চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘মাইনাস টু’র প্রেক্ষাপট মাহফুজ আনামরা তৈরি করেননি

ওয়ান ইলেভেনের সরকারের সময় ডিজিএফআই’র সরবরাহ করা শেখ সেলিমের বক্তব্য ছাপার বিষয়ে আলোড়ন হচ্ছে। ডেইলি স্টারের সম্পাদক, সাংবাদিকতার প্রতিষ্ঠানতুল্য ব্যক্তিত্ব মাহফুজ আনাম বলেছেন, ‘এ সংবাদ ছাপিয়ে তিনি ভুল করেছেন।’ এর জেরে বিভিন্ন পর্যায় থেকে তাকে গ্রেফতারের দাবি উঠছে।

আমাদেরকে স্বীকার করতেই হবে, ওয়ান ইলেভেনের মতো একটা পরিস্থিতি তখন দরকার ছিলো। না হয় ‘ইয়েস উদ্দিন’দের কমিশন কিন্তু ঠিকই বিএনপি, জামায়াতকে ক্ষমতায় নিয়ে আসতো ভোটের নাটক করে। তাদের সেই প্ল্যানের কারণেই নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে দিনের পর দিন আন্দোলন হয়েছে রাজপথে। সেই আন্দোলনের কারণেই কিন্তু এক পর্যায়ে এসেছিলো ওয়ান ইলেভেন। যেটা এখনকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তখন স্বীকারও করেছিলেন। তাদেরকে সমর্থন করে সেই সরকারের শপথ অনুষ্ঠানেও গিয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু বিধিবাম। জনগণের এ সমর্থনের সম্মান রাখতে পারেননি ফখরুদ্দিনরা। তাদের মাথায় চেপে বসেছিলো ক্ষমতার লোভ। ভালো ভালো কথা বলে জনগণের সেন্টিমেন্ট তাদের দিকে নেয়ার কারণে ক্ষমতা হারানো বিএনপি, জামায়াতের জোট ছাড়া সবাই সমর্থন করেছিলো তাদেরকে। কিন্তু এক পর্যায়ে তারা রাজনীতি থেকে দুই নেত্রীকে সরানোর জন্য গ্রেফতার করেন। গ্রেফতারের আগে তাদের দলের নেতাকর্মীদের দিয়ে দুর্নীতির রসালো গল্প স্বীকার করানো হয়। ডিজিএফআই সেই সংবাদ সরবরাহ করেছিলো মিডিয়ায়। নূরুল কবিরের নিউ এজ পত্রিকা ছাড়া সেই সংবাদ ছেপেছে সব পত্রিকা।

যদিও এখন কিছু অনলাইন পত্রিকা দাবি করে তারা সে খবর ছাপেনি। কিন্তু বাস্তবতা হলো – আরো বছর দশেক আগে অনলাইন পত্রিকা মানুষ হিসাবেই ধরতো না। সামরিক গোয়েন্দাবাহিনী তখনকার এসব অখ্যাত অনলাইনকে পাত্তাই দিত না। আর যে সংবাদপত্র যতো বেশি জনপ্রিয় ছিলো, তাদের ওপর ডিজিএফআই’র চাপ বেশি থাকে। সুতরাং সেই সংবাদ কোনো ইন্টারনেট ভিত্তিক পত্রিকার ছাপার প্রশ্নই আসে না।

সেই সময়ে আবার ‘মুখরোচক এ চোথা সংবাদ’ কিন্তু পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর জন্য, সেনা সরকারের আনুকূল্য পাওয়ার আশায় দেশের প্রায় সব গণমাধ্যম রীতিমত প্রতিযোগিতা করে প্রকাশ করেছে! পুরোটা সময় ওয়ান ইলেভেনের সরকারের পা চেটেছে। রাষ্ট্রের টাকা নিজেদের পকেটে ভরানোর জন্য দুর্নীতি বিরোধী বিজ্ঞাপনের নামে সারাক্ষণ ‘দুদক, দুদক’ করেছেন, র‌্যালির আয়োজন করে মিডিয়া কাভারেজ দিয়েছেন।

