ভারতের আসাম থেকে বানের জলে ভেসে আসা বন্য হাতিটির মৃত্যুর খবরে ব্যথিত হয়ে মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) একটি প্রতিক্রিয়া লিখেছিলাম একটি অনলাইন সংবাদপত্রে। মুহূর্তেই লেখাটি ফেসবুকে ব্যাপক মানুষ শেয়ার করেন এবং অনেকেই পড়েন।
ব্যক্তিগতভাবে আমাকে অনেকে ফেসবুক ইনবক্সে ধন্যবাদ জানিয়েছেন এরকম একটি মানবিক এবং আবেগঘন লেখার জন্য। কেউ কেউ ফোন করেছেন। কিন্তু মঙ্গলবার রাতে লেখাটির নিচে কিছু মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া পড়ে এতটাই ব্যথিত হয়েছি যে, হাতিটির মৃত্যুশোক আমাকে যতটা কষ্ট দিয়েছে,তার চেয়ে অনেক বেশি ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ এবং একইসঙ্গে লজ্জিত করেছে ওইসব মন্তব্য।
আমার দূরতম চিন্তায়ও ছিল না যে ‘মানুষ’ একটি হাতির মৃত্যু নিয়ে লেখা একটি প্রতিক্রিয়ায় এমন বাজে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। হাতিটি যেহেতু ভারত থেকে এসেছে,তাই এই ইস্যুকে নিয়ে তথাকথিত ভারতবিরোধিতা,তিস্তার পানিচুক্তি, সীমান্তে মানুষ হত্যার মতো অপ্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে এমন সব মন্তব্য অনেকে করেছেন,যেখানে তাদের রুচির দীনতা,অশিক্ষা আর উগ্র মানসিকতাই প্রকাশ পেয়েছে।
শুধু তাই নয়, হাতিটি যেহেতু ১৬ আগস্ট মারা গেছে এবং তার আগের দিন ছিল জাতীয় শোক দিবস,তাই অনেকে এরকমও লিখেছেন যে,১৬ আগস্টকে আরেকটি শোক দিবস ঘোষণা করা হোক। পরিহাস করে কেউ হাতিটিকে রাষ্ট্রীয় মার্যাদায় দাফন এবং তাকে গার্ড অব অনার দেয়া যায় বলেও মন্তব্য করেন। ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো,কেউ কেউ এই ইস্যুতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়েও এমন সব মন্তব্য করেছেন,যা এখানে লেখা সম্ভব নয় এবং ওইসব লেখা অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
পশুপাখি যদি জানতো মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতা এতো সংকীর্ণ আর নোংরা, তাহলে হয়তো তারা মানুষের কাছে ভিড়তই না। আকৃতি ও বলে হাতি মানুষের চেয়ে বহুগুণ বেশি। কথা বলতে পারলে,দেড় মাস ধরে বন্য হাতিটির বেঁচে থাকার সংগ্রাম নিয়ে নিশ্চয়ই সে মানুষকে মৃত্যুর আগে তার কষ্টের কথাগুলো বলে যেত।
ফেসবুকের অনেকগুলো মন্তব্যের মধ্য থেকে কয়েকটি এখানে পেশ করতে চাই:
নজরুল ইসলাম নামে একজন লিখেছেন,‘এরপর শিরোনাম হবে,বাহাদুরের কুলখানি,আয়জনে সমস্থ বঙ্গ বাসী,প্রযন্তে সমস্ত ভারত বাসী। প্রচারে বাংলা বাসী। ফিদা হয়ে গেলাম হাতির খবর দেখতে দেখতে।’
