সে এক ঘোরকৃষ্ণপক্ষ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষের বুকে চেপে বসে সমরিক শাসনের জগদ্দল পাথর।
১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সন পর্যন্ত চলতে থাকে হত্যা ক্যু, ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। এরই ধারাবাহিকতায় এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান এর মাধ্যমে ১৯৮২ সালের ২৪ শে মার্চ ক্ষমতা দখল করে আরেক স্বৈরাচার জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তাৎক্ষণিক ভাবেই দেশের ছাত্র-সমাজ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে।
২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে গেলে জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ জাতীয় নেতা ও ছাত্রদের উপর ব্যাপকভাবে হামলা চালায় এরশাদের বাহিনী। সময়ের পথ পরিক্রমায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল সমূহ ও ছাত্র সংগঠন সমূহ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টা চালায়। গড়ে উঠে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, শ্রমিক কর্মচারী ঐক্যপরিষদ।
সামরিক শাসনের প্রতিবাদে ১৯৮৩’র ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে গুলি বর্ষণ করে হত্যা করা হয় অগণিত শিক্ষার্থীদের। আন্দোলন এগোতে থাকে রক্তের ধারায়। ১৯৮৪ সালের ২২ ও ২৩ ডিসেম্বর শ্রমিক কর্মচারী ঐক্যপরিষদ (স্কপ) ৪৮ ঘন্টার ধর্মঘট আহ্বান করে। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল সমূহ সেই ধর্মঘটকে সমর্থন জানায়। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদও ধর্মঘট সমর্থন করে।
“তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সামরিক জান্তার পেটোয়া বাহিনীর অস্ত্রের ঝনজনানি, সেই পরিস্থিতিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় আমি তাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারিনি”
ধর্মঘটের সমর্থনে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ দেশব্যাপী সভা-সমাবেশের ডাক দেয়। শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্যজোট (স্কপ) ধর্মঘট আহ্বান করলেও তা হরতালে রূপ নেয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন স্টেশন চত্বরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে।
রাজশাহী শহরে থমথমে অবস্থা। রাস্তার প্রতিটি মোড়ে মোড়ে তৎকালীন বিডিআর মিছিলে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতা শাজাহান সিরাজকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে। শাজাহান সিরাজ ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। গুলিবিদ্ধ হন ছাত্রদল নেতা পরিবর্তীতে রাকসুর ভিপি রুহুল কবির রিজভী। সোহরাওয়ার্দী হলের তৃতীয় তলায় পত্রিকা বিলি করার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারায় হকার আব্দুল আজিজ।
মূলত কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ছিলেন বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি শিশির, সাধারণ সম্পাদক লিকু, ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হেলাল, সাধারণ সম্পাদক রমজান, ছাত্রলীগের বাদশা, মুকুল, জাতীয় ছাত্রলীগের মিলন, দুলাল, মরহুম কাদের সরকার, জাসদ ছাত্রলীগের আজিজুল রহমান আজু, শাহজাহান সিরাজ, আইয়ুব, রুহুল কুদ্দুস বাবু, বাদল, মুহিত, রায়হান, আরিফ, আনসারি, টিটন, নওশাদ, করিম শিদকার প্রমুখ।
সাময়িক শাসনবিরোধী আন্দোলনে শত শহীদের তালিকায় যুক্ত হয় আরেক মৃত্যুহীন নাম শাজাহান সিরাজ। আজ থেকে ২৩ বছর আগে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে শহীদ হওয়া অকুতোভর শাজাহান সিরাজকে স্মরণ করি বিনম্র শ্রদ্ধায়। অত্যন্ত সাধারণ পরিবার থেকে আগত, সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্খায় বিশ্বাসী একজন দৃঢ় সংগঠক অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিলেন সামরিক জান্তার বুলেটে।
১৯৮২ সালে সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখলকারী এরশাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ ওই বছরেই সমারিক শাসন প্রত্যাহার, শ্রমিক-কর্মচারীদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, অবাধ ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার দাবী করে স্মারকলিপি পেশ করে।
ওই স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেন জাতীয় শ্রমিক জোটের শ্রমিক নেতা মরহুম মো. শাহজাহান, রুহুল আমিন ভূঁইয়া, সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা মুখলেসুর রহমান, বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশনের আবুল বাসার ও টিইউসির পক্ষে সাইফুদ্দিন মানিক ও জাতীয় শ্রমিক লীগের নেতারা।
আজকের এই দিনে আমি ব্যক্তিগতভাবে স্মৃতিচারণ করে দুই-একটি কথা বলতে চাই। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংস্কৃতি সম্পাদক। কমিটিটি অকার্যকর হয়ে যাওয়ায় কেন্দ্র থেকে ওই অকার্যকর কমিটি ভেঙে দিয়ে ১১ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। আমাকে মনোনীত করা হয় উক্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু আমি দায়িত্ব গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করি।
