‘‘একজন নেতা সারাদিন নির্বাচনী ভাষণ দিয়ে বাড়ি ফিরে এসে চাকরকে বললেন, এই হাবু, আমার হাত-পা একটু টিপে দে তো! বড্ড ব্যথা করছে।
হাবু বলল, স্যার, চেঁচিয়ে তো আপনার গলা বেশি ক্লান্ত। আগে আপনার গলাটা টিপে দিই?’’
হ্যাঁ, নির্বাচনকে ঘিরে গগণবিদারী চিৎকার শুনে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, সত্যিই যদি গলাটা টিপে দেয়া যেত! কিন্তু ভাবলেই তো আর সব কিছু করা যায় না। আপাতত ভোটের এই চিৎকার—আওয়াজ-হট্টগোল মেনে নিতেই হবে। গণতন্ত্র বলে কথা!
‘ভোটের আগে প্রার্থী হয়ে বাড়ি বাড়ি যায়, জনে জনে ঘুরে ঘুরে ভোট ভিক্ষা চায়।’ আমাদের দেশে এখন চলছে ভোট-ভিক্ষার চূড়ান্ত মৌসুম। ভোট-ভিক্ষার জন্য সব প্রার্থী এখন মাঠে নেমে পড়েছে। বিএনপি-জামায়াতের অনেক প্রার্থী আছেন, যারা পুলিশের ভয়ে সরাসরি মাঠে নামতে ভয় পাচ্ছেন, তারাও পরিবারের সদস্য কিংবা অন্য কোনো প্রতিনিধি মারফৎ ভোট-ভিক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ভোট বড় বালাই। ‘ভোটের নাম বাবাজি।’ রাজনীতির ‘ঘোলা জলে’ ভোটের কারবারিরা তো হামেশাই নামেন। এজন্য তাদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। ভোটার-আকৃষ্ট করতে নানা সাধ্য-সাধনা করতে হয়। জনগণের কাছে ভোট চাইতে গিয়ে নেতা-নেত্রীরা কি না করেন! কেউ দেদার উপঢৌকনের প্রতিশ্রুতি দেন তো কেউ সব সমস্যা সমাধান করে দেয়ার কথা বলেন। ভোট দিলে নিজের সর্বস্ব জনতাকে বিলিয়ে দেয়ার অঙ্গীকারের উদাহরণও আছে বেশ কিছু। ভোট চাইতে গিয়ে নিজেকে জুতোপেটা করার মতো নজিরও আছে, তবে সেটা ঘটেছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে। সেখানে কিছুদিন আগে প্রকাশ্য জনসভায় নিজের কুর্তা পেতে ভোট ভিক্ষা করেও যখন জনতার মন গলাতে পারছিলেন না, তখনই আগের সব ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিজেকেই জুতোপেটা করেছিলেন উত্তরপ্রদেশের বুলন্দশহর বিধানসভা অঞ্চলের সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী সুজাত আলম। ভোট পাওয়ার জন্য, ভোটারের মন পাবার জন্য প্রার্থীদের কসরতের কোনো শেষ নেই!
আমাদের দেশের প্রার্থীরাও আপাতত মহাব্যস্ত ভোট-ভিক্ষায়। শিয়রে ভোট। প্রার্থীরা সব দলে দলে নেমে পড়েছেন ভোটভিক্ষায়। মাইলের পর মাইল হাঁটছেন। করজোড়ে ভোট-ভিক্ষা চলছে, আমজনতার সুখ-দুঃখের খবর নিচ্ছেন। কেউ কেউ সাধারণ মানুষকে জড়িয়ে ধরছেন, আবেগে। ফুটপাতের দোকান থেকে জলের জগ তুলে নিয়ে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছেন প্রার্থী। রিকশাওয়ালা, হকার, সবজিওয়ালি— সবার সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিশে প্রার্থী বোঝাতে চাইছেন ‘আমি তোমাদেরই লোক’। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে এই রকম টুকরো টুকরো দৃশ্য দেখলে সত্যিই বেজায় আনন্দ হয়। ভিন্ন ভিন্ন রং, ভিন্ন ভিন্ন রাজনীতি, কিন্তু এই ভোট-ভিক্ষার বেলায় সবাই কী অভিন্ন সুন্দর!
