২৮ জুন চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলেন মাগুরা জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভানেত্রী সবার শ্রদ্ধেয়া মনোয়ারা জামান। তিনি মাগুরার প্রয়াত জননেতা, একাধিকবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মো. আছাদুজ্জামানের সহধর্মিনী, এবং মাগুরা ১ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মো. সাইফুজ্জামান শিখরের মা । তাঁর বড় মেয়ে কামরুল লায়লা জলিও বিগত সংসদে সংরক্ষিত আসনের এমপি ছিলেন। কিন্তু এসব পরিচয়ের বাইরে দলীয় নেতা, কর্মী আর মাগুরার সাধারণ মানুষের কাছে মনোয়ারা জামানের পরিচয়ের দ্যুতি ছড়িয়েছিল সাদাসিধে এক ‘ স্নেহময়ী জননী’ হিসেবে। সত্যিকার এক গ্রামীণ মায়ের সুন্দর স্নিগ্ধ রূপ ছিলেন তিনি।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেসার প্রতিচ্ছবি ছিল তাঁর মাঝে। হাসিমুখে সবার সাথে মিশতেন, কথা বলতেন, আদর আপ্যায়ন করতেন। স্বামী আছাদুজ্জামান একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও কোনোদিন তাঁর মধ্যে সামান্যতম অহমিকা-আত্মহংকার কেউ খুঁজে পাননি। বরং বরাবরই অতি সাধারণ থেকেছেন। সেই মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরের কাল থেকে স্বামীর সাথে তিনি সমান তালে লড়াই করেছেন, অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন।
স্বামী আছাদুজ্জামান এমপি বেঁচে থাকতে দলীয় নেতাকর্মীদের সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল ছিলেন তিনি। ‘ভাবী’ হিসেবে সবার কাছে প্রিয় ছিলেন। দলীয় নেতাকর্মীদের বিপদে-আপদে, দুঃসময়ে নিজের আঁচল খুলে টাকা-পয়সা দিতেও কার্পণ্য করতেন না। রাত দুপুরে নেতা-কর্মীদের জন্য ভাত রান্না করে খাওয়ানো, শোবার ব্যবস্থা করা-রাজনৈতিক পরিবারের মানুষ হিসেকে এসব তিনি করেছেন সারাজীবন। আবার বিভিন্ন আন্দোলনের সময় পুলিশের হাত থেকে নেতা কর্মীদের রক্ষা করতে বাড়িতে লুকিয়ে রাখা এরকম বহুঘটনা তিনি সামলেছেন ঠান্ডা মাথায়।
স্বামী আছাদুজ্জামানকে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বিকশিত ও জনপ্রিয় করতে মনোয়ারা জামানের অবদান ও অনুপ্রেরণা বলে শেষ করা যাবে না। আছাদুজ্জামানের জেল জীবন এবং নিপীড়ন নির্যাতনের কালে তিনি পুরো পরিবার নিয়ে একা সংগ্রাম ও লড়াই করেছেন। বরাবরই স্বামীর প্রাণশক্তি হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। ৭৫ এ বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে আওয়ামী পরিবারের সদস্য হিসেবে তিনিও এই হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে জনমত তৈরিকে স্বচেষ্ট হন। সেসময় অনেকের মতো তাঁর পরিবারেও দুর্ভোগ নেমে আসে। স্বামী আছাদুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘদিন জেলে থাকেন আছাদুজ্জামান। এই মহাসংকটে তিনি ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে একাই সংগ্রামে অবতীর্ণ হন।
মনোয়ারা জামান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ভালবাসতেন। ভীষণরকম ভালবাসতেন বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও। আর তাই ৭৫ এ আওয়ামী রাজনীতির মহাসংকটকালেও স্বামীর সাথে তিনিও বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শে অটুট থেকেছেন। শত প্রলোভনের হাতছানি এলে তা নির্ভয়ে প্রত্যাখান করেছেন। জিয়াউর রহমানের আমলে স্বামী মো. আছাদুজ্জামানকে একাধিকবার মন্ত্রীত্ব গ্রহণের জন্য বার্তা পাঠানো হলেও মনোয়ারা জামান কখনই তাতে সামান্যতম সাঁয় দেননি। জিয়াউর রহমানের এ ধরনের অনুরোধের কথা শুনেই তিনি তা নাকচ করে দিয়েছেন। ৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন বৃহত্তর যশোর জেলার দুটি আসন বাদে সবকটি আসনেই জয়ী হয়েছিল বিএনপির প্রার্থীরা। শুধু যশোহর-১১ আসন থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে তিনিই একমাত্র নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর ঝিনেদার শৈলকূপাতে জয়ী হয়েছিলেন জাসদের গোলাম মোস্তফা।
স্বামী আছাদুজ্জামান একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও স্ত্রী হিসেবে মনোয়ারা জামান সারাজীবনই অতি-সাধারণ থেকেছেন। কখনই বাড়তি সুবিধা নেওয়ার কথা চিন্তা করেননি। বরং সাধারণ জনগণের সাথে মিশে থেকেছেন। স্বাধানীতার পর মো. আছাদুজ্জামান পর পর তিনবার (কথিত ৮৮ এর নির্বাচন ছাড়া) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও ঢাকাতে কখনই প্লট, ফ্ল্যাট নেওয়ার কথা চিন্তা করেননি। এমন কী সংসদ সদস্য হিসেবে তাঁর ব্যক্তিগত কোনো গাড়িও ছিল না। সংসদ অধিবেশনের আগে আছাদুজ্জামান যখন মাগুরা থেকে ঢাকাতে সংসদ হোস্টেলে আসতেন মনোয়ারা জামান তখন বাজার করে সব গোছগাছ করতেন। মাগুরা থেকে সবজি, মাংস কিনে ঢাকায় নিয়ে আসতেন। সোহাগ বা ঈগল পরিবহনে চড়ে স্বামী আছাদুজ্জামানের সাথে ঢাকায় আসতেন। জীবনকে এভাবেই তৈরি করেছিলেন তিনি। অতিরিক্ত চাওয়া তাঁর ছিল না কখনই।
