ভেনেজুয়েলার ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর আনুগত্য ত্যাগ করে কলম্বিয়ার পক্ষ নেয়া সৈন্যরা তাদের পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে চরম উদ্বেগের মধ্যে আছেন।
সম্প্রতি বিবিসি’র সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে সৈন্যদের অনেকেই এই শঙ্কার কথা জানান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২৩ বছর বয়সী একজন বলেন: ‘প্রেসিডেন্টের অনুগত সৈন্যরা আমাদের পরিবারের সদস্যদের আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু তারপরও মাদুরোর পক্ষ ত্যাগ করা আমার জীবনের সেরা একটি সিদ্ধান্ত ছিল।’
অন্তত ১০০ জনেরও বেশি সৈন্য সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে বলে জানা গেছে।
প্রতিবেশি রাষ্ট্র কলম্বিয়া ও ব্রাজিল সীমান্তের সড়ক এবং সেতুগুলো বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণার পর থেকে ভেনিজুয়েলার সংকট আরো গভীরতর হয়েছে। সেখানে কোনোভাবে ত্রাণ কিংবা জরুরী ওষুধপত্র পৌঁছানো যাচ্ছে না।
বেশ কিছু সীমান্ত সংযোগ এলাকায় ভেনেজুয়েলার নিরাপত্তা বাহিনী টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে স্বেচ্ছাসেবকদের প্রতিহত করেছে। ফলে সীমান্ত দিয়ে বিদেশি সাহায্য আনা নিয়ে ভেনেজুয়েলায় ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়েছে। সীমান্তগুলো বর্তমানে আংশিকভাবে বন্ধ করে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট।
শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্র এক বিবৃতিতে ভেনেজুয়েলা সীমান্তে সেনাবাহিনীর গুলিতে দুই আদিবাসী নিহত এবং ব্রাজিলের সঙ্গে ভেনেজুয়েলার সীমান্তে নিরস্ত্র বেসামরিক লোক এবং নিরীহ স্বেচ্ছাসেবকদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর শক্তি প্রয়োগের তীব্র নিন্দা জানায়।
দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে সহযোগিতা করার কারণে কলম্বিয়ার সাথে সব রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে ভেনেজুয়েলা।
এছাড়া ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কলম্বিয়ার কূটনীতিকদের ভেনেজুয়েলা ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। শনিবার রাজধানী কারাকাসে জনসমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে একথা জানান মাদুরো।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী নীতির মোকাবেলায় দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংকল্প ব্যক্ত করে মাদুরো বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী দেশগুলো ত্রাণ পাঠানোর নামে ভেনেজুয়েলার সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে ভূলুণ্ঠিত করতে চায়।’
ব্রাজিল ও কলম্বিয়া সীমান্ত দিয়ে যু্ক্তরাষ্ট্রের ত্রাণ ভেনেজুয়েলায় পৌঁছানোর কথা ছিল। বিরোধী দলীয় নেতা ও স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট হুয়ান গুইদোর আহ্বানে এসব ত্রাণ পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের ত্রাণ যেন ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য ব্রাজিল সীমান্ত সিলগালা করে দিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী।