কথায় আছে এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার৷ কিন্তু অনেকে এখন ভালোবাসা আর যুদ্ধের পাশাপাশি রাজনীতিটাকেও রাখতে চান৷ কারণ তারা মনে করেন রাজনীতিতেও সবকিছুই ‘ফেয়ার’৷ তা না হলে নির্বাচনে নিজের চরম প্রতিদ্বন্দ্বীর বাড়িতে গিয়ে কি ভোট চাওয়ার ইচ্ছা জাগে কোনও প্রার্থীর? হ্যাঁ, তেমনটাও ঘটছে! এক প্রার্থী ভোটের জন্য আরেক প্রার্থীর বাসায় পর্যন্ত যাচ্ছেন।
ভোটাররা এখন থেকে মূল্যবান মানুষ। প্রার্থীরা যেন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা! তারা দোরে-দোরে জনে-জনে ভোট ভিক্ষা করছেন।
একপক্ষ চাইছে তাদের উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখার সুযোগ, আর তাই চাই বিজয়; অপর পক্ষ বলছে মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার লড়াইয়ের অংশ এ নির্বাচন, আর তাই চাই বিজয়। আওয়ামী লীগ চায় ২০২১ সালে ক্ষমতায় থেকে বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করতে। আর বিএনপি চায় নির্বাচনে জয়লাভ করে বেগম জিয়া ও তারেক রহমানকে মুক্ত করে দলের পূর্ণ শক্তি ফিরিয়ে আনতে। আর এ জন্য উভয় পক্ষই আজ ভিক্ষুকের মতো দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন! যদি প্রতিশ্রুতি মেলে। যদি ভোটটা পাওয়া যায়।
ভোট-ভিক্ষার এই চিত্রটি শুধু আজকের নয়। দাদাঠাকুর তো কবেই লিখেছেন, ‘আমি ভোটের লাগিয়া ভিখারি সাজিনু, ফিরিনু গো দ্বারে দ্বারে।’ যদিও আমরা সকলেই জানি, এই ভিক্ষুকের সাজ ক্ষণিকের। প্রার্থীরা প্রায় সকলেই রাজা, তবুও কেমন যেন ভালো লাগে। যখন প্রার্থীরা সাধারণকে মান্য করে বলছেন, ‘মানুষ যা চাইবেন, তা-ই হবে, আমার সঙ্গে কেউ না থাক, মানুষ আছে,’ তখন সাধারণ মানুষ এক অদৃশ্য-গুরুত্বের ছোঁয়ায় ক্ষণিকের জন্য উদ্বেল হয় বইকী।
প্রাক্-ভোট পর্বে এই মানবদরদিয়া প্রার্থীদের দেখলে মনে হয় না, ভোটে জিতেই এদের অধিকাংশ কর্পূরের চেয়েও দ্রুত গতিতে উধাও হয়ে যান, বা ইতিউতি দেখা গেলেও, সাধারণ মানুষের ইচ্ছে-অনিচ্ছেগুলি বেমালুম ভুলে যান। তখন তার পদযুগল আর সাধারণের রাস্তা মাড়ায় না। তিনি থাকেন সরকারি দফতরে, সরকারি গাড়ির দূরত্বে। ‘রহিম শেখ’, ‘করিম ব্যাপারী’রা তাদের দফতরের চৌহদ্দিতে যাওয়ার সাহসটুকুই পান না। আর সে সাহস অর্জন করলেও শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কাঁচঘরে ঢোকা দূরস্থান, হাজার পেয়াদা, অজস্র প্রশাসনিক স্তর— বিস্তর হ্যাপা। সমবেত হয়ে কোনও ন্যায্য দাবিদাওয়া তুলতে বা প্রশ্ন করতে চাইলে পুলিশের প্যাঁদানিই দস্তুর। তবে, মন্ত্রী-সান্ত্রিরা যে কারও সঙ্গে দেখা করেন না তা নয়, প্রোমোটার, ব্যবসায়ী ধনকুবের, দাপুটে মস্তানদের জন্য তার দরাজ দরজা। যতই হোক, তিনি জনপ্রতিনিধি।
