চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ভুয়া’দের কাছে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা পরাজিত হতে পারেন না

মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার সারঙ্গদিয়া গ্রামের আবু তালেব বিশ্বাস দেশ স্বাধীন করার অভিপ্রায়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। ভারতের রানাঘাট যুব শিবির ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বাংলাদেশে ঢুকেন। প্রশিক্ষণে থাকা অবস্থায় যুবশিবির ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা তৎকালীন যশোর-১০ আসন থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য মো. আছাদুজ্জামানের (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এপিএস সাইফুজ্জামান শিখরের বাবা) সাক্ষর করা রশিদও তাঁর সংগ্রহে রয়েছে।

কিন্তু আজ পর্যন্ত তিনি সনদধারী মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেননি। অনেকের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন, কিন্তু কাজ হয়নি। তাঁরই কাছের আরেক বন্ধু-সহযোদ্ধা প্রয়াত আব্বাস হোসেন দুলালও মৃত্যু অব্দি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজের সার্টিফিকেটটি দেখে যেতে পারেননি।  মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার কারণেই অক্টোবরের দিকে তাঁর বাবা আব্দুল করীমকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল স্থানীয় রাজাকার এবং পাকবাহিনীরা। এলাকাবাসীর মুখে মুখে এ দুজনই বীর মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু তারা সার্টিফিকেটধারী নন।

স্বভাবতই এই দুই মুক্তিযোদ্ধার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি এবং তাঁদের পরিবারের ভাগ্যে কোনো ধরনের সরকারি সুযোগ সুবিধা জোটেনি। তবে ২০০১ সালের ১৭ মার্চ মুক্তিযোদ্ধা আব্বাস হোসেন দুলাল মারা গেলে তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফেরত আসার পর তিনি রক্ষীবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন।

আব্বাস হোসেন দুলাল এবং তালেব বিশ্বাস দুজনই ছাত্রলীগ করতেন। বঙ্গবন্ধুর আহবানকে বুকে ধারণ করেই তারা বেনাপোল দিয়ে রানাঘাট যুবশিবিরে যোগ দিয়েছিলেন। বেঁচে থাকা তালেব বিশ্বাস এখনও এই আশায় চেয়ে আছেন যে, তিনি একদিন না একদিন গেজেটধারী মুক্তিযোদ্ধা হয়ে রাষ্ট্রের স্বীকৃতিটুকু পাবেন। আর যদি নাই পান তাহলে দুঃখ বুকে ধারণ করেই তাঁকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে।

শ্রীপুরের সারঙ্গদিয়া গ্রামের তালেব বিশ্বাস এবং আব্বাস হোসেন দুলাল-এর মতো আরও অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধাই গেজেটধারী হতে পারেননি। যুদ্ধের সূচনাতেই অধিনায়ক আকবর হোসেনের (মাগুরার আকবরবাহিনীর প্রধান) নির্দেশনায় পুলিশের হাবিলদার শাজাহান যে ঝুঁকি নিয়ে তরুণদেরকে অস্ত্র প্রশিক্ষণে উদ্ধুদ্ধ করেছিলেন, অনেকগুলো অপারেশনে যিনি ছিলেন সবার আগে সেই হাবিলদার শাজাহানের কপালেও সার্টিফিকেট জোটেনি।

হাবিলদার শাজাহানের বাড়ি ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার রাণীহাটিতে। চাকরিসূত্রে মাগুরাতে থাকা অবস্থায় তিনি শ্রীপুরের হরিন্দি গ্রামে বিয়ে করে শ্রীপুরেই বসবাস করতে থাকেন। যুদ্ধ শুরু হলে তিনি স্থানীয় আকবরবাহিনী গঠন এবং তরুণ যোদ্ধাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। কয়েক বছর হলো এই বীরযোদ্ধা প্রয়াত হয়েছেন, কিন্তু নিজের স্বীকৃতিটুকু দেখে যেতে পারেননি। অথচ শ্রীপুর ও মাগুরাতে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর নামটি খ্যাত হয়ে আছে।

