ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা যেকোনো আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকলেও গভীর রাতে হল ছেড়ে বেরিয়ে মিছিলে যোগ দেওয়ার নজির নিকট অতীতে নেই। রোববার মধ্যরাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো ছাত্রী হল থেকে একযোগে রাস্তায় নেমে আসেন হাজারেরও বেশি ছাত্রী। রোববার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে তারা জড়ো হন টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে।
যে কারণে বেরিয়ে আসেন ছাত্রীরা
রোববার দুপুরের পর থেকেই চাকরিতে কোটা সংস্কারের জন্য শিক্ষার্থী এবং চাকরিপ্রার্থীরা শাহবাগ অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করলে পুলিশের সঙ্গে তাদের ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল এবং রাবার বুলেট ছুঁড়লে আহত হন অর্ধশত শিক্ষার্থী।
আহতদের মধ্যে আবু বক্কর সিদ্দিক নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর চোখে রাবার বুলেট লাগলে প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে থাকে। রক্তক্ষরণের এই ছবি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে।
রাত সাড়ে ১১টার দিকে ফেসবুকে গুজব রটে যে, চোখে বুলেট লাগা আবু বকর সিদ্দিক নামের সেই শিক্ষার্থী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন। অনেকে নিশ্চিত না হয়েই একই পোস্ট দিতে থাকেন, শেয়ার করেন অনেকেই। যার ফলে গুজবটি মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। এই খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ছাত্ররা একযোগে মিছিল করে হল থেকে বেরিয়ে টিএসসির দিকে জড়ো হন।কিছুক্ষণের মধ্যে পাঁচটি হল থেকে বেরিয়ে আসেন ছাত্রীরাও। সংবাদটি ঠিক না হলেও ‘আমার ভাই মরলো কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘ক্যাম্পাসে পুলিশ কেন, প্রশাসন জবাব চাই’ স্লোগান দিতে দিতে টিএসসিতে জড়ো হন হাজারখানেক ছাত্রী।
ভিসি ভবন ভাংচুর চালালো কারা?
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সবগুলো হল থেকে কয়েক হাজার ছাত্র-ছাত্রী বেরিয়ে আসার কিছুক্ষণের মধ্যে রাত দেড়টার দিকে শুরু হয় ভিসির বাংলো ভাংচুর। প্রায় ৪০ মিনিট ধরে চালানো এ তাণ্ডবে ভিসি ভবনের প্রায় সবগুলো আসবাবপত্র গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। দুটি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ভাংচুর চালানো হয় আরেকটিতে। পুরো বাংলো জুড়েই চলে সহিংস তাণ্ডব।
ভাংচুরকারীরা ভবনের সবগুলো সিসি ক্যামেরা ভেঙে ফেলার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ কম্পিউটারের হার্ডডিস্কও নিয়ে যায় বলে জানিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান। সেসময় উপাচার্য বাংলোর ভেতরেই ছিলেন।
রাত আড়াইটার দিকে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা এসে আসবাবপত্রে দেওয়া আগুন নেভান।
প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক চ্যানেল আই অনলাইনকে জানিয়েছেন, যারা ভিসি ভবনের ভেতরে ভাংচুর চালিয়েছে তাদের ‘আগে কখনও ক্যাম্পাসে দেখা যায়নি’। তারা প্রায় সবাই ছিল মুখোশ পরা। মুখোশ পরে থাকার ব্যাপারটি জানিয়েছেন ভিসি নিজেও।
রাত সাড়ে ৩টার দিকে ভিসি বাংলোতে এসে অধ্যাপক আখতারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া। সেসময় অনেক সিনিয়র অধ্যাপকও ছিলেন ভিসির সঙ্গে।
কারা এই মুখোশধারী ভাংচুরকারী?
সোমবার সকালে ভিসি এবং আন্দোলনকারী উভয় পক্ষই দাবি করেছেন ভাংচুরকারীরা বহিরাগত।
ভিসি অধ্যাপক আখতারুজ্জামান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেছেন, যারা হামলা চালিয়েছে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নয়।
‘তারা ছিল সব মুখোশ পরা। সিসিটিভির রেকর্ডগুলো নষ্ট করার চেষ্টা করছিল বার বার। আমাকেই বলছিল, স্যার সিসিটিভির ওই রেকর্ডগুলো কোথায়?’
