ঢাকা মেডিকেলের লাশকাটা ঘর। প্রেসক্লাব থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে আমি ছুটলাম সেদিকে। একটা লাশ ঘিরে সাংবাদিকদের ভিড়। ভিড় ঠেলে কাছে গিয়ে সাদা কাপড় সরাতে সিঁথিতে সিঁদুর চোখে পড়ল। লাল টকটকে। সেই সিঁদুরের রং আজও আমার ভেতরটাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়ে যায়। মেয়েটি ভালোবেসে লাশ হয়েছিল। তোমরা যারা ভালোবেসে লাশ হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছ, তাদের জন্য আমার এই নিবেদন।
শুরুতে যে গল্পটা শোনালাম সেটা আজ থেকে সাত-আট বছর আগের। আমি তখন চ্যানেল আইয়ের রিপোর্টিংয়ে কাজ করি। তৎকালীন অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর সন্তোষ মণ্ডল ফোন করে ঢাকা মেডিকেলে যেতে বলেছিলেন। প্রাথমিকভাবে তিনি জানালেন, ‘ওখানে একটা ডেডবডি আছে। বিয়ের কয়েক মাস বাদে কীভাবে যেন মারা গেছে।’ মেয়েটির নাম নিলু। বাবা-মায়ের অমতে বিয়ে করেছিল। তারপর স্বামীর সঙ্গে অভিমান করে লাশ হয়ে যায়। আবেগ। নিছক আবেগ। আর তথাকথিত ‘ভালোবাসা’। যে মা-বাবা মেয়েটাকে মানুষ করল, সে তাদের অমতে বিয়ে করেই ক্ষান্ত দিল না। শেষ পর্যন্ত নিজেকেই বিসর্জন দিল। মেয়ে কেন তুমি এমন করবে?
ছেলেদের ক্ষেত্রেও একই কথা, কেন তুমি এমন করবে? একটা ছেলে কিংবা মেয়েই কি তোমার জীবনের সব? ভালোবাসা সম্পূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। নিষিদ্ধ ‘নিয়মে’র প্রতি মানবের টান অমোঘ। তরুণ-তরুণীদের আরও বেশি। বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গীর সাথে বসবাসের আগ পর্যন্ত তারা একটি ঘোরের ভেতর থাকে। নিজের মস্তিষ্কে একটি কাল্পনিক পৃথিবী সৃষ্টি করে-বিয়ে হবে, সংসার হবে, স্বামীর বাসায় যাবে, রান্না করে খাওয়াবে, এক সঙ্গে ঘুরতে যাবে ইত্যাদি, ইত্যাদি…।
কিন্তু বাস্তবতা হলো এই জগতের সঙ্গে আসল জগতের বিন্দুমাত্র মিল নেই। এক সঙ্গে বছর খানেক থাকার পরই তারা বুঝতে পারে পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই। যদি থাকতো তাহলে দেশের শীর্ষ নায়ক-নায়িকারা ডিভোর্সের পর এভাবে কাঁদা ছোড়াছুড়ি করতেন না। মুভির মতো নেচে গেয়ে জীবন পার করে দিতেন। এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে? কেনইবা আত্মহত্যার পথে সৃষ্টির সেরা জীব পা বাড়ায়? প্রথম প্রশ্নের উত্তর নানাবিধ প্রসঙ্গের ওপর নির্ভরশীল। তবে একটি সার্বজনীন উত্তর আছে। সেটি হলো মনের কামনা, বাসনা কিংবা ইচ্ছা পূর্ণ না হলেই মানুষ কষ্ট পায়।
প্রেমের ক্ষেত্রে বিষয়টি আবার একটু অন্যরকম। ছেলে যদি মেয়েকে আগে অ্যাভয়েড করতে শুরু করে তাহলে মেয়েটির কষ্ট হয়। আবার মেয়ে যদি ছেলেকে আগে অ্যাভয়েড করতে শুরু করে, তাহলে ছেলেটি কষ্ট পায়। দ্বিতীয় প্রশ্নের একমাত্র ক্ষুদ্রতম উত্তর, ‘সুখের আশায়!’ যে আত্মহত্যা করে, সে বেঁচে থাকার ওই সময়ে আসন্ন কিংবা বিরাজমান কষ্ট সহ্য করতে পারে না বলেই সুখ খুঁজতে থাকে। তখন তার অবচেতন মন আপনা-আপনি সম্মোহিত হয়ে পড়ে। সে ভাবতে থাকে মরে গেলেই সবাই তাকে ভালোবাসবে। তার জন্য হা-হুতাশ করবে। ঠিক তখন নিজের মস্তিষ্ক নিজেকে আত্মহত্যার নির্দেশ দেয়। সে জানতেও পারে না, তার লাশ হয়ে যাওয়ার পরের বছরও ঈদ আসে। বাড়ির লোকেরা নতুন জামা পরে। চাঁদরাতে চায়ের দোকানের গল্প শেষই হতে চায় না। সেই গল্পের ছলে কেউ তাকে স্মরণ করে না। কেউ না। কেউ না!
তবু ভালোবাসা বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকে এই ভালোবাসা দিবস। নর-নারীর ‘ভালোবাসা’র ভিড়ে আমরা শুধু ভুলে যাই সুন্দরতম প্রেমের কথা। পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের বাৎসল্য প্রেম, দেহের সঙ্গে মনের অর্থাৎ আদমের সঙ্গে হাওয়ার কিংবা রাধার সঙ্গে কৃষ্ণের প্রেমের কথা। যার আরেক নাম মহাজাগতিক প্রেম। আমরা ভুলে যাই আত্মপ্রেমের কথা। অনেকে জানিই না নিজেকে নিজে ভালোবাসা যায়। ফেসবুকের ‘ক্রাশ’ শব্দে যারা নেশাগ্রস্ত, তাদের অবশ্য জানার কথাও নয়। তবু প্রার্থণা করতে চাই, ‘ভালোবাসা দাও ওগো মনেতে সবার/ভুবনটা ভরে যাবে আলোতে আবার…।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)