্টির উদ্যোগে গত ৭ আগস্ট তৈরি হয় এই ‘মহানুভবতার দেয়াল’।
এ দেয়ালকে ঘিরে শিশুদের উৎসাহ-উদ্দীপনার যেনো শেষ নেই। মাত্র পাঁচ দিনেই ছোট্ট এ শিশুদের মাঝে সাড়া ফেলেছে দেয়ালটি। ভিন্নধর্মী এ উদ্যোগ এরই মধ্যে প্রশংসা কুড়িয়েছে এলাকার মানুষের।
‘মহানুভবতার দেয়াল’ সম্পর্কে জানতে চাইলে তানজিনা নাজনিন মিষ্টি জানান: কিছুদিন আগে ন্যাশনাল একাডেমি ফর প্রাইমারি এডুকেশনের একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে এর ধারণা পান। এরপর বিদ্যালয়ে ফিরে অন্য শিক্ষকদেরকে পরিকল্পনার কথা জানালে সবার সম্মতিতে শুরু হয় এর কাজ।
প্রথম শুরু করেছিলেন নিজের পরিবারের সদস্যদের পোশাক দিয়ে। তার দেখাদেখি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও উৎসাহিত হয়। নিয়ে আসে তাদের অব্যবহার্য পোশাক ও জিনিসপত্র।
চ্যানেল আই অনলাইন-কে তানজিনা নাজনিন বলেন, ‘বাচ্চারা তাদের অব্যবহৃত জিনিস এখানে রাখছে, অন্যরা নিচ্ছে। আমাদের যা প্রয়োজন নেই ফেলে দিই। আমাদের যা প্রয়োজন নেই তা ফেলে না দিয়ে অন্যদের উপকারে আসছে সেই জিনিসগুলো।
‘এ উদ্যোগে বাচ্চাদের কাছ থেকে এতোটা সাড়া পাবো, তা বুঝতে পারিনি। বাচ্চাদের বুঝিয়েছিলাম আমার না থাকলে বা কোনো কিছু লাগলে আমিও সেখান থেকে নেবো। শুধু আমি না আমার সহকর্মী যারা অাছেন তারাও নিয়ে আসছেন বিভিন্ন জিনিসপত্র।’
শিশুদের মাঝে সহানুভূতি, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা, মানবতাবোধ জাগ্রত করতে প্রধান শিক্ষিকার এমন উদ্যোগ।
বাচ্চারা এখন প্রায় প্রতিদিনই নিজেদের অব্যবহৃত জিনিসপত্র বাড়ি থেকে এনে সেখানে রাখছে এবং নিজের যা প্রয়োজন তা নিঃসংকোচে নিয়ে যাচ্ছে।
নুসরাত জাহান সীমা নামের পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী চ্যানেল আই অনলাইন-কে বলে, ‘আমার অনেক ভালো লাগছে, আমিও একটি জামা রেখেছি এখানে। আমি রেখে গেছি, যার দরকার হয়েছে সে নিয়ে গেছে। আমি একটি জামা নিয়েছি এখান থেকে। জামাটা অনেক সুন্দর। আমরা বন্ধুরা সবাই এটা অনেক পছন্দ করছি।’
চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া নাজিয়া মুন্নির কথা, ‘আমার অনেক ভালো লাগছে ওই দেয়ালটাকে। তবে ওখানে আমি এখনো কিছু রাখতে পারিনি। কালকে একটি জামা রাখবো।’
বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মো: রহমতউল্লাহ বলেন: ‘অামি নিজের হাতে দেয়ালে লিখেছি। বাচ্চারা এতে খুব মজা পাচ্ছে। জিনিস রাখছে আবার যেটা পছন্দ হচ্ছে নিয়ে যাচ্ছে।’
‘আমরা যে এলাকায় আছি তার প্রায় ৭০ শতাংশ ছেলে-মেয়ে নিম্নবিত্ত পরিবারের। এতে করে বাচ্চাদের মধ্যে পারস্পরিক সহানুভূতির সৃষ্টি হচ্ছে। তারা মিতব্যয়ীও হচ্ছে। কাপড়গুলো ফেলে না দিয়ে নিয়ে আসছে। অন্য বাচ্চারা তা নিয়ে যাচ্ছে। এতে করে পারস্পরিক ভালবাসা ও সহানুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে তাদের মধ্যে। এর মাধ্যমে একে অপরকে সহযোগিতা করতে শিখছে তারা।’