সব দলের অংশগ্রহণে ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে একাদশ জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ছাড়াও অংশগ্রহণ করছে বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ বিভিন্ন ইসলামী দল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ৩০ ডিসেম্বর সবদলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হবে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
এবার ভোট যুদ্ধের মূল লড়াইটা হবে মহাজোট প্রার্থীদের সাথে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের। যদিও ঐক্যফ্রন্টের নেতারা অভিযোগ করে আসছেন সবার অংশগ্রহণে অবাধ স্বচ্ছ নির্বাচন হওয়ার কোনো পরিবেশ এখনও তৈরি হয়নি। মহাজোটের বিপরীতে নতুন শক্তি নিয়ে এসেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এই ফ্রন্টের মূল নেতৃত্বে রয়েছেন গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেন। এই জোটের নেতারা সবাই ধানের শীষ প্রতীকে লড়াই করছেন। বিএনপি জামায়াতের সাথে এই জোটে যারা যুক্ত হয়েছেন তারা খানিকটা বিস্ময়ও সৃষ্টি করেছেন। কেননা নতুন করে যারা যুক্ত হয়েছেন তারা সবাইই একসময় বঙ্গবন্ধুর ‘স্নেহধন্য’ বলে এখনও স্মৃতিচারণ করেন। সেই তারা সামরিক সরকার জিয়ার সৃষ্ট ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন এটা অনেকের কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু রাজনীতির শেষ কথা নেই বলে সেটাই সত্য হতে চলেছে।
একাদশ জাতীয় নির্বাচনে মহাজোট থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন ২৫৮ জন। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি ২৯টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ৫টি, জাসদ ৩টি, বাংলাদেশ জাসদ ১টি, বিকল্প ধারা বাংলাদেশ ৩টি, তরিকত ফেডারেশন ২টি এবং জাতীয় পার্টি (জেপি) ২টি করে আসনে মহাজোট থেকে প্রার্থী দিয়েছে। তবে এর মধ্যেও আবার তিনটি আসনে মহাজোট এবং শরীক দলের প্রার্থী রয়েছে। এ ছাড়াও প্রায় দেড় শতের মতো উন্মুক্ত আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা লড়ছে। একইভাবে জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি থেকেও বেশ কয়েকজন প্রার্থী দলীয় প্রতীক নিয়ে ভোটযুদ্ধে রয়েছেন। তবে এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট থেকে শরীক দলগুলো আসন পাওয়া নিয়ে যে বেশ অসন্তষ্ট তা বলাই বাহুল্য। বিশেষ করে ১৪ দলের অন্তর্ভুক্ত শরীকদলগুলো বড় বেশি বৈষম্যের শিকার হয়েছে। সেই তুলনায় অনেকটাই উড়ে এসে জুড়ে বসে সাবেক বিএনপি নেতা বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্প ধারা বাংলাদেশ তিনটি আসন বাগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। শরীক দলের মধ্যে আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত করা হয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদকে। এই দল থেকে একাধিক নেতা মহাজোট থেকে মনোনয়নের যোগ্য হলেও জাসদ থেকে মাত্র তিনজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। মনোনয়ন পেয়েছেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি, জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এমপি এবং একেএম রেজাউল করিম তানসেন এমপিকে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে হাসানুল হক ইনু এমপি এবং শিরীন আখতার বিনা প্রতিদ্বন্ধীতায় জয়ী হলেও একেএম রেজাউল করিম তানসেন মশাল প্রতীক নিয়ে বগুড়া-৪ আসন (কাহালু-নন্দীগ্রাম) থেকে জয়ী হয়ে সংসদে আসেন।
অথচ জাসদ থেকে এবার সম্ভাবনাময় প্রার্থী হিসেবে মাঠ দখলে রেখেছিলেন রংপুর-২ আসনে কুমারেশ চন্দ্র রায়, গাইবান্ধা ৩ আসনে এসএম খাদেমুল ইসলাম খুদি, কুষ্টিয়া ৪ আসনে সাবেক ছাত্রনেতা রোকনুজ্জামান, বরিশাল ৬ আসনে মোহাম্মদ মহসীন, ময়মনসিংহ ৬ আসনে সৈয়দ শফিকুল ইসলাম মিন্টু, ব্রাক্ষণবাড়িয়া ৫ আসনে সাবেক সংসদ অ্যাডভোকেট শাহ জিকরুল আহমেদ, নরসিংদী ২ আসনে জায়েদুল কবীরসহ আরও অনেকে। কিন্তু উল্লিখিতদের কাউকেই মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। ফলে জাসদের মাঠ পর্যায়ে চরম হতাশা পরিলক্ষিত হয়।
গত কয়েক বছরের রাজনীতির গতিবিধি অনুযায়ী এটি পরিস্কার যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জোটগত রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছে হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদ এবং রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধীদলের সব রক্তচক্ষুর বিরুদ্ধে এই দুটি দল রুখে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষ করে সেসময় তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু আগুন সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরিতে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা রাখেন। শুধু এই নয়, জঙ্গীবাদ বিরোধী আন্দোলনেও জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু দেশে এবং দেশের বাইরে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার থেকেছেন।
