“মেথ” জীবন-বিধ্বংসী মাদক। মারণাস্ত্র যেন! এশিয়ায় মেথ-এর মুল উৎপাদক বার্মা। ব্যবসায় জড়িত বার্মার সেনাবাহিনীও। এই নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি আছে। ডকুমেন্টারিটির আলোচনায় সাইটটি শিরোনাম করেছে— How Asia’s meth is made (with the help of Myanmar’s military)। ভিক্ষুদের একাংশও মেথ ব্যবসায় নেমেছে। খবরের এমন শিরোনাম হয়েছে ‘Buddhist Monk Caught Hiding 4 Million Methamphetamine Pills in His Monastery’। দ্রুততম বিপণন হচ্ছে বিশ্ববাজারে। বার্মার খোপে ঘুপচিতে জন্ম নিচ্ছে মেথ কার্টেলরা। কলম্বিয়া-মেক্সিকো-ব্রাজিলের হেরোইন-কোকেইননির্ভর ড্রাগ কার্টেলদেরও আগে মেথ ব্যবসায় নেমেছে বার্মার মেথ কার্টেলরা।
“মেথ” শব্দটি মেথাম্ফিটামিন নামক তীব্র বেদনানাশক ড্রাগ-এর সংক্ষিপ্ত মনে করা হলেও মাদক বাজারের ‘মেথ’ ভিন্ন জিনিস। এটি মেথাম্ফিটামিন-এর সঙ্গে তীব্র নেশা সৃষ্টিকারী নানা রকমের প্রাণঘাতি রাসায়নিক এর মিশ্রণ। যেমন ফ্যান্টানিল। ফ্যান্টানিল ড্রাগটি সেবন করে কানাডায় প্রতিদিন সাত-আটজন করে মরছে। কানাডার কেন্দ্রীয় সরকার সহসাই একে জনস্বাস্থ্য দূর্যোগ ঘোষণা করবে শোনা যাচ্ছে। বার্মিজ মেথ চীন ঘুরে ভিন্ন ভিন্ন নামে দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে আমেরিকা-ইউরোপের চোরাবাজারে।
পেরুর কোকেইন, আফগান হেরোইন এবং গোল্ডেন ট্রায়াংগল-এর পপি চাষ মেথ এর কাছে নস্যি। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিভাগ (UNODC) গোল্ডেন ট্রায়াংগল-এর পপি উৎপাদনের হিসাবটি ধরে বার্মাকে এশিয়ায় দ্বিতীয় বৃহত্তম আফিম উৎপাদক রাষ্ট্র বলছে। ফিলিপাইন তো বটেই হংকং, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনাম ছাড়িয়ে খোদ চীনেও (প্রাথমিক কাঁচামাল, রসদ-উপকরণ-রসায়নিক চীন হতেই আসে যদিও) মেথ তার থাবা বিস্তার করে বসেছে। বাংলাদেশে পরিচিত ইয়াবায়ও ১০-২০ ভাগ মেথ মিশানো থাকে।
আমেরিকার ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি ইউএসডিএকে মেক্সিকোর আদলে বার্মায়ও কার্যালয় নিতে হয়েছে। উপরে উপরে মিলিটারি মাদক দমনের কথা বলে। কিন্তু পাবলিক রেডিও ইন্টারন্যাশনাল (পিআরআই) ও গ্লোবালপোস্ট-এর নয় মাসের দীর্ঘ অনুসন্ধানে বার্মিজ মিলিটারির মাদক ব্যবসায় সংশ্রব ধরা পড়ে। শান, কোকাং, কারেনসহ বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে দমনের নামে সামরিক বাহিনী স্থানীয়ভাবে অনেকগুলো মধ্যসত্বভোগী মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করে। এইসব মিলিশিয়ারা ‘নার্কো-মিলিশিয়া’ বা মাদক-মিলিশিয়া নামেই পরিচিত।
নৃশংস নার্কো-মিলিশিয়াদের মূল কাজ যত্রতত্র বিদ্রোহীদের কচুকাটা করে সেনাবাহিনীর পরিশ্রম কমিয়ে দেয়া, মিলিটারির দেয়া নিরাপত্তা-ছায়ার সুবিধা নিয়ে মাদক ব্যবসা করা, মাদকের টাকায় ভারি অস্ত্রশস্ত্র কেনা এবং সেনাবাহিনীর উপর তলার ক্ষমতাবানদের ভাগ-বখরা পৌঁছে দেয়া। এ সম্পর্কে পিআরআই’র রিপোর্টে লেখা হয়েছে—“… a nine-month GlobalPost investigation reveals that the government is quietly fueling the underground narcotics trade. Some of the trade’s new key players are, in fact, militias created by the army itself….These narco-militias have emerged as a cheap solution to the army’s biggest challenge: defeating guerrilla rebels in the hills.” (সূত্রঃ https://www.pri.org/stories/2015-11-12/myanmar-s-state-backed-militias-are-flooding-asia-meth) পাঠক এই লিংকের অডিও পডক্যাস্ট ও ভিডিও ক্লিপটি দেখলেও বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা পাবেন। ফ্যান্টানিল বিষয়ে কানাডার সিবিসি রেডিওর পডক্যাস্ট শোনা যাবে এবং ডকুমেন্টারি ভিডিও দেখা যাবে http://www.cbc.ca/news/canada/british-columbia/topic/Tag/fentanyl এবং http://www.cbc.ca/firsthand/episodes/unstoppable-the-fentanyl-epidemic সাইট দুইটিতে।
রমরমা অস্ত্র ব্যবসা, রাষ্ট্রীয় অর্থ পাচার (মানি লন্ডারিং) ও হানাহানি রক্তপাত টিকিয়ে রাখা মাদক-ব্যবসার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। পল গোল্ডস্টেইন ১৯৮৫ সালে তার লেখা ‘The Drugs/Violence Nexus: A Tripartite Conceptual Framework’ প্রবন্ধে ড্রাগ ও অস্ত্রের মেলবন্ধন দেখান। তিনি ছাড়া আরো অসংখ্য গবেষকের গবেষণায়ও প্রমানিত হওয়া অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কটি নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ নাই। এই সত্যটির স্বীকৃতি দিয়েই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১৯৯৫ সালে ৫০/১৪৮ সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়। ২০০১ সাল হতে ২০০৫ সাল পর্যন্ত পরপর পাঁচটি বছরই একই সত্য পূনরুচ্চারিত হয় ৫৬/২৪(৫), ৫৭/৭২, ৫৮/২৪১ ও ৬০/৫১৯ লেবেলের গৃহিত সিদ্ধান্তগুলোতে।
বার্মার সেনাবাহিনীই শুধু নয়— কলম্বিয়া, মেক্সিকো, পেরু, ফিলিপাইনসহ অনেক দেশের সেনাবাহিনীই মাদক নিয়ন্ত্রণের ছুতায় অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধবিমান-যুদ্ধজাহাজ ইত্যাদির কেনাকাটা যুক্তিসিদ্ধ করে। কার্টেলরা অস্ত্রসম্ভারে নিজেদের সুসজ্জিত রাখতে গিয়ে মিনি ক্যান্টনমেন্ট গড়ে তোলে। তাদের অস্ত্র কিনতেই হয় অন্য কার্টেলদের সঙ্গে মাদক বাণিজ্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বাজার দখলের যুদ্ধে টিকে থাকার প্রয়োজনে। বার্মা যে ইতোমধ্যে এশিয়ার মেডেলিন হয়ে বসেছে তাতে রাশিয়া, চীন ও ভারতের অস্ত্র বিক্রির বাজারটিই বেড়েছে।
বার্মার রোহিঙ্গা নিধনের নানামুখি আলোচনা থাকলেও বার্মার মাদক-সাম্রাজ্য হয়ে উঠা বাংলাদেশের জন্য কী কী বিপদ বয়ে আনতে পারে সংক্রান্ত আলোচনা পত্র-পত্রিকা বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একেবারেই অনুপস্থিত। বাংলাদেশে নতুন পয়সাওয়ালার সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে মেথ বাংলাদেশে আঘাত হেনে বসতে পারে যে কোনো মূহূর্তে। হয়ত অগোচরে বাজার তৈরিই আছে। ইয়াবার ঝাঁকুনিটি সহ্য করা গেলেও বাংলাদেশের পক্ষে মেথ-ঝড় মোকাবেলা মোটেই সহজ হবে না। সবচেয়ে বড় আশঙ্কা এই যে বার্মার মাদক কার্টেলরা বাংলাদেশকে মেথ-রুট বা মেথ-ট্রানজিট রূপে ব্যবহার শুরু করতে পারে। সে’রকমটি হলে বার্মা বাংলাদেশের জন্য আঞ্চলিক নরককুণ্ডের খোলা দুয়ার হয়ে উঠবে। রোহিঙ্গা বিষয়ক ডামাডোলে বাংলাদেশের ব্যস্ততা ও অমনোযোগিতার সুযোগে কার্টেলরা যে জাল বিস্তার করছে না তারই বা নিশ্চয়তা কী?
আমেরিকার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র ফ্যাক্টবুক কিন্তু জানাচ্ছে যে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই মাদক চোরাচালানের ট্রানজিট হয়ে গেছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)