‘বড় ব্যবসায়ীদের ভয় পাচ্ছেন? ভয় পেলে এ চাকরি করার দরকার কী? ঘরে গিয়ে রান্নাবান্নার কাজ শুরু করুন।’
ভেজাল বা নিম্নমানের খাদ্যপণ্য বাজার থেকে জব্দ না করায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের প্রতি চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে বৃহস্পতিবার এ মন্তব্য করেন হাইকোর্ট।
এসময় বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইনজীবী মো. ফরিদুল ইসলামের উদ্দেশে বলেন: ‘১২ তারিখের আদেশে ভেজাল বা নিম্নমানের খাদ্যপণ্য প্রত্যাহার ও বাজার থেকে জব্দ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এতদিনে একটি সামান্য মসলার প্যাকেটও জব্দ করতে পারল না! আপনারা কি হাইকোর্টকে হাইকোর্ট দেখাচ্ছেন?’
এসময় আদালত চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন: ‘ভদ্রতার একটি সীমা আছে। আমাদের ভদ্রতাকে দুর্বলতা মনে করবেন না। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ১ জন ম্যাজিস্ট্রেট সহ বাকি জনবল নিয়ে একটি ভেজাল বা নিম্নমানের পণ্যও জব্দ করতে পারলেন না? তাহলে আপনাদের অফিস রাখার দরকার কী? এসব পণ্য উৎপাদনকারী বড় বড় ব্যবসায়ীদের ভয় পাচ্ছেন? ভয় পেলে এ চাকরি করার দরকার কী? ঘরে গিয়ে রান্নাবান্নার কাজ শুরু করুন। কিংবা ব্যাংকে গিয়ে কেরানির চাকরি শুরু করুন।’
একপর্যায়ে আদালত বলেন: আমরা মনে করি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ভেজাল বা নিম্নমানের খাদ্যপণ্য বাজার থেকে সরানো বা জব্দের বিষয়ে যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা কেবলই ‘আই ওয়াশ।’
এরপর ভোক্তা অধিকারের আইনজীবী কামরুজ্জামান কচি তাদের প্রতিবেদন তুলে ধরে ভেজাল বা নিম্নমানের পণ্য জব্দ ও প্রত্যাহার এবং জরিমানা করার তথ্যাদি আদালতে তুলে ধরলে আদালত এতে সন্তোষটি প্রকাশ করেন।
এরপর হাইকোর্ট বিএসটিআই’র পরীক্ষায় প্রমাণিত ৫২টি ভেজাল বা নিম্নমানের খাদ্যপণ্য বাজার থেকে সরিয়ে নেয়ার আদেশ বাস্তবায়ন না করায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে তলব করেন। আগামী ১৬ জুন তাকে সশরীরে হাইকোর্টে হাজির হয়ে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
সেই সঙ্গে আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন না করায় কেন তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি বিএসটিআই ৪০৬টি খাদ্য পণ্যের নমুনা সংগ্রহ করে ৩১৩টি পণ্যের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করে। এক্ষেত্রে বাকি যে ৯৩ টি পণ্যের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়নি তার ফলাফল প্রতিবেদন আকারে আগামী ১৬ জুনের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে বিএসটিআইকে আজ নির্দেশ দেওয়া হয়। বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের বেঞ্চ বৃহস্পতিবার রুলসহ এসব আদেশ দেন।
আজ আদালতে রিটের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান। রাষ্ট্র পক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেসুর রহমান। আর বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পক্ষের ছিলেন আইনজীবী মো. ফরিদুল ইসলাম। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী কামরুজ্জামান কচি।
এর আগে গত ১২ মে হাইকোর্ট বিএসটিআই’র পরীক্ষায় প্রমাণিত ৫২টি ভেজাল বা নিম্নমানের খাদ্যপণ্য বাজার থেকে অবিলম্বে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেন। এছাড়া হাইকোর্ট তার আদেশে এই ৫১ খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। এবং মান উন্নীত না হওয়া পর্যন্ত এসব খাদ্যপণ্যের উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। আর আদালতের এই আদেশ বাস্তবায়ন করে ১০ দিনের মধ্যে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে হাইকোর্টে প্রতিবেদন দিতে বলে এ বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য ২৩ মে দিন ধার্য করেন। সে ধারাবাহিকতায় আজ আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তারপর এবিষয়ে শুনানির পর আদেশ দেন হাইকোর্ট।
এর আগে গত ৯ মে হাইকোর্টে বিএসটিআই’র পরীক্ষায় প্রমাণিত ৫২টি ভেজাল বা নিম্নমানের খাদ্যপণ্যের বিষয় নিয়ে রিট করে কনসাস কনজ্যুমার সোসাইটি।
যে ৫২ টি পণ্যকে নিম্নমানের ও ভেজাল বলে বিএসটিআই উল্লেখ করে সেগুলো হলো: গ্রীণ ব্লিচিং এর সরিষার তেল, শমনমের সরিষার তেল, বাংলাদেশ এডিবল ওয়েলের সরিষার তেল, সিটি ওয়েলের সরিষার তেল, কাশেম ফুডের চিপস, আরা ফুডের ড্রিংকিং ওয়াটার, আল সাফির ড্রিংকিং ওয়াটার, মিজান ড্রিংকিং ওয়াটার, মর্ণ ডিউয়ের ড্রিংকিং ওয়াটার, ডানকান ন্যাচারাল মিনারেল ওয়াটার, আরার ডিউ ড্রিংকিং ওয়াটার, দিঘী ড্রিংকিং ওয়াটার, প্রাণের লাচ্ছা সেমাই, ডুডলি নুডলস, শান্ত ফুডের সফট ড্রিংক পাউডার, জাহাঙ্গীর ফুড সফট ড্রিংক পাউডার, ড্যানিশের হলুদের গুড়া, প্রাণের হলুদ গুড়া, ফ্রেশের হলুদ গুড়া, এসিআইর ধনিয়ার গুড়া, প্রাণের কারি পাউডার, ড্যানিশের কারী পাউডার, বনলতার ঘি, পিওর হাটহাজারী মরিচ গুড়া, মিস্টিমেলা লাচ্ছা সেমাই, মধুবনের লাচ্ছা সেমাই, মিঠাইর লাচ্ছা সেমাই, ওয়েল ফুডের লাচ্ছা সেমাই, এসিআইর আয়োডিন যুক্ত লবণ, মোল্লা সল্টের আয়োডিন যুক্ত লবণ, কিং’য়ের ময়দা, রুপসার দই, মক্কার চানাচুর, মেহেদীর বিস্কুট, বাঘাবাড়ীর স্পেশাল ঘি, নিশিতা ফুডস এর সুজি, মধুবনের লাচ্ছা সেমাই, মঞ্জিলের হলুদ গুড়া, মধুমতির আয়োডিন যুক্ত লবন, সান ফুডের হলুদ গুড়া, গ্রীন লেনের মধু, কিরনের লাচ্ছা সেমাই, ডলফিনের মরিচের গুড়া, ডলফিনের হলুদের গুড়া, সূর্যের মরিচের গুড়া, জেদ্দার লাচ্ছা সেমাই, অমৃতের লাচ্ছা সেমাই, দাদা সুপারের আয়োডিন যুক্ত লবণ, মদীনার আয়োডিন যু্ক্ত লবণ, নুরের আয়োডিনযুক্ত লবণ।