২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসের কথা। সে বছর ২৫ ডিসেম্বর জননেতা মরহুম মো. আছাদুজ্জামানের ২১ তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে মনোয়ারা জামানের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য অনুরোধ করি। উনি তখন ঢাকাতে। বড় মেয়ে কামরুল লায়লা জলি এমপির সংসদ সদস্য ভবনের ৫ নম্বর ভবনের ২০২ নম্বর ফ্লাটে থাকেন। ১৬ ডিসেম্বরের আগে বাসাতে গেলাম সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য। মরহুম মো. আছাদুজ্জামানের রাজনৈতিক জীবন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, মাগুরার বিভিন্ন প্রেক্ষাপট, ছেলেমেয়দের নিয়ে নিজের জীবনযুদ্ধ আরও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে বললেন তিনি। প্রয়াত স্বামী মরহুম মো. আছাদুজামানের রাজনৈতিক জীবনের মূল্যায়নের কথা বলতে গিয়ে তিনি বললেন, আছাদুজ্জামান সাহেব ছিলেন আপাদমস্তক এক সৎ রাজনীতিবিদ। ব্যক্তিগত সততার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
নিজের স্বার্থ নয় দলের স্বার্থকেই তিনি সবসময় অগ্রাধিকার দিতেন। ব্যক্তিগত সততা তাঁর মাঝে এতোটাই অটুট ছিল যে জিয়া-এরশাদের আমলে বিস্তর সুবিধার সুযোগ পেলেও তিনি তা প্রত্যাখান করেছেন। তিনি আরও বললেন, আছাদ সাহেব ছিলেন গণমুখী এক নেতা। সাধারণ মানুষকে খুব ভালবাসতেন। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং বিচক্ষণতা ছিল অনেক উঁচুমানের। আর সবশেষে কোথাও বাধা পড়লে আমার পরামর্শ নিতেন। বললেন, ‘আমার মনে আছে জিয়াউর রহমানের আমলে ৭৯ সালে আছাদুজ্জামান নির্বাচিত হওয়ার পর জিয়ার কাছ থেকে নানান ধরনের প্রলোভন আসতে থাকে। মন্ত্রীত্বের অফারও দেন। কিন্তু একদিন রাতে আমাকে বললেন, সম্মান ও সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন হয় এমন কোনো কাজে তিনি কাউকে সহযোগিতা করবেন না।’ সেদিন মনোয়ারা জামান আরও জানান, ৮৬ সালে আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে প্রথম যে বক্তব্য পেশ করেন সেই বক্তব্যের ড্রাফট করার দায়িত্ব পড়ে আছাদুজ্জামানের উপর। সারারাত জেগে তিনি বক্তব্য ড্রাফট করেন। সকালবেলা নাস্তা সেরেই তিনি সেই লেখা বক্তব্য নিয়ে ধানমন্ডিতে যান শেখ হাসিনার কাছে।
শেখ হাসিনার সাথে মনোয়ারা জামানের দেখা হয়েছে বহুবার। বঙ্গবন্ধু কন্যার সাথে সবসময় আপন মেয়ের মতো কথা বলেছেন। ৮১ সালের ১৭ মে দেশে আসার পর সারাদেশে রাজনৈতিক সফর শুরু করেন শেখ হাসিনা। মাগুরাতেও রাজনৈতিক সমাবেশ করেন। সেসময় প্রথম মাগুরাতে আছাদুজ্জামানের বাড়িতে যান। মনোয়ারা জামানের সাথে ছবিও তুলেন। ৯৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর অ্যাডভোকেট মো. আছাদুজ্জামানের মৃত্যু হলে ৯৪ সালের মার্চে মাগুরা-২ আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে কারচুপির ঘটনা ঘটলে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা মাগুরাতে গিয়ে আছাদুজ্জামানের বাসভবনে দাঁড়িয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচনে যাবেন না বলে আন্দোলনে ঘোষণা দেন। সেদিন শেখ হাসিনার পাশে মনোয়ারা জামানও ছিলেন।
একসময় মাগুরা আওয়ামী লীগের নেপথ্যের শক্তি, প্রাণসঞ্চারিণী মনোয়ারা জামান বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। পিজি হাসপাতালের পর সর্বশেষ গ্রীণলাইফ হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। সেখানেও দেখা হয় একবার। মৃদু হাসি দিয়ে সালাম গ্রহণ করেন। মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পূর্বে তিনি নিজ বাড়িতে চলে যান। নিজবাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুতে মাগুরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সত্যিকার অর্থেই বড় এক নির্ভরতা হারালো। তাঁর মাতৃস্নেহ, এবং নির্মল ভালবাসার কথা দলীয় নেতা-কর্মী, শুভাকাঙ্খীদের স্মৃতিপট থেকে খুব দ্রুত মুছে যাবে না। ছায়া ও মায়ার এই মানুষটি আমাদের সবার কাছে অতল শ্রদ্ধা হয়ে থাক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)