রাজধানীর মতিঝিল ‘ক্লাবপাড়া’ হিসেবেই পরিচিত। এই এলাকার ক্লাবগুলোর গর্বিত ইতিহাস থাকলেও বেশ কয়েকটি ক্লাবের আড়ালে জুয়া চলত। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে এসব ক্লাব থেকে ক্যাসিনো বোর্ড, জুয়া খেলার সরঞ্জামসহ মাদক জব্দ করে।
মতিঝিলের মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, ভিক্টোরিয়া, আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব, ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাবে ক্যাসিনো ও জুয়া খেলা হতো। তবে মঙ্গলবার বিকেলে সরেজমিনে মতিঝিলের ক্লাব পাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। সেসব ক্লাবে এখন পিন পতন নীরবতা। কোনো কোনো ক্লাব সিলগালা, কোথাও আবার ঝুলছে তালা।
গত বুধবার থেকে ক্লাবগুলোতে অভিযান শুরু করেছে র্যাব। দিন দুয়েক পরে অভিযানে শামিল হয় পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন যেসব ক্লাবগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে সেগুলোতে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।
সন্ধ্যা নামার আগেই ক্লাব এলাকায় নীরবতা
ফকিরেরপুলের ইয়ংমেন্স ক্লাব ও পরে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে র্যাবের অবৈধ ক্যাসিনো উচ্ছেদ অভিযানের পর ওই এলাকার পুরো পরিবেশটা ছিল থমথমে। বর্তমানে সন্ধ্যা নামার আগেই এ এলাকায় নেমে আসে নীরবতা। বেশিরভাগ ক্লাবেই দায়িত্বশীল কেউ নেই।
ফকিরেরপুলের ইয়ংমেনস ক্লাব ও ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে র্যাবের অবৈধ ক্যাসিনো উচ্ছেদ অভিযানের পর সিলগালা করে দেয়া হয়েছে।
স্থানীয় এক বাসিন্দা নূর হোসেন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, কিছুদিন ক্লাব এলাকা জাকজমক থাকলেও এখন সন্ধ্যাতেই ভূতের গলিতে পরিণত হয়। কেউ এদিকে আসে না। অভিযানের পর সবার মধ্যে ভয় কাজ করছে।
দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবে ঝুলছে তালা
দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবের প্রধান ফটকে ঝুলছে তালা। এই ক্লাবে জুয়া চলতো বলে স্থানীয় দোকানিরা অভিযোগ করেন। সন্ধ্যার পর এই ক্লাবের সামনে অনেক গাড়ি থাকতো বলেও অনেকে জানান। তবে শনিবার সন্ধ্যার পর ক্লাবটিতে অন্ধকার দেখা গেছে। জুয়া তো দূরের কথা- ক্লাবের সদস্যরাও এখন আর ভুলেও কার্ড নিয়ে বসেন না। বেশিরভাগ ক্লাবের সদস্যদের কেউ এখন আর ক্লাবমুখী হন না।
নীরব জনশূন্য মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব
মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবও জনশূন্য হয়ে পড়েছে। এই ক্লাবের বাড়তি টিনশেড ঘরে জুয়া হতো বলে স্থানীয় লোকজন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জানিয়েছেন। তবে সেগুলো এখন আর নেই। ক্লাবগুলোর সামনের বড় বাতিগুলো অনেকটাই নিষ্প্রভ। কর্মকর্তারা কেউ কেউ গা ঢাকা দিয়েছেন, যারা আছেন তারাও ক্লাবমুখো নন।
‘কোথাও কেউ নেই’ আরামবাগ ও আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবে
আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের প্রধান ফটক খোলা থাকলেও ভেতরে আলো জ্বলেনি। ক্লাবের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই ক্লাবের দোতলায় জুয়া হতো বলে অভিযোগ রয়েছে। কয়েকদিন ধরেই ক্লাবটিতে অন্ধকার দেখা যায়। আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের ভেতরেও কাউকে দেখা যায়নি।
জড়িতরা কে কোথায়?