তারাই আজ ওয়ান ইলেভেনের ‘ঘোর বিরোধী’! শেখ হাসিনার ‘বড় আপনজন’! আসলে এরা সময়ের সঙ্গে ভোল পাল্টতে ওস্তাদ। শেখ হাসিনা এটা ভালো করেই বোঝেন। আজ মাহফুজ আনামকে আক্রমণ করলেই গণভবনের ডাক পড়বে এটা ভুল ধারণা। কারণ, মাহফুজ আনামকে শেখ হাসিনা আজ থেকে না, জীবনের প্রায় শুরু থেকেই পারিবারিকভাবে চেনেন।

শেখ সেলিম, এখনকার মাননীয় সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরদের মতো বাঘা রাজনীতিবিদদের সেই সময়ের বক্তব্যের ভিডিও ফুটেজ এখনো সার্চ দিলেই ইউটিউবে পাওয়া যায়। তারা কিন্তু ঠিকই সরকারে আছেন। কারণ, শেখ হাসিনা বোঝেন, তাদের জীবন হুমকির মুখে ছিলো। তারা আসলে বাধ্য হয়েছেন এসব মিথ্যা বলতে। আর তাদের বক্তব্যগুলোই কিন্তু অন্যান্য পত্রিকার মতো ছেপেছিলো ডেইলি স্টার।

যদিও এমন নিউজ ছাপানো উচিত না। তবে এ নিউজ ছাপানোয় মানুষ বুঝতে পেরেছিলো ওয়ান ইলেভেনের কুশীলবদের আসল উদ্দেশ্য। আর শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের পরেই কিন্তু ওয়ান ইলেভেনের সরকারের থেকে মানুষ তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করেছিলো।

সামরিকসহ সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রেসনোট ছাপানোর ক্ষেত্রে স্বাধীনতার সময়কালের দিকে তাকালে বিষয়টা আরো ক্লিয়ার হবে। এ বিষয়ে এ বি এম মুসা স্যারের একটা অভিজ্ঞতা ছিলো এমন, ‘পাকি সরকার বাঙ্গালির মনোবল ভাঙ্গতে প্রেসনোট পাঠাতো বিভিন্ন পত্রিকার অফিসে। প্রেসনোট না ছাপলে পত্রিকা বন্ধ, সাংবাদিক খুন। এ সময় তারা ভাবলেন খবর ছাপাবেন, কিন্তু ওপরের লাইনে লেখা থাকবে সরকারের প্রেসনোট শব্দটি।’ এতে সব কূলই রক্ষা হয়েছে। প্রেসনোটও ছাপা, জীবনও রক্ষা, আর মানুষের যা বোঝার তা ঠিকই বুঝেছে।

ডেইলি স্টারও কিন্তু ঠিক এ কাজটি করেছে। টকশোতে তিনি এটাও বলেছেন, আমরা যে সংবাদটি শতভাগ প্রমাণ করতে পারিনি, প্রতিবেদনে সেটাও ছিলো। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তখন দেশের অনেক গণমাধ্যম এ নৈতিকতাটাও দেখায়নি।

এখন কেউ স্বীকার করুক আর না করুক এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, ওয়ান ইলেভেন, বা শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের প্রেক্ষাপটটা মাহফুজ আনামরা তৈরি করেননি। এটা ওয়ান ইলেভেনের সরকারেরই পরিকল্পনা ছিলো। তাই তারা শেখ সেলিমদের থেকে এসব কথা আদায় করেছেন। কিন্তু এমন কোনো প্রতিবেদন, সম্পাদকীয় তারা ছাপেননি, যাতে শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের আহ্বান জানানো হয়েছিলো।

