‘শবে কদর’ ফার্সি শব্দ। শব অর্থ রাত এবং কদর মানে ভাগ্য, সম্মান, মর্যাদা, সুমহান ইত্যাদি। শবে কদরের পূর্ণ অর্থ হলো ভাগ্য রজনী। যেহেতু এই রাতে আমাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়, তাই একে ভাগ্য রজনী বলে। আরবিতে বলে লাইলাতুল কদর তথা মহিমান্বিত রাত।
যদিও এই রাতটি ভাগ্য নির্ধারণের, তবে এর শ্রেষ্ঠত্ব পবিত্র কোরআন নাজিলের কারণে। শবে কদরেই আল্লাহ তা’আলা তার কালাম নাজিল করেছেন। একইভাবে মর্যাদায় ভূষিত করেছেন রমজান মাসকেও। ইরশাদ হয়েছে, “নিশ্চয়ই আমি একে বরকতময় রজনীতে নাজিল করেছি” (সুরা: দুখান, আয়াত: ৩)। বরকতময় তথা মহিমান্বিত এই রজনীই লাইলাতুল কদর বা শবে কদর। কোরআন নাজিলের রাত সম্পর্কে প্রিয় হাবিবের সাথে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি মর্যাদাপূর্ণ কদর রজনীতে। আপনি কি জানেন, মহিমান্বিত কদর রজনী কি? কদর রজনী সহস্র মাস অপেক্ষা উত্তম” (সুরা: কদর, আয়াত: ১-৩)।
এটি কোরআন নাজিলের রাত। বিশ্বমানবতার দিশারি হয়ে এ রাতে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে, হেদায়েতের বাণী নিয়ে দুনিয়ায় আসেন ফেরেশতাকুলের সর্দার হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “রমজান মাস, যাতে কোরআন নাজিল হয়েছে বিশ্বমানবতার দিশারি ও হেদায়েতের সুস্পষ্ট নিদর্শনরূপে” (সুরা: বাকারা, আয়াত: ১৮৫)।
পৃথিবীতে পাক কোরআনই সর্বশেষ ঐশীগ্রন্থ। এর আগে আরো তিনটি আসমানী কিতাব এবং একশ’টি সহিফা নবী-রাসুলগণের প্রতি নাজিল করা হয়েছে । সবশেষে অবতীর্ণ হলেও কোরআনের শ্রেষ্ঠত্ব সর্ব উর্ধ্বে। কারণ এটি সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর অবতীর্ণ কিতাব। কোরআন পাঠ করেই অনেকে সম্মানিত হয়েছেন, আল্লাহর কিতাবের সূর তুলেই কারী বাসেত বিশ্বনন্দিত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, যে রেহালের ওপর কোরআন শরীফ রাখা হয়, তাও কিন্তু সকাল-সন্ধ্যা তেলাওয়াতকারীর চুমুর স্পর্শ লাভ করে। স্বল্প মূল্যের গিলাফটাকে কখনো সে বুকে জড়িয়ে নিচ্ছে, আবার কখনো মুখের আলতো ছোঁয়ায় সম্মান জানাচ্ছে। এইভাবে পবিত্র কোরআনের সাথে যে বস্তুর সম্পর্ক যতই গভীর হবে, ততই সম্মানিত হতে থাকবে।
কোরআনের সাথে সম্পৃক্ত রাতটিকে আমরা শবে কদর বলে জানি। উপমহাদেশে এই নামটিই সর্বাধিক প্রচলিত। শবে কদরের অবস্থান রমজান মাসইে। রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে শবে কদর তালাশ করো” (মুসলিম)। শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলো হলো ২১, ২৩, ২৫, ২৭, ২৯। এই পাঁচটি রাতের যেকোন একটিতে শবে কদরের উপস্থিতি হলেও এর সুনির্দিষ্ট কোন তারিখ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রকাশ করে যাননি। বরং শেষ দশদিনে ইতিকাফ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন, যাতে অনায়াসেই কোন বান্দা এই রাত পেতে পারে, এমতাবস্থায় সে ইতিকাফকারী কিংবা ইবাদতে ব্রত থাকে।