২০১৮-এর নির্বাচনেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন মাদুরো। কিন্তু সেই ফলাফল মানতে নারাজ বিরোধী নেতা জুয়ান গুইদো ও তার সহযোগীরা। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে তারা মাদুরোকে মানতে অস্বীকার করেন।
গত জানুয়ারিতে নিজেকে অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণাও করে দেন গুইদো। রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্বে ভেনেজুয়েলার অবস্থা ইতোমধ্যে আরও খারাপ হয়েছে। ফলে, কলম্বিয়া, আমেরিকার মতো দেশ ভেনেজুয়েলায় ত্রাণ পাঠাতে শুরু করে।
কিন্তু ভেনেজুয়েলা ‘ভিখারি’ দেশ নয় বলে যুক্তি দিয়ে সীমান্ত বন্ধের নির্দেশ দেন মাদুরো। অন্যদিকে গুইদো ত্রাণ নেওয়ার পক্ষে জোর দাবি জানান।
ত্রাণ ঢুকতে দেওয়ার দাবিতেই গত ক’দিন ধরে বিক্ষোভ চলছে ভেনেজুয়েলা সীমান্তে। গুইদোর আশা ছিল, মাদুরোপন্থী সেনাদের নিজের পক্ষে এনে শনিবারের মধ্যেই তিনি সীমান্ত খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবেন, কিন্তু তা হয়নি।
৬০ জন সেনা ইস্তফা দিয়ে কলম্বিয়া চলে গেলেও বাকিরা ত্রাণ সামগ্রী বোঝাই ট্রাক আটকে দেন।
শনিবার দুপুরের দিকে শোনা যায়, ব্রাজিল থেকে আসা ত্রাণসামগ্রী ভর্তি দু’টি ট্রাক সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকতে পেরেছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই জানা যায়, চেকপোস্টে ট্রাক দু’টি আটকে দেওয়া হয়েছে। পরে দু’টি ট্রাককেই ব্রাজিলে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
কিন্তু গুইদো হার মানতে নারাজ। মাদুরো প্রশাসন তার গতিবিধির উপর নিয়ন্ত্রণ জারি করলেও সোমবার মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন গুইদো।
বোগোতার এই বৈঠকে লিমা গ্রুপের আঞ্চলিক দলের প্রতিনিধিরাও থাকবেন। গুইদোর বার্তা, ‘এ লড়াই চলবেই। কিন্তু দেশের মুক্তির জন্য সব বিকল্প খোলা রাখতে হবে।’
অন্যদিকে, মাইক পেন্সও সীমান্তে নিহত বিক্ষোভকারীদের জন্য ন্যায়বিচারের দাবি তুলেছেন।
মাদুরোর ধারণা, ত্রাণ পাঠানোর নাম করে ভেনেজুয়েলায় সেনা ঢোকাবে আমেরিকা, আর তার সরকারের পতন নিশ্চিত করবে। এই আতঙ্ক থেকেই ত্রাণের বিরোধিতা করে যাচ্ছেন মাদুরো।
সীমান্তে বিক্ষোভকারীদের নিরস্ত করতে তার সেনা যখন কাঁদানে গ্যাস, রবার বুলেট ছুড়ছে, তখন এক সমাবেশে দাঁড়িয়ে মাদুরো বলছেন, তিনি আগের থেকে আরও বেশি শক্তিশালী হয়েছেন।
অনুগামীদের প্রতি তার বার্তা, ‘যে বিশ্বাসঘাতকরা দেশে ত্রাণ ঢোকানোর চেষ্টা করছে, তাদের শিক্ষা দিন।’ বিক্ষোভকারীদের প্রাণহানি নিয়ে একটা কথাও শোনা যায়নি তার মুখে। শুধু তাই নয়, সেনাদের কাঁদানে গ্যাসের শেলে আগুন ধরে গিয়েছে ত্রাণসামগ্রী ভর্তি দু’টি ট্রাকেও।
কলম্বিয়া প্রথমে ভেনেজুয়েলাকে সাহায্যের আশ্বাস দিলেও এই অশান্তি এবং তাদের দিকের বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার পর কলম্বিয়াও এখন ভেনেজুয়েলার উপর বেশ ক্ষুব্ধ।
তবে চীন রাশিয়াসহ মার্কিন বিরোধী রাষ্ট্রগুলো মাদুরোর পক্ষ নেয়। ভেনেজুয়েলার সেনাবাহিনীও মাদুরোর পক্ষে থাকার ঘোষণা দেয়।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ হওয়ায় দেশটিতে মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এখন পর্যন্ত দেশটির রাজনৈতিক সংকটের কোনো সমাধান মেলেনি।