পিলখানা হত্যাযজ্ঞের মতোই বড় আকারের হত্যাযজ্ঞের একটা পরিকল্পনা ছিল বলেও মন্তব্য করেন উপাচার্য।
আন্দোলনকারীরা পরে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, ভাংচুরকারীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের কোন সম্পর্ক নেই। যারা ভাংচুর চালিয়েছে তাদের সঙ্গে কোটা সংস্কার আন্দোলনেরও কোন সম্পর্ক নেই। তারা ভাংচুরকারীদের খুঁজে বের করারও দাবি জানান।
উভয় পক্ষই যেহেতু দাবি করেছেন হামলাকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নয়, সুতরাং এ ঘটনা কোন নাশকতা কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
ভিসি ভবনে হামলার পর আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা
অজ্ঞাতরা ভাংচুর করে বেরিয়ে যাওয়ার পর কিছুক্ষণের মধ্যে বিভিন্ন হল থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ভিসি ভবনের সামনে জড়ো হতে থাকেন। সাঁজোয়া যানসহ পুলিশও জড়ো হয় একই জায়গায়। এরপর একযোগে টিএসসির দিকে অবস্থান করা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।
হামলার ঘটনায় ভীত-সন্ত্রস্ত ছাত্রীরা টিএসসির ভেতরে ঢুকে পড়েন। সারারাত টিএসসির ভেতরেই অবস্থান করেন তারা। টিএসসির ভেতরের মাঠে, ক্যাফেটেরিয়া এবং গেমসরুমে অবস্থান করে ছাত্রীরা সারারাত বিক্ষোভ করতে থাকেন।
মধ্যরাতে হল থেকে বাইরে এসে বিক্ষোভ করার কারণ হিসেবে তারা বলেন, আমার ভাইয়ের রক্ত ঝরবে নিজ ক্যাম্পাসে আর আমরা ঘরে বসে থাকবো, তা কী করে হয়? আর ক্যাম্পাসে এতো পুলিশ কেন? কোন সাহসে তারা আমাদের ওপর গুলি চালায়? প্রশাসন তাহলে কী করে?
সেসময় রোকেয়া হলের কিছু ছাত্রী হল গেটে অবস্থান নেন। তারাও বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন।
তবে, রাত সাড়ে ৩টার দিকেও অনেক ছাত্রী জানতেন না যে আসলে কোন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়নি।
ব্যাপারটি তাদের গোচরে আনলে তারা বলেন, ১২টার পর থেকে টিএসসি এলাকা থেকে ইন্টারনেটে ঢোকা যাচ্ছিল না। তাই তারা আসল খবর জানতে পারেননি। তবে, কেউ নিহত না হলেও তারা ঘরে বসে থাকতেন না বলে জানিয়েছেন অনেক ছাত্রী।
ভোর পৌনে পাঁচটার দিকে টিএসসিতে আসেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল, রোকেয়া হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক জিনাত হুদাসহ কয়েকজন শিক্ষক। তারা ছাত্রীদের বুঝিয়ে হলে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন।
ছাত্রীরা তখন দাবি জানান, হলে প্রবেশের সময় যেনো তাদের নাম, রোল নম্বর লিখে প্রবেশ করতে না হয়।
সকাল ৬টার দিকে ছাত্রীদের সঙ্গে আরেকদফা কথা বলেন প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রাব্বানীসহ ছাত্রী হলের কয়েকজন হাউজ টিউটর। ছাত্রীরা তাদের কাছে দাবি জানান, টিএসসি এলাকায় কোন পুলিশ থাকলে তারা বের হবেন না।
পরে শিক্ষকেরা ঘটনস্থালে উপস্থিত ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়াকে অনুরোধ করলে তিনি পুলিশ ফোর্সকে শাহবাগের দিকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এরপর একে একে বেরিয়ে আসতে থাকেন ছাত্রীরা। সমবেত হয়ে ফিরে যান যে যার হলে।