তাহলে মাহফুজ আনাম কীভাবে শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের ক্ষেত্র প্রস্তুত করলেন, ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ করলেন? আর রাষ্ট্রদোহিতার সংজ্ঞাই বা কী? তারপরেও মাহফুজ আনাম ভুল স্বীকার করেছেন। কারণ, পলিসি বেইজড পত্রিকা চালাতে গেলে পলিসিতে ভুল হতেই পারে। কপি-পেস্ট নির্ভর অনলাইনের পলিসি বলতে কিছু নেই।

তখনকার সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দেয়া খবর সবাই ছাপলেও কেউ কখনো ক্ষমা চায়নি! চাইবেও না কখনো, কেউ তাদেরকে ক্ষমা চাওয়ার জন্য বলবেও না কোনোদিন। যদিও ওয়ান ইলেভেনের সময়কার ছাত্র আন্দোলনে সেনা সদস্যকে লাথি মারার সেই ঐতিহাসিক ছবিটি প্রকাশ করার সাহস ডেইলি স্টার ছাড়া আর কারো হয়নি।

মাহফুজ আনামরা সাংবাদিকতার প্রতিষ্ঠানতুল্য বলেই নিজের ভুল স্বীকারে কপটতা করেন না। কপটতা নেই বলেই ভয় পাননি ছাত্র আন্দোলনে সেনা সদস্যকে লাথি মারার ছবি ছাপতে। এমন কী যারা নিজেদেরকে ‘হনু’ ভাবেন, টকশোর ড্রেসকোডটা শিখতে হলেও তাদেরকে শেষ পর্যন্ত মাহফুজ আনামের কাছেই যেতে হবে।

আরেকটা বিষয় হলো, ওয়ান ইলেভেনের সফলতা যে নেই তা কিন্তু না। এর অনেক সফলতা আছে। এর মধ্যে একটা বড় সফলতা ছবিযুক্ত একটা অসাধারণ ভোটার তালিকা। ভোট চুরি রোধে জনগণের যে দাবিটা শেখ হাসিনা করে আসছিলেন। এর জন্য সেনাবাহিনী অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।

যারা আজকে মাহফুজ আনামকে গালিগালাজ করছেন, সাংবাদিকতার ‘এথিকস’ শেখাচ্ছেন, তারা কেউ কিন্তু ডিজিএফআই’র বিরুদ্ধে কিছু বলছেন না! ওয়ান ইলেভেনের সরকারের সেটাপ করা যে সেনা কর্মকর্তারা এখনো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন, তাদেরকে ক্যান্টনমেন্টে ফেরানোর দাবিতো দুই আমলেও দেখা যায়নি! তাদের থেকে সেই ‘মুরোদ’ আশা করাটাও অবশ্য বোকামি। কারণ, তারা সবসময়ই সুবিধাবাদের দিকেই ঝোঁকেন!

আল্লাহ না করুক, শেখ হাসিনার আজ কিছু হলে সঙ্গে সঙ্গে ভোল পাল্টাতে দ্বিধা করবে না এরা। এই আশায়ই তারা বিএনপি, জামায়াতকে সেইফ এক্সিট দিচ্ছে, যাতে তারাও বলতে পারে আমরা দুর্নীতি করিনি! আমাদের বিরুদ্ধে কেনো নিউজ ছাপা হয়েছে? তখন এরাই বিএনপি, জামায়াতকে বোঝাবে শেখ হাসিনা সংসদে দাড়িয়ে ‘স্লো পয়জনিং’ এর মতো মারাত্মক অভিযোগ করলেও আমরা তো ‘হত্যাচেষ্টাকারীদের’ বিচার চাইনি আপনার খাস লোক হওয়ায়!

তাই বলবো, মাহফুজ আনামদের ভুলের পেছনে দৌঁড় না দিয়ে আয়নায় নিজের চেহারা দেখুন। সম্মানিতদের সম্মান দিতে শিখুন। পেশা যেটাই হোক না কেনো, কারো দালালি না করে নিজের কাজটা ঠিকভাবে করুন। এতে মঙ্গল নিজেরই, সঙ্গে দেশেরও।

আলোচিত সেই টকশোর ভিডিও দেখুন এখানে:

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)