প্রতিনিয়ত পরিবর্তীত হচ্ছে পৃথিবী। এই পরিবর্তনের ধারায় কখনও সিডর, কখনও সুনামি, কখনও আইলা, কখনও ভূমিকম্প, কখনও অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, বিভিন্ন রকমের রোগ-বালাই দেখা দিচ্ছে দুর্যোগ আকারে। মারা যাচ্ছে মানুষ, ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে মাঠের পর মাঠ ফসল। বাড়ছে খাদ্য সংকট। ঘরবাড়ি মিশে যাচ্ছে মাটির সাথে। ফলে মানুষ হারাচ্ছে তার মাথা গোঁজার ঠাঁই। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে জলবায়ুর কুপ্রভাব বিশ্বে মরুকরণ একটি অন্যতম সমস্যা।
বিশ্বের শুষ্ক ভূমির ৭০ শতাংশ ইতোমধ্যেই হয়ে পড়েছে মরুকবলিত। এর পরিমাণ পৃথিবীর মোট ভূমির চার ভাগের এক ভাগ। নিষ্কাষণে অব্যবস্থা ও লবণাক্ততার ফলে সেচের আওতাধীন আবাদি জমির বিশাল অংশ আজ অবক্ষয়ের সম্মুখীন। সুতরাং মরুকরণ ভবিষ্যত পৃথিবীর জন্য এক বিশাল হুমকি। এজন্য প্রয়োজন মরুকরণ বিস্তার রোধ।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে অবক্ষয় প্রক্রিয়াই হচ্ছে মরুকরণ। শুষ্কভূমি পরিবেশগত দিক থেকে খুবই নাজুক। এমন ভূমিই মরুকরণের শিকার হয়। মরুকরণের ফলে ভূমি হারিয়ে ফেলে উৎপাদন ক্ষমতা। হয়ে যায় অনুর্বর। যার ফলে সৃষ্টি হয় খাদ্য সংকট, বাড়ে গরিবের সংখ্যা।
তাই খরা, মরুকরণ বিস্তার রোধে প্রয়োজন পরিবেশ সম্মতভাবে, সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ন্যায়ানুগ ও অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় পদ্ধতিতে ভূমির ব্যবহার। এটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক মরুময়তা দিবসের মূল উপলব্ধি।
পরিবেশ বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে পৃথিবী। পরিবেশ বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে যে বিষয়টি, সেটি হলো জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে ভূমি অবক্ষয় প্রক্রিয়াই হচ্ছে মরুকরণ। মরুকরণের ফলে ভূমির উৎপাদন ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে খাদ্য সংকট, দারিদ্র এবং ভূখাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। আর সেজন্যই খরা, মরুকরণ প্রভৃতি বিস্তার রোধে প্রয়োজন সম্মিলিত ভাবে ন্যায়ানুগ ও অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় পদ্ধতির আলোকে ভূমির যথার্থ ব্যবহার।
১৯৯২ সালে রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্মেলনের পরপর-ই মরুকরণ সংক্রান্ত আর্ন্তজাতিক কনভেনশন গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। রিও সম্মেলনের এজেন্ডা ২১ এর প্রস্তাবটি ১৯৯২ সালে জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের ৪৭ তম অধিবেশনে গৃহীত হয় এবং ইন্টারগর্ভমেন্টাল নেগোশিয়েটিং কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি মরুকরণ সংক্রান্ত খসড়া কনভেনশন চূড়ান্ত করে। ১৯৯৪ সালের জুন মাসে কনভেনশনের দলিল চূড়ান্ত হয়। এই কনভেনশন ৫০টি দেশ কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার পর ১৯৯৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়।
বলা আবশ্যক যে, বাংলাদেশও এই কনভেনশন অনুমোদন করে। ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি উপ-সাহারীয় আফ্রিকায় খরার কারণে প্রায় ত্রিশ লাখ লোকের মৃত্যু ঘটে। সুতরাং মরুকরণ সমস্যাটি বিশাল এক ক্ষতিকর ভৌগলিক পরিবর্তনের নাম। বিশ্বের শুষ্ক ভূমির প্রায় ৭০ শতাংশ ইতোমধ্যে-ই মরুকবলিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে এর পরিমান পৃথিবীর মোট ভূমির চার ভাগের এক ভাগ। নিষ্কাষণে অব্যবস্থা ও লবণাক্ততার ফলে সেচের আওতাধীন আবাদী জমির বিশাল অংশ বর্তমানে অবক্ষয়ের সম্মুখিন। সুতরাং মরুকরণ ভবিষ্যত পৃথিবীর জন্য এক বিশাল হুমকি। এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন মরুকরণ সর্ম্পকিত সম্মুখ জ্ঞান এবং মরুকরণ বিস্তার রোধে সর্বাধিক পরিকল্পনা গ্রহণ।
মরুকরণ এতোদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না হলেও এখন এটি পরিবেশ বিজ্ঞানীদের যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলছে। সম্প্রতি আমাদের দেশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সিডর, আইলা, নার্গিসসহ বিবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই ভাবনাকে আরো প্রবল করে তুলছে।
একটি সমীক্ষণ থেকে জানা গেছে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খরাকবলিত হয়ে ক্রমান্বয়ে ভূমির অবক্ষয় হচ্ছে। বিশেষত রাজশাহী অঞ্চলকে এই সমস্যা কবলিত অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে গভীর উৎসাহের সাথে কনভেনশনে একমত হলেও বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ১৯৯৫ সালে মাত্র একবার-ই আন্তর্জাতিক মরুময়তা দিবস আয়োজনের সাথে পালন করেছে। সেই সময় অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে রাজশাহীতে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিলো। যদিও তখন ছিলো বর্ষাকাল। তাই খুব স্বাভাবিক কারণেই রাজশাহীর মূল অববাহিকা পদ্মা নদী বৃষ্টির পানিতে ভরপুর ছিলো। সেই সেমিনারের আয়োজক কমিটি সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা রাজশাহীর আবহাওয়ার মরুকরণের কোন আভাস না পাওয়ায় পরবর্ত্তীতে এই দিবসটির গ্রহণ যোগ্যতা সর্ম্পকে সরকারের উদাসীন মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
সম্ভবত এই কারণেই আন্তর্জাতিক মরুময়তা দিবস এদেশে গুরুত্ব বিস্তার করতে পারেনি। তবে মরুকরণরোধে ভিন্ন প্রকৃয়ায় সরকারের পরিবেশ বান্ধব একটি কার্যক্রম বিশেষভাবে গৃহীত হয়েছে। সেটি হলো বৃক্ষরোপন কার্যক্রম। মরুকরণ বিস্তাররোধে অধিক বৃক্ষ রোপন-ই হচ্ছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যেসব বৃক্ষ পানি ধরে রাখে এবং জমির মান অক্ষুন্ন রাখতে পারে সেসব বৃক্ষ রোপন করার ব্যাপারে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা সকলকে পরামর্শ দিচ্ছেন।
মরুময়তা দিবস পালনের ক্ষেত্রে কনভেনশনে গৃহীত মূল প্রস্তাব হলো
১. ঋতু বর্ধনশীল, খরা প্রতিরোধে সক্ষম স্থানীয় এবং অন্যান্য গাছ-পালা ব্যবহার করে বৃক্ষ রোপনের হার যথা সম্ভব বৃদ্ধি করা।
২. বিদ্যমান জ্বালানী ব্যবহারে দক্ষতা বৃদ্ধি ও বিকল্প জ্বালানী কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে জ্বালানী কাঠের চাহিদা হ্রাস করা। বিশেষ করে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মরু ও খরা কবলিত এলাকায় ঐতিহ্যগত চাষাবাদ ও চারণ পদ্ধতি টেশসই নয়। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে ভূমি ও পানি সংরক্ষণে এবং কৃষি বনায়ন ও ক্ষুদ্রকার সেচ ব্যবস্থার উপর প্রশিক্ষণ দেওয়া।
সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে এ দু’টি প্রধান বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে মরুকরণ প্রতিরোধ কর্মসূচি গ্রহণ করা আবশ্যক।
আজকের পৃথিবী, আগামীর ভবিষ্যৎ। সেক্ষেত্রে অবশ্যই পরিবেশ রক্ষার মাধ্যমে পৃথিবীকে আগামীর জন্য আরো সুন্দর এবং মানুষ বসবাসের জন্য নির্মল রাখার দায়িত্ব আমাদের সকলের। মরুকরণ রোধের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে আমাদের সকলের অঙ্গীকার। আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসই আগামীর পৃথিবীকে করে তুলতে পারে সুখের আবাসস্থল!
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ, সাংবাদিক।