চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ভেটকি মাছে বাংলাদেশের সাফল্য

প্রথমবারের মতো কৃত্রিম প্রজননে পোনা উৎপাদন

প্রথমবারের মতো কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ভেটকি বা কোরাল মাছের পোনা উৎপাদনে সফল হয়েছেন বাংলাদেশের মৎস্য বিজ্ঞানীরা। 

গত এক বছর ধরে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীদের চালানো এক গবেষণায় এই সাফল্য এসেছে।

মৎস্য বিজ্ঞানীরা বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার-সোনাদিয়া উপকূলজুড়ে ২৩ বর্গ কি.মি এলাকা কোরাল ও তাইল্যা মাছের প্রজননক্ষেত্র চিহ্নিত করতেও সক্ষম হন।

তবে একে প্রাথমিক সাফল্য মন্তব্য করে বিএফআরআই মহাপরিচালক ও বিশিষ্ট মৎস্য বিজ্ঞানী ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলছেন, ‘গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে শুরু হওয়া এক গবেষণায় প্রথমবারের মতো হ্যাচারিতে কৃত্রিম উপায়ে পোনা উৎপাদনে সাফল্য এসেছে। তবে এ জন্য আরো গবেষণা দরকার।’

‘‘এ বিষয়ে আমরা শতভাগ সাফল্য পেলে দেশের অর্থনীতি তথা সামুদ্রিক মৎস্যক্ষেত্রে এক বিপ্লবের সূচনা হবে। আর এ বিপ্লব সূচনার লক্ষ্যেই কক্সবাজার বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে আরো বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রকল্প চলছে।’’

তিনি বলেন: এর আগে গবেষণার মাধ্যমেই প্রথমবারের কাঁকড়া পোনা উৎপাদনে সাফল্য পান বিএফআরআই বিজ্ঞানীরা। এখন আর দেশে কাঁকড়া পোনার সংকট নেই। গবেষণার মাধ্যমে সম্ভাবনাময় ভেটকিসহ অন্যান্য অর্থকরী মাছেরও কৃত্রিম উপায়ে পোনা তৈরির জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।

বিএফআরআই সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারে পরিচালিত ‘সামুদ্রিক মৎস্য গবেষণা জোরদার ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে’র অর্থায়নে ‘ভেটকি মাছের মা মাছ তৈরি ও কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন গবেষণা’ শিরোনামে একটি গবেষণা প্রকল্প চলছে।

কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল হকে  নেতৃত্বে এ গবেষণা কাজ পরিচালিত হচ্ছে। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে গবেষণা চালানোর পর গত মে মাসে সর্বপ্রথম ভেটকি মাছের কৃত্রিম প্রজননে সাফল্য পাওয়া যায়।

এই গবেষণা চালাতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো কক্সবাজারের কলাতলী থেকে সোনাদিয়া পর্যন্ত ২৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তাইল্যা ও কোরাল মাছের প্রজনন ক্ষেত্র এবং সর্বোচ্চ প্রজননকাল চিহ্নিত করতে সক্ষম হন।

ভেটকি বা কোরাল
ভেটকি বা কোরাল মাছ বাংলাদেশের উপকুলীয় এলাকার অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় বৃহৎ আকারের সামুদ্রিক মাছ। এ মাছ কম কাটাযুক্ত, দ্রুত বর্ধনশীল ও খেতে সুস্বাদু বলে এর বাজারমূল্য বেশি। আর্ন্তজাতিক পর্যায়েও এ মাছের ব্যাপক চাহিদা ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে।

থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ প্রতিবেশী দেশগুলো গত ২/৩ দশক আগেই হ্যাচারিতে কৃত্রিম উপায়ে ভেটকি পোনা উৎপাদনে সক্ষম হলেও বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা ছিলেন পিছিয়ে। অথচ কক্সবাজারসহ বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা ভেটকি বা কোরাল মাছ চাষের উপযুক্ত বলে আরো বেশ কয়েকবছর আগেই মন্তব্য করেছিলেন সফররত একদল মালয়েশিয়ান বিজ্ঞানী।

অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটসহ দেশের উপকুলীয় অঞ্চলে ঘেরের মাঝে চিংড়ির সাথে কোরাল মাছেরও চাষ করা হয়। কোরাল মাছ লবণাক্ত, আধা-লবণাক্ত, এমনকি স্বাদু পানিতেও অধিক ঘনত্বে চাষ করা যায়। এ মাছের রোগ বালাই কম বলে সাম্প্রতিককালে অনেকেই চিংড়ি চাষ বাদ দিয়ে ভেটকি চাষ করে সফল হয়েছেন। তবে পোনা সংকটের কারণে এ মাছের চাষকে সম্প্রসারিত করা যাচ্ছে না। অথচ অর্থনীতিতে এর বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট।

বিজ্ঞানীরা জানান: বাংলাদেশে কোরাল মাছের বৈজ্ঞানিকভাবে চাষ হয় না বললেই চলে। মে-জুন মাসে ঘেরমালিকরা প্রাকৃতিক উৎস থেকে ভেটকি মাছের পোনা সংগ্রহ করে বাগদা চিংড়ি ও অন্যান্য মাছের সাথে সনাতন পদ্ধতিতে চাষ করে থাকে।

ভেটকি মাছের পোনা উৎপাদনের উপর চলমান গবেষণা প্রকল্পের প্রধান, কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল হক জানান: একটি পরিপক্ব স্ত্রী ভেটকি বা কোরাল মাছ ৬০ লাখ থেকে ২ কোটি পর্যন্ত ডিম দিতে সক্ষম। ফলে হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদনের জন্য স্বল্প সংখ্যক মা ভেটকিই যথেষ্ঠ।

তিনি বলেন: তবে চ্যালেঞ্জ হল মা ভেটকি তৈরি হওয়ার জন্য যে ৪-৫ বছর সময়টুকু দরকার, তা রক্ষা করতে হবে। ভেটকি মাছ প্রথমে পুরুষ হয়ে জন্মায় এবং ৪-৫ বছর পর কেউ কেউ স্ত্রীতে রূপান্তরিত হয়। স্ত্রীতে রূপান্তরিত হওয়ার পরই তারা প্রজননের জন্য উপকূলের নদী মোহনার কাছে আসে।

বিজ্ঞানী আশরাফ বলেন: কোরাল মাছের প্রজননকাল এপ্রিল থেকে শুরু হলেও সবচেয়ে বেশি ডিম দেয় মে মাসে। তিনি গত ২৩ মে অবরোধের মাঝে সোনাদিয়া উপকুলে গবেষণা চালানোর সময় কোরাল মাছের ডিম পাড়ার দৃশ্য স্বচক্ষে দেখেন এবং এখান থেকে সংগৃহীত মা মাছ হ্যাচারিতে এনে কৃত্রিম উপায়ে পোনা উৎপাদনেও সক্ষম হয়েছেন বলে জানান।

তবে উৎপাদিত পোনার মর্টালিটি রেট বা বেঁচে থাকার হার এখনও কাঙ্ক্ষিত মানের নয়- মন্তব্য করে বিজ্ঞানী আশরাফুল হক এ বিষয়ে শতভাগ সাফল্য পাবেন বলে দৃঢ়ভাবে আশা করছে। এজন্য এখন নিবিড় গবেষণা চলছে।

যেভাবে পাওয়া গেল প্রজননক্ষেত্র
এই গবেষণার সঙ্গে জড়িত বিজ্ঞানীরা জানান, গত মাসে মহেশখালী চ্যানেল ও বাঁকখালী মোহনার ফাডার চরের আশপাশের আনুমানিক ২৩ বর্গ কিলোমিটার মোহনাঞ্চল জুড়ে তাইল্যা ও ভেটকি মাছের প্রজননক্ষেত্র খুঁজে পান তারা। পরে আরো গবেষণা চালিয়ে তারা এ বিষয়ে নিশ্চিত হন।

এলাকাটি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কলাতলী পয়েন্ট হতে পশ্চিমে আনুমানিক ৮ কিলোমিটার দূরবর্তী সমুদ্র এলাকায় অবস্থিত এবং জেলেদের কাছে ‘ফাড়ার চর’ নামেও পরিচিত।