দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেছেন, সুষ্ঠু ভূমি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পাহাড়ের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা মত্যুভীতি দূর করতে হবে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের পুরকৌশল বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত ‘ভূমিধসের চ্যালেঞ্জ এবং এ থেকে উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন ৷
মায়া বলেন, পাহাড়ের সবুজময় সৌন্দর্য ও আকাঁবাকাঁ বয়ে যাওয়া নদী মানুষের মোহিত করে। কিন্তু পাহাড়ের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে মৃত্যুর শঙ্কাও। এর কিছুটা মনুষ্যসৃষ্ট কিছুটা প্রাকৃতিক। বাংলাদেশে পাহাড় ধস একটা নতুন আতংকের নাম,নতুন দুর্যোগ, নতুন বিপর্যয়।
‘‘শুধু ২০১৭ সালে বাংলাদেশে পাহাড় ধসে ১৬৬ জন লোক মারা গেছেন। এর মধ্যে রাঙামাটি জেলায় মারা গেছেস ১২০ জন। এই সময় ২২৭ জন আহত হয়েছে। ৩ হাজার ৭৫০ বাড়ি সম্পূর্ণ এবং ৩৬ হাজার ৬৩৭টি বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ বছর জুন পর্যন্ত মারা গেছে ২৭ জন মানুষ। পার্বত্য ৩টি জেলার আয়তন ১৩ হাজার ২৯৫ কিলোমিটার। এ অঞ্চলের লোকসংখ্যা প্রায় ১৬ লক্ষ। কিন্তু এ এলাকার কত অংশ ভূমি মানুষের বসবাসের উপযোগী সেটা জরিপের অবকাশ রয়েছে। অপরিকল্পিত শহরায়নের ফলে দরিদ্র সহায়সম্বল ও ভিটে-মাটিহীন মানুষেরা নিতান্ত বাধ্য হয়েই এখানে বসবাস করছে। ১৬ শতকের প্রথম দিকে আরাকানের অধিবাসীদের অত্যাচারে ভিটেমাটি ছাড়া চাকমা, মাররাসহ কয়েকটি জাতি এসে এখানে বসবাস শুরু করে। এখন পাহাড়ি বাঙ্গালি প্রায় সমান সমান।’’
তিনি বলেন, পাহাড় ধস রোধে যেকোনো মূল্যে এর ভূমির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। পাহাড় ধসের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে অনেকগুলো পদক্ষেপ নেয়া হয়। ২০১৭সালের পাহাড় ধসের পর স্থানীয় প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী রেডক্রিসেন্ট ,জনপ্রতিনিধিসহ সর্বস্থরের মানুষ উদ্ধার কাজে নেমে ২ হাজার ৩শ জনকে উদ্ধার করেছে। এ উদ্ধার কাক করতে গিয়ে ২জন সেনাবাহিনী কর্মকর্তা এবং ৩জন সৈনিক নিহত হয়েছে। পাহাড় ধস রোধে কি করা যায় তা জানতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২৭ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। এ কমিটি সুপারিশসহ তাদের প্রতিবেদন দিয়েছে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে আমরা কাজ করছি। আমি মনে করি যেকোনোভাবে পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে। এটা করলে পাহাড় ধস এবং অনাকাঙ্খিত মৃত্যু রোধ করা যাবে।
সেমিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আইইবি প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী মো. আবদুস সবুর। আইইবির পুরকৌশল বিভাগের চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আইইবির সম্মানী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী খন্দকার মনজুর মোর্শেদ।
আইইবি প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী মো. আবদুস সবুর বলেন, ভূমিধসের কারণে প্রতিবছরই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১০ সারাদেশে ১৭ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর ২০১৭ সালে এসে এ সংখ্যাটি ৪২ হাজার জন। সাত বছরে ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা পঁচিশ হাজার বেড়ে গেছে। এটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। প্রকৌশলীরা সরকারের হাতে হাত রেখে দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। আগামী দিনে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবার নির্বাচিত করতে হবে।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ কর্ম কমিশনের সদস্য ড. আবদুল জব্বার খাঁন।
তিনি বলেন, অবাধে পাহাড় কাটা, বন উজাড়, যেখানে সেখানে বসতি স্থাপনের কারণে পাহাড় ক্ষয় হচ্ছে। এক পর্যায়ে ধসের ঘটনা ঘটছে। ধস রোধে সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। মূল মাটির অনেক গভীরে যায় এমন গাছ রোপন, পাহাড়ের কাটা অংশে জিও টেক্সটাইল ব্যবহার এবং পাহাড়ে রাস্তাঘাট এবং অন্যান্য স্থাপনা তৈরির সময় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। সবার আগে পাহাড়ে জরিপ করতে হবে। সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই বিভিন্ন নির্মাণকাজ শেষ করতে হবে। সবার আগে আমাদের দেশপ্রেমিক হতে হবে। পাহাড়ের ক্ষতি হয় এমন কাজ যেন আমরা না করি। পওে তিনি দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
পাহাড়ধস বাংলাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও তা সেভাবে আলোচনায় আসছে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের চেয়ারম্যান রেশাদ মো. ইকরাম আলী। তিনি বলেন, প্রতি বছরই পাহাড় ধসে অনেক প্রাণ এবং সম্পদহানি হয়। আমার মনে হয় মানুষ মারা যাওয়ার কারণ হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনার পরই পাহাড় ধসের অবস্থান। কিন্তু সে হিসাবে আমরা বিষয়টির প্রতি এখনো গুরুত্ব দিচ্ছি না। এ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসেছে।
বাস্তব কারণেই পাহাড়ে বসতি স্থাপন ঠেকানো যাবে না। কিন্তু বসতি স্থাপন করতে হলে তা পরিকল্পনামাফিক করা উচিত বলে মনে করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সুদীপ কুমার পাল। তিনি বলেন, পাহাড়ে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় অনেক জায়গায় ধস নামে। এজন্য ভবন বানানো হলে সেটার নিষ্কাশন ব্যবস্থা আধুনিক হতে হবে। বিল্ডিং কোড মেনে পরিকল্পনামাফিক যেন ভবন তৈরি হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে।