মাটি ছাড়া কি গাছ হয়? এমন প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকাবে অনেকেই। সেও কি সম্ভব? কিন্তু আজকের বিজ্ঞান যেন শোনাচ্ছে অন্য গল্প। বলছে মাটি ছাড়া মাত্র দুই-একটি গাছ নয়, রীতিমত বাণিজ্যিক কৃষিও সম্ভব। গাছ উৎপাদন করতে মাটির ভেতরের যে উপাদান দরকার হয়, তা পাওয়া যেতে পারে মাটি ছাড়াও অন্য উৎস থেকে। এর আগে যেমন আমরা দেখেছি জাপানের পাসোনা টু’ নামের প্রতিষ্ঠানটির হাইড্রোপনিক এগ্রিকালচার। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটেও দেখেছি হাইড্রোপনিক কৃষির সফল ব্যবহার। প্রথম দিকে মনে হয়েছে স্বল্প পরিসরে উচ্চালিভাস বা সৌখিনতাবশত এই কৃষিকাজ করা যেতে পারে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের মরুময় দেশ কাতার সে ধারণা পাল্টে দিয়েছে। প্রমাণ করেছে মরুভূমির উত্তপ্ত কাঁকর আর বালুর মধ্যেও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মাটিবিহীন কৃষি পথ দেখাতে পারে নিশ্চিত সাফল্যের।
পারস্য উপসাগরের মরুময় দেশ কাতার। এখানে প্রাকৃতিক কোনো জলাশয় নেই এবং প্রাণী ও উদ্ভিদের সংখ্যাও যৎসামান্য। বর্তমানে মাথাপিছু আয়ের হিসেবে কাতার বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলির একটি।
শত বছর আগে মরু বেদুইন থাকলেও এখন শতভাগ কাতারি-ই ধনী। তারা নিজের দেশটিকে সাজাচ্ছেন স্বপ্নের মতো করে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলার পাশাপাশি বিরান মরুভূমিকেই গড়ে তুলতে চাইছেন সম্ভাবনা ও সমৃদ্ধির এক অনন্য ক্ষেত্র।
কৃষিপণ্যের চাহিদা মেটাতে কাতার সবসময় আমদানি নির্ভর। অর্থের সংকট নেই বলে সেটা বড় কোনো সমস্যা নয়। তবু নিজের দেশেই খাবার উৎপাদন এবং তা মজুদের যে কোনো বিকল্প নেই তা সবারই জানা। সাধারণ কাতারিরা এই সত্যটি না বুঝলেও কাতারের উন্নয়নের এক নায়ক ও সুলাইতিন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ সালেম আল সুলাইতিন এবং মধ্যপ্রাচ্যের প্রখ্যাত উদ্যানতত্ববিদ ও কৃষি বিশেষজ্ঞ ড. আহমেদ তৌফিক মুস্তাফা তা অনেক আগেই উপলব্ধি করেছেন। তাই সালেম আল সুলাইতিন মরুভূমিতেই গড়ে তুলেছেন বিশাল কৃষি খামার। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে কাতারের অন্যতম বৃহৎ কৃষি খামার আল ফারদান ফার্মেও হচ্ছে কৃষিপণ্য চাষ।
কোন চিন্তা থেকে এই ধরনের খামারের পরিকল্পনা? সেই প্রশ্ন রেখেছিলাম সুলাইতিনের কাছে।
তিনি বলেন, সময়ের প্রয়োজনেই এমন একটি খামারের উদ্যোগ নিয়েছিলাম ২০ বছর আগে। কৃষি কিন্তু খুব সহজ কিছু নয়। অনেক বাধা মোকাবিলা করে কেউ যদি কৃষিতে আসে, তাহলে তার দেখাদেখি অন্যরা সাহস করে এগিয়ে আসতে পারে। এখন কৃষিতে অনেক নতুন নতুন প্রযুক্তি ও কৌশল এসেছে। সেসব কাজে লাগাতে পারলেই সাফল্যের নিশ্চয়তা আসবে।
এমন কৃষি খামার করার ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতার প্রশ্নে সুলাইতিন জানান, বিশেষ করে কাতার ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সহযেগিতা পাচ্ছি, কিন্তু সহযোগিতা বা পৃষ্ঠপোষকতা আরো অনেক বেশি দরকার।
সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও পদ্ধতি ব্যবহৃত সুলাইতিনের খামার বছরে ৭০০ মেট্রিক টন ফল ও সবজি উৎপাদন করে। অন্য যেকোনো দেশের জন্য এটি তেমন কোনো তথ্য না হলেও এই কাতারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত ও ব্যয়বহুল কৃষি উদ্যোগের বিবেচনায় বিশাল এক দৃষ্টান্ত।
সুলাইতিনের খামারে রয়েছে মুক্তমাঠ ও গ্রীন হাউস, রয়েছে সৌখিন বা অর্ণামেন্টাল গাছ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র, কাতারের জলবায়ুতে সবজি ও ফল উৎপাদনের বেশ কিছু সংখ্যক গবেষণা ক্ষেত্র, বীজ ও চারা উৎপাদন কেন্দ্র, শহরের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ফুল ও সৌখিন গাছ উৎপাদন, বর্ধন ও বাজারজাত ব্যবস্থা, সবজি ও ফলের প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র, কম্পোস্ট সেন্টার এবং হরিণ-ভেড়াসহ নানান প্রাণীর খামার। এই মডেল ও পরিকল্পনার প্রতিটি অংশ গত প্রায় দুই যুগ ধরে বাস্তবায়ন হচ্ছে।
কী কী প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে এই খামারে। সেই কথা বলছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের প্রখ্যাত উদ্যানতত্ববিদ ও কৃষি বিশেষজ্ঞ ড. আহমেদ তৌফিক মুস্তাফা।
গোটা কাতারে মোট ১ হাজার ২’শ ৬০টি কৃষি খামার রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ২০০টি খামার উৎপাদিত কৃষিপণ্য নিজেদের চাহিদা পূরণের পর বাইরে বিক্রি করতে পারে।
সুলাইতিনের খামারে গ্রীন হাউসের রয়েছে ৫টি গ্রুপ। প্রতিটি গ্রুপে গ্রীন হাউস ৬টি করে। অর্থাৎ এমন প্রশ্বস্ত নিয়ন্ত্রিত আবাদ রয়েছে ৩০টি। যেগুলো প্রস্থে ২৮ মিটার ও দৈর্ঘে ১৪৪ মিটার। আর এই গ্রীন হাউসগুলোতে উৎপাদিত হচ্ছে বিভিন্ন রঙের ক্যাপসিক্যাম, স্ট্রবেরি, পাঁচ জাতের তিন রঙের চেরি টমেটো, বাঁধাকপি, ব্রকলিসহ নানা রকমের সবজি ও ফল।
সম্পূর্ণ ভূগর্ভস্থ নোনাপানিকে মিষ্টি পানিতে পরিণত করে গ্রীন হাউজগুলোতে ব্যবহার হয়। সবচেয়ে বড় তথ্যটি হচ্ছে, এখানে বিশেষ ব্যবস্থায় প্রায় ৭০ ভাগ পানি ও মিশ্রিত তরল সার পূন:ব্যবহার হয়। নোনাপানিকে মিষ্টি পানিতে রূপান্তরের পর সেটি ওয়াটার কন্ট্রোলরুমেই ওই পানিতে সব ধরনের পুষ্টি উপাদান যোগ করা হয়। পরে প্রতিটি গাছের গোঁড়ায় একটি চিকন পাইপের মধ্যে দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা করে পানি পড়ে। গাছ তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করে পানি নির্গমন করে দেয়। সেই পানিতে আবারো পুষ্টি উপাদান যোগ করা হয়। এবং সেটাই আবার গাছে দেওয়া হয়।
বিজ্ঞানীদের বিবেচনায় মাটিবিহীন হাইড্রোপনিক পদ্ধতির চাষের সুবিধা হচ্ছে :
পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার ও পূন:ব্যবহার করা যায়।
স্বল্পমেয়াদী শস্যাবর্তন। একটি মৌসুমে একাধিক ফসল আবাদ করা যায়।
ক্ষতিগ্রস্ত বিষাক্ত অথবা কাঁকরপূর্ণ যেকোনো স্থানেই উৎকৃষ্ট মানের ফসল উৎপাদনের নিশ্চয়তা।
এতে শ্রম ব্যয় কমিয়ে আনা যায় অর্ধেক।
শ্রমিক ও কর্মীরা যেকোনো পোশাকে যেকোনোভাবে কাজটি করতে পারে। পাঠক, এখানে বলে রাখি, নতুন প্রজন্মকে কৃষির প্রতি আগ্রহী করতে এমন কৃষিপ্রকল্পগুলো খুবই কার্যকরী। কারণ অভিজাত পোশাকেও এখোনে কাজ করা যাবে। এবং কোনো হাতের স্পর্শ ছাড়াই হবে কৃষিকাজ ও কৃষিপণ্য সংগ্রহ। তাই নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে স্বল্পমূল্যে এই প্রযুক্তি সম্প্রসারণের বিষয়ে।
পানি ও মাটির পুষ্টিগুণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
সুলাইতিনের খামারের অবকাঠামো অত্যন্ত পরিকল্পিত। সবকিছু নকশামাফিক।
সুলাইতিনের বিশাল খামার সব আয়োজনই গবেষণা লব্ধ ও বিজ্ঞান নির্ভর। এক্ষেত্রে এখানে কি একটি রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার গড়ে তুলতে চান সুলাইতিন?
বলেন, সেটার কাজও শুরু হয়ে গেছে। যেটি হবে বেসরকারি পর্যায়ে কাতারে সবচেয়ে বড় ও প্রথম।
১২ টি দেশের ৪০০ দক্ষ কর্মী কাজ করছেন এই খামারটিতে। এর মধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশী রয়েছেন ৬০ থেকে ৭০ জন। কথা হয় তাদের সঙ্গেও।
চট্টগ্রামের মীর হোসেন বলেন, ১৯৯২ সাল থেকে কাজ করছি এখানে। নিজের হাতেই সব গড়েছি। আমার দুই ছেলেকেও এনেছি। গ্রামে জায়গা জমি বাড়ি ঘর ভালোই আছে।
আধুনিক ও অগ্রগামী কৃষির দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অনুসরণ করা হচ্ছে সুলাইতিনের খামারে। প্রথমটি হচ্ছে মাটিবিহীন কৃষি। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ভার্টিকাল এক্সপানশন অর্থাৎ পাশে নয় ওপরের দিকে আবাদের বিস্তার।
এভাবেই একসময় পুরো কাতার কৃষিপণ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যাবে বলেই বিশ্বাস করেন খামারিরা।