১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির সেই স্মরণীয় ত্যাগের দিন বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বছর পরিক্রমায় আজ মহান ভাষা আন্দোলনের ৭০ বত্সর পূর্ণ হলো। তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশ মিলিয়ে ৫৬ শতাংশ নাগরিক বাংলা ভাষায় কথা বললেও উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণায় বাঙালি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, এরপরে পাকিস্তানের শাসকের উপেক্ষা আর জোর প্রদর্শনের সামনে বাংলার দামাল ছেলেরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পথে নেমে আসে। এরপরের বুকের তাজা রক্তের ত্যাগের ইতিহাস বিশ্বজুড়ে আলোচিত ও সম্মানিত।
৫২’র ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সিঁড়ি দিয়েই আসলে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা লাভ করি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের স্বীকৃতির পর প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে সারাবিশ্বেই পালন করা হয়। সারাদেশে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করা হচ্ছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হলো, ‘প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে বহুভাষায় জ্ঞানার্জন: সংকট এবং সম্ভাবনা’। অমর একুশে উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও আজও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি। বিশিষ্ট ভাষাবিদরা বার বার ভাষানীতি প্রণয়নের দাবি জানালেও আজ সাত দশক পরও তা দাবিতেই বন্দী আছে। এছাড়া যথাযথ প্রয়োগের অভাবে বাংলা ভাষার মজবুত ভিত্তিও গড়ে উঠেনি।
শুধু দিবস হিসাবে পালন করলেই চলবে না, ভাষা আন্দোলনের চেতনার যথাযোগ্য বাস্তবায়ন করতে হবে। শহীদ বরকত, রফিকসহ যারা যে লক্ষ্যে প্রাণ দিয়েছিলেন এবং যারা ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে জেল-জুলুমের শিকার হয়েছিলেন, তাদের মূল দাবি ছিল সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন। কিন্তু এই কাজটি দেশে এখনও অনেকটাই উপেক্ষিত। ২০১৪ সালে উচ্চ আদালতের রায় এবং সরকারি আদেশ, পরিপত্র বা বিধিতে বাংলা ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবুও সরকারি কাজের সবক্ষেত্রে আজও নিশ্চিত করা যায়নি রাষ্ট্রভাষা বাংলার ব্যবহার।
মাতৃভাষার উন্নয়ন ছাড়া কোনো জাতি পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। বহুযুগ ধরে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি আমাদের পাঠ্যক্রমে যুক্ত থাকলেও সঠিক শুদ্ধ মাতৃভাষা চর্চার ও প্রকৃত শিক্ষার অভাবে ভিত্তি মজবুত হচ্ছে না কোনো ভাষাতেই। জাপান, সাউথ কোরিয়া, চীনসহ যেসকল জাতি নতুন করে সমৃদ্ধি অর্জন করেছে, তারা মাতৃভাষার প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল। এমনকি ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশও এই ব্যাপারে সচেতন।
তবে একটি বিষয় অবশ্যই মানতে হবে যে, ৭০ বছর আগের ও বর্তমানের পরিস্থিতি এক নয়। মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও বৈশ্বিক উন্নয়নের স্বার্থে বিদেশি ভাষার গুরুত্বও বুঝতে হবে। কারণ বাংলাদেশ এখন গ্লোবাল ভিলেজের অংশ। প্রযুক্তির কল্যাণে গোটা পৃথিবীই এখন আমাদের হাতের মুঠায়। আর গ্লোবাল ভিলেজে বাংলার সাথে সাথে বিদেশি ভাষা জানা গুরুত্বপূর্ণ।
আরেকটি সমস্যা হচ্ছে ‘ভাষা দূষণ’। বিদেশি ভাষা জানা জরুরি, কিন্তু তা অবশ্যই বাংলাকে বাদ দিয়ে নয়। বাংলা-ইংরেজি-বিদেশি ভাষা মিশিয়ে কথা বললে ভাষাকে অবমাননা হয়। এই ভাষাদূষণ দ্রুত বন্ধ করতে না পারলে ভবিষ্যতে বাংলা হারাবে নিজস্ব সত্ত্বা। শিল্প-সাহিত্য, বিনোদন ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শুদ্ধ বাংলার চর্চা ও প্রয়োগ খুবই জরুরি বলে আমরা মনে করি। আমাদের আশাবাদ, সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাই এ বিষয়ে যত্নবান হবেন।