অপ্রিয় প্রসঙ্গ ছেড়ে মধুর সময়টুকুই বরং মনে রাখি। এই মিষ্টি ছলনাটুকু। যা দিনকাল পড়েছে, অদূর ভবিষ্যতে এই মোহনীয় ছলনাটুকুও দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাবে। ভোটপ্রার্থীদের এই ভণিতাটুকুর প্রতি আমাদের আস্থা থাক। সাধারণ মানুষের জন্য তাদের এই যে অসাধারণ অনুভব, এই যে আমজনতার হাত ধরে কয়েক কদম হেঁটে যাওয়া, পাড়ার ভিতর ঢুকে ঘরের ছেলের মতো বয়স্কদের শরীর-স্বাস্থ্যের খোঁজ নেওয়া, করজোড়ে মাথা নুইয়ে জনে জনে কুশল জিজ্ঞাসা— এর মধ্যে কৌশল খুঁজতে যাওয়া পাপ। দাওয়া থেকে শিশুকে কোলে তুলে গাল টিপে দিচ্ছেন প্রার্থী, মা খুশিতে ডগমগ। অশীতিপর বৃদ্ধার দু’টি হাত পরম মমতায় হাতে তুলে, মাথায় ঠেকিয়ে নিজেই আশীর্বাদ নিচ্ছেন প্রার্থী, আদুড় গায়ে ফেরা শিশুর তেলচিটে মাথার চুলটা একটু ঘেঁটে দিয়ে খুনসুটি করছেন প্রার্থী, ফিক করে হেসে ফেলছে অবুঝ কিশোর— এই সব নানা চিত্রহারে মোড়া প্রার্থীর ভোট-ভিক্ষা বড়ই নয়নাভিরাম। হোক মিথ্যা, হোক ছলনা, কিন্তু দৃশ্য অতুলনীয়।
ভোট ও ভোট-পরবর্তী অভিজ্ঞতা আমাদের শিক্ষা দিয়েছে যে, নেতারা অনেক বড় মাপের অভিনেতা। ইদানীং অনেক অভিনেতাও নেতা হওয়ার দৌড়ে শামিল হচ্ছেন, যদিও অধিকাংশ মুখ থুবড়ে পড়ছেন। সে অন্য প্রসঙ্গ। তবে নেতারা যে প্রায় প্রত্যেকেই উঁচু দরের অভিনেতা, তা একপ্রকার পরীক্ষিত সত্য। ইদানীং হাজার গণমাধ্যমের ঠেলায় অধিকাংশ জনগণও অবশ্য যথেষ্ট কুশলী; কৌশলীও বলা যায়। নেতা বা অভিনেতা, কোনওটিকেই আর তারা ভিন গ্রহের মনে করেন না। সহস্র সংবাদমাধ্যমের দৌলতে তারা চেনা মুখ, চেনা মুখোশ। তাই ভোট-ভিক্ষা পর্বে সংঘটিত মধুর ছলনাটি বোধহয় এখন উভয় পক্ষেরই। দাতা ও গ্রহীতা, পরস্পর মুখোমুখি, হাসি, কুশল বিনিময়, নেপথ্যে সুচতুর ভাবে লুকোনো লাভ-ক্ষতির হিসেব, ভোটের অঙ্ক, এ ছাড়াও নানান হিস্সা— এ সব দেখে গণতন্ত্রের দেবতা বোধহয় হাসেন আর ভাবেন— যাক, ভোটপ্রার্থী তো ভোট-ভিক্ষায় গেছেন, এ জয় আমারই জয়!
পুনশ্চ: একটি পুরোনো কৌতুক!
সাংবাদিক: আপনি কেন নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন?
প্রার্থী: চারদিকে কী ঘটছে, দেখছেন না? সরকারি লোকেরা আমোদ-প্রমোদে মত্ত, দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে দেশ।
সাংবাদিক: আপনি এর বিরুদ্ধে লড়ার জন্যই নির্বাচন করছেন?
প্রার্থী: পাগল নাকি! আমার কি আমোদ-প্রমোদ করতে শখ হয় না?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)