তবে সাহাবায়ে কিরাম হতে বর্ণিত অসংখ্য রেওয়ায়েত ও নিদর্শনের ভিত্তিতে রমজানের ২৭ তম রাতে শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি উল্লেখ করে মত দিয়েছেন অধিকাংশ ওলামায়ে কিরাম। এক্ষেত্রে ইমামে আজম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সুন্দর একটি যুক্তি দেখিয়েছেন, ‘যেহেতু আরবিতে লাইলাতুল কদর শব্দটি ৯ হরফ বা অক্ষরযোগে গঠিত। আর এই শব্দটিই সূরা কদরে এসেছে সর্বমোট ৩ বার। গাণিতিক হিসাবে ৯ আর ৩ গুণ করলে ফলাফল আসে ২৭। তাই এই রাতটি ২৭ তারিখে হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল’।
শবে কদরের আমল:
মূলত উম্মতে মুহাম্মদীকে শবে কদর দেয়া হয়েছে ইবাদতের জন্য। পূর্ববর্তী নবীগণের অনুসারীদের বয়সসীমা অধিক ছিল বিধায় তারা দীর্ঘকাল যাবত ইবাদতের সুযোগ পেত। উম্মতে মুহাম্মদীর যেহেতু আয়ু কম, তাই ইবাদতের বাহুল্যতা নিয়ে সাহাবায়ে কিরামের একধরণের অপ্রাপ্তির অনুশোচনাবোধ ছিল। আর তা পুষিয়ে দিতে আল্লাহ পাক এমন এক রাত উপহার দিলেন, যা হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “লাইলাতুল কদরের বিশেষ আমল, সদক্বা, নামাজ, জাকাত- এগুলো এক হাজার মাসের আমল থেকেও উত্তম” (দুররে মনসুর)। এক হাজার মাসকে বছরের গণনায় হিসেব করলে তা দাঁড়ায় ৮৩ বছর ৪ মাস।
(১) কোরআন তেলাওয়াত: পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত শ্রেষ্ঠ নফল ইবাদত। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, তা নাজিল হয়েছে পবিত্র কদর রজনীতে। এই রাতে কোরআন তেলাওয়াত না করলে আল্লাহর কিতাবের প্রতি আমাদের হক যথাযথ আদায় হবে না। বিশেষ করে সুরা কদর, ইয়াসিন, দুখান, মুজ্জাম্মিল, ত্বাহাসহ অধিকতর ফজিলতপূর্ণ সুরাসমূহ পাঠ করবে।
(২) নফল নামাজ: এই রাতের অন্যতম কর্তব্য বেশিবেশি নফল নামাজ আদায় করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে কদরের রাতে নামাজে দাঁড়াবে, তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে” (সহীহ বুখারী)। নফল নামাজ অনেক ধরণের হতে পারে। তাহাজ্জুদ, আওয়াবিন, দুখুলুল মসজিদ, সালাতুত তাসবিহ, তাওবাহর নামাজ ইত্যাদি।
(৩) দোয়া করা: এই রাতের সুন্নাতসিদ্ধ আরেকটি আমল দোয়া করা। হযরত মা আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জানতে পারি, তাহলে ঐ রাতে আল্লাহর কাছে কী দোয়া করব? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফউয়া, ফাফু আন্নি” অর্থাৎ হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসেন, তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন (সুনানে ইবনে মাজাহ)। তাই প্রত্যেকের উচিত এই দোয়াটি বেশিবেশি পাঠ করা।
(৪) দান সদক্বা করা: দান সদক্বা সেবামূলক কাজ। ইসলামে অত্যন্ত প্রশংসিত আমল বলে এটি গণনীয়। আর শবে কদরে এক পয়সাও যদি কেউ দান করে, তবে সে ৮৩ বছর ৪ মাস দান করার নেকী অর্জন করতে সমর্থ হবে।
(৫) অধিক হারে ইস্তেগফার করা।
(৬) পিতামাতা ও নিকটাত্মীয়ের কবর জিয়ারত।
(৭) জিকির-আজকারে মশগুল থাকা।
(৮) দরুদ শরীফ পাঠ করা।
আরো অসংখ্য ইবাদত করা যেতে পারে উক্ত রাতে। সাথে সাথে পৃথিবীর নির্যাতিত সকল মুসলমানের মুক্তির জন্য দোয়া ও সমৃদ্ধি কামনা করতে হবে; এবং সুশৃঙ্খল জীবনযাপনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে এই রাতেই। এইভাবে যদি আমরা ইবাদতের মাধ্যমে পবিত্র কদর রজনী পালন করতে পারি, তাহলে নিঃসন্দেহে আমাদের পরকালীন মুক্তি অনিবার্য।