একইভাবে শৈলকূপার আব্দুল লতিফ, সুলতান আকবরবাহিনীর সম্মুখ সারির যোদ্ধা হলেও গেজেটধারী হতে পারেননি। বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তালেব বিশ্বাস, আব্বাস হোসেন দুলাল, হাবিলদার শাজাহান, লতিফ, সুলতান এ সব প্রকৃত ও সাহসী মুক্তিযোদ্ধা গেজেট বা সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধা হতে না পারলেও অনেকেই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হয়ে, সনদ দেখিয়ে ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদি পাচ্ছেন। মাগুরা জেলাতে ভুয়া বা অমুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা মোটেও কম নয়।

বিভিন্ন সময়ে নানা কৌশলে সনদ, প্রত্যয়নপত্র জোগাড় করে একশ্রেণীর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারাই হয়েছেন প্রৃকত (?) মুক্তিযোদ্ধা। শুধু এই-ই নয়, অক্টোবরে ঐতিহাসিক কামান্নার যুদ্ধে রাজাকার হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছিল মাগুরা সদর থানার হাজীপুর গ্রামের যে খাতের আলী এবং হাবিবুর তাঁদের নাম পর্যন্ত লেখা হয়েছিল শহীদদের জন্যে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে। তাদের পরিবার এর আগে ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাও পেয়েছেন।

শুধু মাগুরা বলে নয়, সব জেলাতেই প্রচুর ভুয়া, অমুক্তিযোদ্ধা রয়েছে, যারা বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতা ব্যবহার করে, ঘুষ ও  মিথ্যা তথ্য দিয়ে, লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট হাতিয়ে নিয়ে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন। দেশে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যাবে সন্দেহ নেই। এটি আসলে বিভিন্ন সরকারের আমলে বিভিন্নভাবে হয়েছে।

কোনো সরকারের আমলে বেশি হয়েছে কোনো সরকারের আমলে কম হয়েছে। তবে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার মূল হিড়িকটা শুরু হয় জিয়া এবং এরশাদের আমলে। এরপর এটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রুপ গ্রহণ করেছে। আর সর্বশেষ বর্তমান সরকার এসে যখন সাধারণ যোদ্ধাদের সুযোগ সুবিধা তুমুল ভাবে বাড়িয়ে দেয়, তখন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা জন্ম নেওয়ার নতুন হিড়িক পড়ে বললে ভুল হবে না। সেই হিড়িক এখনও বন্ধ হয়নি।

মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে বর্তমানে যে কয়েক হাজার আবেদন জমা রয়েছে, সেখানে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি যে বা যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধ করাতো দূরে থাক মুক্তিযোদ্ধাদের একগ্লাস পানি পর্যন্ত খাওয়াননি তিনিও মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার স্বপ্ন বিভোর হয়ে আছেন।  তবে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার দাপট কতোটা ভয়াবহ সম্প্রতি তার এক নতুন ধার উন্মোচিত হয়েছে। সম্প্রতি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদে নিয়োগ পাওয়া পুলিশের ১৯ সদস্য এবং আরও দুজন কনস্টেবলকে গ্রেপ্তার করেছে দুদক। অভিযোগ, এরা সবাই ভুয়া সার্টিফিকেট প্রদর্শন করে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পুলিশের চাকরি বাগিয়ে নেয়।

অভিযুক্তরা বলেছেন, সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. সহিদুর রেজা এই ঘটনার মূল কূশীলব। লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে ভুয়া সনদ বানিয়ে দেন। সম্প্রতি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট প্রদর্শন করে চাকরি নেওয়া ৭ জন কারারক্ষীর চাকরিও আটকে দিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ-এমন খবর মিডিয়াতে এসেছে। এর আগে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় রাজশাহীর বাঘা উপজেলার ৮৮ জনকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করে ভাতা প্রদান বন্ধ করে দেয়।    