আমার যুক্তি ছিলো মফস্বল শহর থেকে আমি অতিসাধারণ পরিবারের একমাত্র ছেলে। সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যা পরিস্থিতি তাতে ওই ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালন আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না।
শাজাহান সিরাজ সেই রাতে মহসীন হলের ৩৬৪ নম্বর রুমে আমার সাথে রাত যাপন করেন। এর আগে আমরা একত্রে বেইলি রোডে ঢাকা থিয়েটারের ‘কীত্তনখোলা’ নাটক দেখি ও নাজিমউদ্দীন রোডে নীরব হোটেলে খাওয়া দাওয়া সেরে গভীর রাতে হলে ফিরি। সে সারারাত ধরে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে আমি যাতে দায়িত্ব গ্রহণ করি। নিরুপায় হয়ে আমি রাজি হই। সিলেটের জাসদ নেতা লোকমান আহমদ সকালে হলে আসে আমার কাছ থেকে সন্মতি আদায় করে নেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সামরিক জান্তার পেটোয়া বাহিনীর অস্ত্রের ঝনঝনানি। সেই পরিস্থিতিতে কিংকর্তব্যবিমূড় অবস্থায় আমি তাদের অনুরোধ প্রত্যাখান করতে পরিনি।
এরপর দায়িত্ব নিয়ে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বিপ্লবী আদর্শে সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কাজ শুরু করি। তাই আজ বারবার মনে পড়ছে মিছিলের সেই সহকর্মীর কথা। আমরা চেয়েছিলাম সমাজ বদল করতে। সেই মিছিল থেকে কতজনের প্রাণ ঝরে গেছে। কিন্তু আমি আজও বেঁচে আছি। সামরিক স্বৈরতন্ত্রের অবসান হয়েছে। ১৯৯০ সালের সেই বিজয়ী ছাত্র গণআন্দোলনে আমিও নেতৃত্বের কাতারে ছিলাম। কিন্তু বারবার মনে পড়ে সেই সময়ের কথা। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাৎক্ষণিক স্লোগান উচ্চারণ করেছে‘ জ্বলছে আগুন লেলিহান, শাজাহান-শাজাহান,’ মহিহারের মহাপ্রাণ, শাজাহান, শাজাহান,।
সামরিক জান্তার বিদায় হয়েটে বটে কিন্তু তারপরেও এই যুদ্ধ জয়ী স্বাধীন দেশে আজ পর্যন্ত অনমানের মনে শত প্রশ্ন রয়ে গেছে। স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে লাখো তরুণের বলিষ্ঠ প্রতিবাদই এই স্বাধীন দেশকে একটি ঘৃণিত স্বৈরাচারের হাত থেকে রক্ষা করেছিলো। যে তরতাজা তরুন শাজাহান সিরাজদের প্রাণের বিনিময়ে ৯০ এর পরে এই বাংলাদেশে প্রকৃত গণতন্ত্রের সুবাতাস বয়ে যাওয়ার কথা অথচ দেশে আজ সেই গণতন্ত্রই সবচেয়ে বড় প্রশ্নের সন্মুখীন!
আমরা আজ আমাদের নীতিহীণ রাজনৈতিক চরিতার্থের কারণে সব কিছুকেই বিনষ্ট করে দিচ্ছি। কুখ্যাত সেই স্বৈরাচার আজ আমাদের নীতিভ্রষ্ঠ রাজনৈতিক চর্চার সুযোগ গ্রহণ করে। আমাদেরকেই গণতন্ত্রের ছবক দান করেন! সেই স্বৈরাচার এরশাদের দল আজকে শাজাহান সিরাজদের শত শত তরুণের রক্তের সাথে তামাশা করে, তরুণদের সেই কাঙ্খিত গণতন্ত্রের কান্ডারী হবার আশায় জাতীয় সংসদের নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়! এই লজ্জা আমরা রাখি কোথায়? শাজাহান সিরাজ তুমি মরেও আজ বিপ্লবী, তবে আমাদের ক্ষমা করে দিও। তোমাদের রক্তের মূল্যায়ন আমরা করতে পারিনি। শুধু আশা থাকতে এই যুদ্ধে জয়ী স্বাধীন দেশ একদিন তোমার রক্তের মূল্যায়ন হবে।
২০২০ সাল অতিক্রান্ত প্রায়। ২০২১ সালের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা। করোনাভাইরাস জনিত পরিস্থিতিতে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশেষ পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষপটে করোনা পরিস্থিতির সাথে যুক্ত হয়েছে এই দেশের গণতান্ত্রিক চর্চা কিভাবে হবে। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কিভাবে সুদৃঢ় অবস্থায় পৌঁছাবে।
দেশের সাম্প্রদায়িক শক্তি লক্ষ লক্ষ শহীদের অর্জিত বিনিময়ের স্বাধীনতাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। দুর্নীতির ডালপালা চতুর্দিকে প্রসারিত। বাংলাদেশ একটি সুস্থ নির্বাচনী প্রক্রিয়া গড়ে তোলা উচিত। যে গণতন্ত্রের জন্য শাজাহান সিরাজ জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। সেই গণতান্ত্রিনক প্রক্রিয়া আজ প্রশ্নের মুখোমুখি। এমত অবস্থায় এই সংকট কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশের সকল ব্যক্তির মত ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবন্ধ ভাবে পুর্ণ গনতান্ত্রিক অধিকার বাস্তবায়ন করে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখা।
সাম্প্রদায়িকতার কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার লক্ষে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তাহলেই শাহাজান সিরাজ সহ ৯০-এর গণআন্দোলনে যারা জীবন উৎগর্স করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন, মা-বোনেরা সম্ভ্রম হারিয়েছেন তাদের সকলের স্বপ্ন মুজিববর্ষে বাস্তবায়িত হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখতেন সেই সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে এগিয়ে যাক। শাজাহান সিরাজের স্মৃতি ওমর হোক। জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)