সার্বিক বিবেচনায় তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উচিত ছিল ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম মিত্র জাসদকে আর কয়েকটি আসন দেওয়া। এতে করে জাসদ রাজনীতির ময়দানে আরও সক্রিয় থাকতো এবং ভবিষ্যতে ১৪ দলের রাজনীতির জন্য সেটা প্লাস পয়েন্ট হতো। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন জাসদ তৃণমূল পর্যায়ে আগের মতো শক্তিশালী না হলেও এখনও রাজপথে যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। জাসদের অন্তত দুজন তরুণ নেতৃত্বকে এবার মহাজোট থেকে মনোনয়ন দেওয়া হলে ১৪ দলীয় জোট আরও লাভবান হতো।
তবে এ কথাও সত্য যে আসন পাওয়ার ক্ষেত্রে জাসদ যে বঞ্চনার শিকার হয়েছে তার দায়ভার তাদেরও রয়েছে। বিশেষ করে ২০১৬ সালে আকস্মিকভাবে জাসদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার কারণে ১৪ দলীয় জোটে তাদের কৌশলগত অবস্থান নড়বড়ে হয়ে পড়ে। ২০১৬ সালের মার্চে জাসদ থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ জাসদ নামে নতুন দল করেন জাসদের বর্ষীয়ান নেতা শরীফ নুরুল আম্বিয়া, মাইনুদ্দিন খান বাদল এমপি, নাজমুল হক প্রধান এমপি। শেষ পর্যন্ত এই দলটি নিবন্ধন পর্যন্ত পেতে ব্যর্থ হয়।
শুধুমাত্র মহাজোট থেকে চট্টগ্রাম ৮ আসনে বাংলাদেশ জাসদ-এর মনোনয়ন পেয়েছেন মাইনুদ্দিন খান বাদল এমপি। বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি প্রবীণ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা শরীফ নুরুল আম্বিয়াকে মহাজোট থেকে মনোনয়ন দেওয়ার পরও তিনি চূড়ান্ত মনোনয়ন পাননি। মনোনয়ন প্রদানের নামে তার প্রতি যে আচারণ করা হয়েছে তা অনেকের চোখেই চরম অপমান বলে চিহ্নিত হয়েছে। সত্যিই শরীফ নুরুল আম্বিয়ার মতো একজন বর্ষীয়ান নেতার সাথে কানামাছি খেলার মতো আচারণ করা ঠিক হয়নি।
একইভাবে পঞ্চগড়-১ আসনে বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধানকেও মহাজোট থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত করা হয়েছে। তার বদলে মনোনয়ন পেয়েছেন পঞ্চগড় জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহাসভাপতি, সাবেক সাংসদ মাজহারুল হক প্রধান। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে পঞ্চগড়-১ আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া হলেও তৎকালীন জাসদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান ৪৬ হাজার ১৫৫ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। নাজমুল হক প্রধান আশাবাদী ছিলেন তিনিই মহাজোট থেকে মনোনয়ন পাবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে মনোনয়ন বঞ্চিত হতে হয়। নাজমুল হক প্রধান শেষ পর্যন্ত নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
অথচ ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে হাতুরি প্রতীকে নির্বাচিত হওয়া তিনজন সংসদ সদস্য এবারও মহাজোট থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন। বরিশাল ৩ (মুলাদী-বাবুগঞ্জ) আসনে মহাজোট থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন জাতীয় পার্টির গোলাম কিবরিয়া টিপু। কিন্তু বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির টিপু সুলতান হাতুরি মার্কা নিয়ে হারিয়ে দিয়েছিলেন গোলাম কিবরিয়া টিপুকে। একইভাবে ঠাকুরগাঁও ৩ আসন থেকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী একেএম হাফিজ উদ্দীনকে হারিয়ে জয়ী হয়েছিলেন বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা ইয়াসিন আলী। সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) আসনে বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে জয়ী হয়েছিলেন অ্যাডভোকেট মুস্তফা লুৎফুল্লাহ। অবশ্য এই তিনজনকে বঞ্চিত করেননি মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনা।
এদিকে মহাজোটে পা না ফেলতেই বিকল্প ধারা বাংলাদেশের তিনজনকে মনোননয়ন দেওয়ায় ১৪ দলীয় জোটের পুরনো শরিকরা ভেতরে ভেতরে চরম ক্ষুব্ধ হয়েছে। বিকল্প ধারা বাংলাদেশ কখনই আওয়ামী লীগের মিত্র ছিল না। বরং সবসময়ই মহাজোট সরকারের বিরোধীতা করেছে। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগে এই দলটি পুরনো মিত্র বিএনপির চারপাশেই ঘুরাঘুরি করছিল। কিন্তু বনিবনা না হওয়ায় মহাজোটে এসে ছিপ ফেলে। সফলও হন বিকল্প ধারার নেতা বদরুদ্দোজা চৌধুরী। ছেলে মাহি বি চৌধুরীর আসনসহ আরও দুটি আসন নিশ্চিত করেন তিনি। কিন্ত এটি পরিস্কার যে নিজ ছেলেকে এমপি বানানোর লোভেই কেবল বদরুদ্দোজা চৌধুরী মহাজোটে ভিড়েছেন অন্য কোনো কারণে নয়। ডানপন্থী বিকল্পধারাকে ফুল দিয়ে বরণ করে যে শেখ হাসিনা যে বড় ধরনের ভুল করলেন তা আগামীতে পরিস্কার হয়ে যাবে।
শরীক দলের মধ্যে আসন বন্টনের ক্ষেত্রে মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনার টোটাল জাজমেন্ট সুবিবেচনা প্রসূত হয়নি। ১৪ দলের শরিক দলগুলোকে এবার কমপক্ষে ২০টি আসন দেওয়া উচিত ছিল। এটি দেওয়া হলে ভবিষ্যতে জোটগত রাজনীতির বিশ্বাসের ভিত ও এগিয়ে যাওয়ার কৌশল আরও মজবুত হতো। মেজর মান্নান, মাহি বি চৌধুরীদের চেয়ে রাজপথ ও রাজনীতিতে ফ্যাক্টর হয়ে উঠতেন জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে নির্বাচিত হয়ে আসা সাংসদরা। জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি শক্তিশালী হলে শেখ হাসিনাই আরও শক্তিশালী হতেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)