বলতে দ্বিধা নেই মিডিয়াতে যা বা যতটুকু এসেছে তা যৎসামান্য। বিভিন্ন সরকারি অফিসে এরকম অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের ভুয়া সার্টিফিকেট দেখিয়ে চাকরি বাগিয়ে নিয়েছে। সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. সহিদুর রেজা যে অপকর্মটি করেছেন সেটি আরও অনেকেই করেছেন বলে তথ্য প্রমাণ রয়েছে। প্রতিটি উপজেলাতেই কমবেশি ভুয়া অথবা অমুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। যারা যুদ্ধের সময় একরাউন্ড গৃলি ফোটানোতো দূরে থাক, মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো ধরনের সহায়তা করেছেন বলে প্রমাণ নেই। অথচ তারাই মুক্তিযোদ্ধা হয়ে বসে আছেন। প্রতিমাসে ভাতা তুলছেন, অন্যান্য সুবিধাদি নিচ্ছেন।

আর অন্যদিকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা নিজের স্বীকৃতির জন্যে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। অনেক শিক্ষিতজন আর বড় অফিসারকেও দেখেছি শতভাগ মুক্তিযোদ্ধা। মুসলিম লীগ পরিবারের অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন ভুয়া তথ্য দিয়ে, সুকৌশলে। দুঃখ হয় এই সব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা আবার শেষ বিদায়ক্ষণে রাষ্ট্র থেকে যথাযথ মর্যাদাও পাবে।

মূলত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তৈরির ক্ষেত্রে বরাবরই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে বিভিন্ন জেলা উপজেলার কতিপয় স্থানীয় কমান্ডার ( অবশ্যই সবাই নন, যারা মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার সাথে আপোষ করেননি তাদের প্রতি স্যালুট) এবং বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীরা। এরাই টাকার লোভ সামলাতে না পেরে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক শক্তি ও ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে কালিমালেপন করে চলেছে।

এনিয়ে সবসময়ই প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধারা সোচ্চার থাকলেও বিষয়টি কখনই থামানো যায়নি, বরং বেড়েই চলেছে। এখানেই শেষ নয়, যাচাই বাছাই-এর কথা বলেও অনেক নিঃস্ব রিক্ত অসহায় মুক্তিযোদ্ধা, তাঁদের স্ত্রীদের কাছ থেকেও টাকা নেওয়ার অভিযোগ অনেক উপজেলা, জেলা কমান্ডারের বিরুদ্ধে  রয়েছে। অনেক প্রয়াত প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার বিধবাপত্নীরা এখনও কমান্ডারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন মুক্তিযুদ্ধে স্বামীর অবদানের স্বীকৃতি আদায়ের জন্যে।

কিন্তু তারা স্বীকৃতি না পেলেও অমুক্তিযোদ্ধারা ঠিকই স্বীকৃতি আদায় করে নিচ্ছেন। এটিই বোধ হয় সত্য যে, মুক্তিযোদ্ধারা একাত্তরের যুদ্ধে পাকবাহিনীর প্রতিরোধ ও পরাস্ত করতে পারলেও তারা যেনো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বড্ড অসহায়।

প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা কী তাহলে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পরাজিত হয়েছে? তা না হলে একজন উপজেলা কমান্ডার কীভাবে দায়িত্বে থাকা অবস্থায় নিজেদেরই মর্যাদা বিকিয়ে দিতে কুণ্ঠিত বোধ করেনি?

এ ধরনের অপকর্মের অবশ্যই গভীরে যাওয়া প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের উচিত ভুয়া ও অমুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। আর ভুয়া নির্মুলে প্রকৃত  মুক্তিযোদ্ধাদেরই জেলা উপজেলাতে সবচেয়ে সোচ্চার হতে হবে। আর সেটা হলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যারা এখনও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি, তাদের স্বীকৃতির দ্বারও উন্মুক্ত হবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)