রোববার রাত পোহালেই মহালয়া। সোমবার ভোর থেকে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে পালিত হবে মহালয়া। মূলত মহালয়ার দিন থেকেই সূচনা হয় শারদ উৎসব। বোধনের ঢাকে কাঠি পড়তে বাকি মাত্র ৭ দিন। মহালয়ার দিন প্রথা মেনে সকাল থেকেই প্রয়াত পিতৃ পুরুষদের তর্পণ করবেন বহুমানুষ।
শেষ মুহূর্তে তুঙ্গে উৎসবের কেনাকাটা। চূড়ান্ত ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে প্রতিটি মণ্ডপে। মহালয়া মানে দেবীর আগমন। হিন্দু ধর্ম মতে পিতৃপক্ষ বা এই পক্ষের মাহাত্ম পরম। এই পিতৃপক্ষ পূর্বপূরুষের তর্পণের জন্য বিশেষ পক্ষ।
একে ষোলা শ্রাদ্ধ, কানাগাত, জিতিয়া, মহালয়া পক্ষ ও অপরপক্ষ বলা হয়। হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী, যেহেতু পিতৃপক্ষে প্রেতকর্ম তর্পণ ইত্যাদি মৃত্যু-সংক্রান্ত আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়, সেহেতু এই পক্ষ শুভকাজের জন্য প্রশস্ত নয়।
দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে গণেশ উৎসবের পরবর্তী পূর্ণিমা তিথিতে এই পক্ষ সূচিত হয়। আর শেষ হয় মহালয়া দিবসে। উত্তর ভারত ও নেপালে ভাদ্রের পরিবর্তে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষকে পিতৃপক্ষ বলা হয়।
হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, পিতৃলোক স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। জীবিত ব্যক্তির পূর্বের তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে বাস করেন। এখানকার শাসক মৃত্যুদেবতা যম। তিনিই সদ্যমৃত ব্যক্তির আত্মা, মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান।
মহাভারতের বর্ণনা অনুসারে, কর্ণের মৃত্যু হলে তার আত্মা স্বর্গে গমন করে, স্বর্গে তাকে স্বর্ণ ও রত্ন খাদ্য হিসেবে দেওয়া হয়। কর্ণ স্বর্গাধিপতি ইন্দ্রকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণই দান করেছেন, পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কোনোদিন খাদ্য প্রদান করেননি। তাই স্বর্গে তাকে স্বর্ণই খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়েছে।
সেসময় কর্ণ বলেন, তিনি তার পিতৃগণের সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না, এই কারণে কর্ণকে ১৬ দিনের জন্য মর্ত্যে গিয়ে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেওয়া হয়।
এই পক্ষই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয়। পুত্র কর্তৃক শ্রাদ্ধানুষ্ঠান প্রসঙ্গে গরুড় পুরাণ গ্রন্থে বলা হয়েছে, “পুত্র বিনা মুক্তি নাই। মার্কণ্ডেয় পুরাণ গ্রন্থে বলা হয়েছে, পিতৃগণ শ্রাদ্ধে তুষ্ট হলে স্বাস্থ্য, ধন, জ্ঞান ও দীর্ঘায়ু এবং পরিশেষে উত্তরপুরুষকে স্বর্গ ও মোক্ষ প্রদান করেন।
মহালয়ার কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে-চন্ডীপাঠ, পূজা ঢাকের বাদ্য, মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্বলনে বৈজয়ন্তী ধ্বজা উড্ডয়নের মাধ্যমে দেবীপক্ষের উদ্বোধন, আলোচনাসভা, ভোগরাগ, প্রসাদ বিতরণ ও মাতৃগীতাঞ্জলী।
হিন্দু সংস্কৃতি বিধানে- আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে এবং চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষে দুর্গোৎসব পালন করা যায়। চৈত্র অর্থাৎ বসন্তকালের দুর্গাপূজা বাসন্তী দুর্গাপূজা ও আশ্বিন অর্থাৎ শরত্কালের দুর্গাপূজা শারদীয় দুর্গাপূজা নামে পরিচিত।
‘জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণ ধারিণী, অভয়াশক্তি বল প্রদায়নী তুমি জাগো-দেবী প্রসীদ পরিপালয়ে নো হরি ভীতে: নিত্যং যথাসুরবধদিধনৈব সদ্য: পাপানি সর্বজগতাঞ্চ শমং নয়াশু উৎপাতপাকজনিতাংশ্চ মহোপসর্গানা’
পূত পবিত্র এই আহবানের মধ্যে দিয়ে ১২ অক্টোবর (সোমবার) ভোর রাতে সারাবিশ্বে পালিত হবে পূণ্য তিথি মহালয়া।
আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রচারিত হবে মহিষাসুরমর্দ্দিনী। বাণী কুমারের রচনা ও প্রবর্তনায় মাতৃসাধক বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের অমর কন্ঠের গ্রন্থনা ও শ্লোক পাঠে আবাহন হবে জগৎ জননী দেবী দূর্গার।
পঞ্জিকা মতে, শুভ্র-স্নিগ্ধ ঋতু শরতের শেষ লগ্ন এবং নতুন ধানের সুভাষময় হেমন্তের সূচনালগ্ন। তবে এখনো বৃক্ষরাজি থেকে ঝরছে শিউলি ফুল। এই ফুলের সুভাষকে সঙ্গী করে সারাবিশ্বের বাঙালিকে এক সুরে বেঁধে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে এখন আনন্দময় আলোর রোশনাই।
স্বর্গলোক থেকে মর্ত্যলোকে ভক্তদের দর্শন দিতে আবারো আসছেন দশভূজা দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা। মহালয়ায় পূর্বাহ্নে দেবীর ঘট স্থাপন ও পূজার মধ্যদিয়ে শুরু হবে দেবী আগমনের ক্ষণগণনা।
মহালয়া অনেকে শুনেছেন। অনেকে শুনবেন। কিন্তু কেনো এই মহালয়া? সবাই নিশ্চিত মহালয়া মানে দুর্গা পূজার দিন গোনা, মহালয়ার ৬ দিন পর মহাসপ্তমী,তাই দেবীকে আমন্ত্রণ ইত্যাদি। মহালয়ার তার চেয়ে বড় গুরুত্ব আছে, সেটা অনেকেই জানেন না।
ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র অকালে দেবীকে আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধারের জন্য। আসল দুর্গা পূজা হলো বসন্তে। সেটাকে বাসন্তী পূজা বলা হয়। শ্রীরামচন্দ্র অকালে-অসময়ে পূজা করেছিলেন বলে এই শরতের পূজাকে দেবীর অকাল-বোধন বলা হয়।
সনাতন ধর্মে কোনো শুভ কাজ করতে গেলে, বিবাহ করতে গেলে প্রয়াত পূর্বরা, যাদের পিতা-মাতা তাদের পিতা-মাতার জন্য, সাথে সমগ্র জীব-জগতের জন্য তর্পণ করতে হয়। কার্যাদি-অঞ্জলি প্রদান করতে হয়। তর্পণ মানে খুশি করা। ভগবান শ্রীরাম লঙ্কা বিজয়ের আগে এদিনে এমনই করেছিলেন। সেই অনুসারে এই মহালয়া তিথিতে যারা পিতৃ-মাতৃহীন তারা তাদের পূর্বপূরুষের স্মরণ করে, পূর্বপূরুষের আত্নার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন ।
সনাতন ধর্ম অনুসারে মহালয়ার দিনে প্রয়াত আত্নাদের মর্তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, প্রয়াত আত্নার যে সমাবেশ হয় তাহাকে মহালয় বলা হয়। মহালয় থেকে মহালয়া। পিতৃপক্ষের শেষদিন এটি। সনাতন ধর্ম অনুসারে বছরে একবার পিতা-মাতার উদ্দেশ্যে পিন্ড দান করতে হয়।
সেই তিথিতে করতে হয় যে তিথিতে উনারা প্রয়াত হয়েছেন। সনাতন ধর্মের কার্যাদি কোনো তারিখ অনুসারে করা হয় না। হয় তিথি অনুসারে। মহালয়াতে যারা গঙ্গায় অঞ্জলি প্রদান করেন পূর্বদের আত্নার শান্তির জন্য, তাহারা শুধু পূর্বদের নয়, পৃথিবীর সমগ্র কিছুর জন্য প্রার্থনা ও অঞ্জলি প্রদান করেন।
মহাসপ্তমীর ঠিক ৭ দিন আগে হয়ে মহালয়া। যথাযথ ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্যে ও উৎসাহ উদ্দীপনায় পালিত হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের সব থেকে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পূজার আগমনী তথা মহালয়া।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)