মতিঝিল ও পল্টন এলাকার ক্লাবপাড়াসহ রাজধানীর অন্যান্য এলাকায় ক্যাসিনো চালাতেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও তার সহযোগীরা। খালেদ মাহমুদ গ্রেপ্তারের পর গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আছেন।
অভিযোগ আছে, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট নিজে সরাসরি ক্যাসিনো দেখাশোনা না করলেও তার ছত্রছায়ায় ক্যাসিনো চালাতেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওসার ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর একেএম মমিনুল হক ওরফে সাঈদ। এছাড়া মতিঝিলে আরও কয়েকজন সহযোগী রয়েছে তার। তারা সবাই গা ঢাকা দিয়েছেন। অপরদিকে আবু কাওসার ও মমিনুল হক দেশের বাইরে। সম্রাট তার অনুসারীদের নিয়ে গত কয়েকদিন কাকরাইলে নিজ কার্যালয়ে অবস্থান করলেও সোমবার সকাল থেকে কার্যালয়ে যাচ্ছেন না। তিনি কোথায় অবস্থান করছেন এ ব্যাপারে কেউ কিছু বলতে পারছেন না।
এদিকে সম্রাটের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। গত রোববার এ সংক্রান্ত একটি আদেশ দেশের বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে পাঠানো হয়েছে। পুলিশের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র এ তথ্য চ্যানেল আই অনলাইনকে নিশ্চিত করে বলেছে, সম্রাট এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে আছেন।
এ ছাড়া সম্রাট ও ভোলা-৩ আসনের সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও জি কে শামীম এবং কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলমের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত (অবরুদ্ধ) করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
৪টি ক্যাসিনো সিলগালা, গ্রেপ্তার ২১৫
বুধবার রাত থেকে অবৈধ জুয়া-ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে শুরু হওয়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চারটি ক্যাসিনোতে সাঁড়াশি অভিযান চালায় র্যাব। অভিযানে মোট ২১৫ জন গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেয়া হয়েছে ২০১ জনকে। যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, জি কে শামীম এবং কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজসহ ১৩ জন রিমান্ডে আছেন। এছাড়াও জব্দ করা হয়েছে বিপুল অংকের টাকা, মদ ও বিয়ারসহ জুয়া খেলার বিভিন্ন সরঞ্জাম। অভিযানে সিলগালা করে দেয়া ক্যাসিনোগুলো হলো ফকিরেরপুলের ‘ইয়ংমেনস ক্লাব’, বনানীর ‘গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ’, গুলিস্তানের ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র’ এবং মতিঝিলের আরামবাগে ‘ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব’ ।
র্যাব জানায়, ইয়ংমেনস ক্লাবে আটক করা ১৪২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। সেখান থেকে ১২টি জুয়ার বোর্ড জব্দ করা হয় ১২টি। এখান থেকে মদ, বিয়ার ও বিপুল অংকের টাকা উদ্ধার করা হয়। জুয়া খেলার নগদ টাকা ১০ লাখ, মদের বোতল, তাস উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়াও গুলিস্তানের বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রে অভিযান চালিয়ে জুয়ার বোর্ডসহ মাদকদ্রব্য জব্দ করে র্যাব। ক্লাবটি থেকে ৩৯ জনকে আটক করে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
অনুমোদনহীন ক্যাসিনো বোর্ড এলো কীভাবে?
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর জানিয়েছে, কখনো জুতার সরঞ্জাম, কখনো কম্পিউটার এবং মোবাইল পার্টস, আবার কখনো ফার্নিচার; এসব নামে দেশে বিভিন্ন সময়ে আমদানি হয়েছে ক্যাসিনোতে ব্যবহৃত ডিজিটাল জুয়ার সরঞ্জাম।
আবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি নীতির সুযোগ নিয়ে সরাসরি ক্যাসিনোর নামে রোলেট গেম টেবিল, পোকার গেইম, ক্যাসিনো ওয়ার গেইম টেবিল ইত্যাদি সরঞ্জাম আমদানি হয়।
জানা যায়, ক্যাসিনোতে জুয়ায় ব্যবহৃত প্রতিটি মেশিন ও সরঞ্জামের দাম প্রায় লাখ টাকা থেকে তিন কোটি টাকা। যেখানে বে-নামে এসব সরঞ্জাম এনে কোটি কোটি টাকার শুল্ককর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।
২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গত ১০ বছরে মোট পাঁচটি আমদানিকারকের হাত ধরে আসা এসব চালানের তথ্য বিশ্লেষণ করে ওই তথ্য-প্রমাণ বেরিয়ে এসেছে। ক্যাসিনোতে ব্যবহৃত এই ধরনের সরঞ্জামের আমদানিকারক এ এম ইসলাম অ্যান্ড সন্স, ন্যানাথ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, পুস্পিতা এন্টারপ্রাইজ, বি পেপার মিলস লিমিটেড ও এ থ্রি ট্রিড ইন্টারন্যাশনাল।
পুলিশের তালিকায় রাজধানীতে দেড় শতাধিক ক্যাসিনো
রাজধানীতে ক্যাসিনো-জুয়া খেলা হয় এমন দেড় শতাধিক স্পটের তালিকা ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের (ডিএমপি) টেবিলে। ডিএমপির ৮টি অপরাধ বিভাগ এবং ৪টি গোয়েন্দা বিভাগের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে এ তালিকা করা হয়েছে। তালিকা ধরে ধরে অভিযান চলছে। চলমান অভিযানের মুখে এসব ক্লাবের অধিকাংশই বন্ধ। আর যাতে চালু না হয় সে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, যেসব জায়গায় ক্যাসিনো এবং বড় বড় জুয়ার আড্ডা চলে সেসব জায়গার তালিকা এরই মধ্যে হাতে পেয়েছি। তালিকা বেশ লম্বা, দেড় শতাধিক। চলমান অভিযানের মুখে এখন সব আস্তানার ক্যাসিনো-জুয়া বন্ধ হয়ে গেছে।ক্যাসিনোর বিষয়ে এ পর্যন্ত যেসব মামলা হয়েছে সেগুলো ডিএমপি তদন্ত করবে না। সেগুলোর তদন্ত করবে র্যাব। ইতোমধ্যেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, ক্যাসিনোর টাকার ভাগ সাবেক যেসব কর্মকর্তার পকেটে গেছে তাদের বিষয়ে হয়তো তেমন কিছু করতে পারব না। তবে যারা এখনও পুলিশের দায়িত্বশীল পদে কর্মরত আছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাদের বিষয়ে ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড অ্যানালাইসিস ডিভিশনের (আইএডি) মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে আইএডি শাখায় বেশ কয়েকজনকে নিয়োগ করা হয়েছে।