চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

মকবুল-সাইমুম-ওসমান: তাদের কীর্তির চেয়েও তারা মহান

হুমায়ুন আজাদ  ১৯৮৫ সালে আত্মবিশ্বাসের সাথে লিখেছিলেন, আমি জানি সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে। এখন ২০১৮।  হুমায়ুন আজাদের কবিতাটির বয়স এখন ৩৩। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আবার এই ৩৩ নিয়েই লিখেছিলেন, ‘তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি।’ সুনীলের কথা কেউ না রাখলেও ৩৩ বছর পর দেখা যাচ্ছে হুমায়ুন আজাদ কথা রেখেছেন। তার ভবিষ্যৎবাণী সত্যি হচ্ছে। সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাচ্ছে।

পাঠক ভাবতে পারেন হঠাৎ করে কী এমন হলো যে এমন নেতিবাচক কথা বলতে হলো? গত দুই তিনদিনে যারা পত্রিকায় চোখ রেখেছেন, ফেসবুকে স্ক্রল করেছেন তারা নিশ্চয় তিনটা খবর কয়েকবার পড়েছেন। দুইটা ভিডিও কয়েকবার দেখেছেন। না দেখলে বা না পড়লে সময় করে পড়ে নিন। বাংলাদেশে থাকবেন আর এইসব খবর পড়বেন না, ভিডিও দেখবেন না, তাহলে তো পিছিয়ে যাবেন।

প্রথমেই দেখতে হবে শমরিতা মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীদের বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলনের একটি ভিডিও। আন্দোলনরত মেডিকেল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে সরে যাবার হুমকি দিয়ে শমরিতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ এম মকবুল হোসেন বলেন, ‘আমার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে সরকার। যারা ইতরামি করবে, খুলি উড়িয়ে দেব।’

বাংলা চলচ্চিত্রের এক সময়কার ভিলেন ডিপজলের মুখ থেকে এ ধরণের ডায়ালগ শোনা যেত। ডিপজল এখন আর ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করেন না। ফলে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে রয়েছে ভিলেন সংকট। ডিপজলের জায়গা দখল করতেই মকবুল হোসেন এই পন্থা বেছে নিলেন নাকি এমন প্রশ্ন করেছেন অনেকেই।

গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তিনি আরও কিছু শব্দ বলেন। যা ভদ্রলোকের লেখা ও পড়া উচিত না। প্রকাশ্য রাস্তায় শিক্ষার্থীদের গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেওয়ার বুলি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে মকবুল হোসেন কথা রাখলেন। সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে, কথাটা এভাবে ‘কথা রাখবে’ কেউ কি ভেবেছিলেন?

জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারী দাশ লিখেছিলেন, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।’ আমাদের দেশে যে কথা বলার চেয়ে কাজ করার ছেলে বেশি হয়ে যাচ্ছে তার আরেকটি প্রমাণ কক্সবাজারের রামুর সাংসদ সাইমুম সারওয়ার।

তিনি খুলি উড়িয়ে দেওয়ার কথা না বলে কাজ করে দেখিয়েছেন। গত রোববার তুই-তুকারি করে শিক্ষকের ছেলেকে গায়েব করে দেওয়ার হুমকির সাথে গলা ধাক্কা দিয়েছেন শিক্ষকের। কুসুমকুমারী দাশের কথা এভাবে প্রয়োগ হবে সেটা হয়তো কবি নিজেও ভাবেননি। এর আগে আমরা দেখেছিলাম নারায়ণগঞ্জের সাংসদ নাসিম ওসমান এক শিক্ষককে লাঞ্ছনা করেন। যদিও সেই শিক্ষক লাঞ্ছনার প্রতিবাদে সরব হয়ে উঠেছিল সারাদেশ। এবার কেউ টু শব্দটি করছে না।

যেমন টু শব্দ করছে না নাসিম ওসমানের ভাই নারায়ণগঞ্জের আরেক সাংসদ শামীম ওসমানের কীর্তিতেও। মঙ্গলবার তার লোকজন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত মেয়র সেলিনা হায়াত আইভির উপর হামলা করে। অস্ত্র উঁচিয়ে মারতে আসে। বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে মেয়র আইভিসহ শতাধিক নেতাকর্মী ও সাংবাদিককে আহত হন।

গত মেয়র নির্বাচনে আমরা দেখেছিলাম শামীম ওসমান আইভিকে বোন ডাকছেন। একসাথে আইসক্রিম খেলেন। বোনকে শাড়ি উপহার দিলেন। বোন আবার সেই শাড়ি পরে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিলেন। নির্বাচনের আগেই ভাই বললেন, আইভির বিজয় কনফার্ম। হলোও তাই। তখন সবাই ভেবেছিল অপরাধের জনপদে শান্তি ফিরে আসবে। সব বিরোধের অবসান হবে।

কিন্তু মঙ্গলবারের ঘটনায় চরম আশাবাদীও হতাশ হতে বাধ্য। এভাবে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দীর্ঘদিন পর দেখল এদেশের জনগণ। এতে করে প্রমাণ হলো শামীম ওসমানরা এখনো শামীম ওসমানই রয়েছেন।

তিনদিনের ব্যবধানে সরকারের তিন সাংসদ মকবুল, সাইমুম, ওসমান নিজ নিজ কর্ম দিয়ে তাদের কীর্তির চেয়েও তারা কতটা ‘মহান’ সেই প্রমাণই যেন দিলেন। এসব ক্ষেত্রে তারাই কেবল তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী। এভাবে চলতে থাকলে ‘সংসদ সদস্য’ শব্দটাকেই মানুষ এড়িয়ে চলতে শুরু করবে।