মেহজাবিন সুলতানা মিম নামে একজন লিখেছেন,‘হাতিটা যদি হয় বঙ্গবাহাদুর তবে এদেশের সাংবাদিক গুলো হলো বঙ্গ বেয়াদব। সবকিছুর একটা সীমা থাকে। বঙ্গবেয়াদব গুলো বিষয়টাকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে গেছে যেখানে একটা অবলা প্রাণীর নাম শুনলেই মানুষ ঘৃণা পোষণ করছে। বঙ্গ বেয়াদবগুলো ভুলে গেছে প্রথমে আমরা মানুষ। হাজার হাজার অসহায় মানুষকে অন্ধকারে রেখে একটা হাতি নিয়ে কান্নাকাটি হল্লাহাটি। হলুদ মিডিয়ার বঙ্গবেয়াদব সব।’
আহমেদ মারুফ নামে একজন লিখেছেন,‘বাংলাদেশের মিডিয়া গুলো ভারতকে নিয়ে সবসময় ব্যস্ত থাকে। আমাদের দেশের কত মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে মারা যাচ্ছে মিডিয়ার সেই দিকে খবর নাই। বাংলার জনগণের চেয়ে ভারতের বন্যপ্রাণীর অনেক অনেক মূল্য মিডিয়া তা প্রমাণ করলো।’
তানভিরুল আনোয়ার নামে একজন লিখেছেন,‘ইন্ডিয়া পানির ব্যারেজের সাথে একটি হাতিও নামিয়ে দিলো,আর আমাদের আবাল মিডিয়া হাতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। হাতি কবে হাগু দিলো,কবে মুতে দিলো,কবে সাঁতার কাটলো,কবে ক্লান্ত ছিলো। আর অন্যদিকে আমার দেশের বন্যাকবলিত হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে অভুক্ত-অর্ধভুক্ত থেকে দিন কাটাচ্ছে,আশ্রয় নিয়েছে টিনের চালে,সেদিকে কোনো নজরই নেই!’
তাউসিফ রহমান নামে একজন লিখেছেন,‘বাংলাদেশের কয়জন মানুষ মরার পরে এভাবে ক্ষমা চেয়েছিস…বাচ্চা। রাজন হত্যার পর ক্ষমা চেয়েছিলি তনু হত্যার পর ক্ষমা চেয়েছিলি আজ একটা হাতির জন্য তোদের এমন তেলমারা সংবাদ দেখে ইচ্ছে করছে তোদেরকে রুটিন করে প্রতিদিন মিনিমাম ৪/৫ ঘন্টা বাথরুমের ঝাড়ু দিয়ে পিটাই বাংলাদেশে বর্ডারে প্রতিদিন কত নিরিহ মানুষ মারছে বি,এস,এফ তখন তোদের মানবতা ঘাস কাটতে যাই শালার বলদ।’
অনেক বাজে মন্তব্যের মধ্যে এগুলো তুলনামূলক ভালো। তাই উল্লেখ করলাম। তবে এটা ঠিক যে,এর মধ্যে অনেকে লেখাটিকে সাধুবাদ দিয়েছেন। হাতিটির মৃত্যুতে দুঃখপ্রকাশ করেছেন এবং এরকম একটি বন্য প্রাণি উদ্ধারে বনবিভাগের ব্যর্থতার কথা বলেছেন। কেউ কেউ বনবিভাগের সক্ষমতা বাড়ানোরও পরামর্শ দিয়েছেন।
যারা বিশ্রি ও রুচিহীন কমেন্ট করেছেন প্রোফাইলে গিয়ে দেখা গেলো,তাদের অনেকেরই ঠিকানা দেশের বাইরে। ঠিকানাগুলো ভুয়া নাকি সত্যি সত্যিই তারা প্রবাসী বাংলাদেশি তা জানি না। তবে যদি তারা সত্যিই প্রবাসী বাংলাদেশি হয়ে থাকেন,তাহলে তাদের নিয়ে আমরা যে গর্ব করি,তাদের পাঠানো অর্থে আমাদের রিজার্ভ শক্তিশালী বলে যে আনন্দ পাই-সেখানে অনেক শূন্যতা রয়েছে বলে মনে হয়। পয়সা থাকলে টিনের ঘর দালান হয়ে যায় ঠিক কিন্তু চিন্তা ও বোধ বিকশিত না হলে সেই মানুষ আসলে ইট পাথরের মতোই জড়বস্তু। বরং তারও চেয়ে খারাপ। কারণ ইটপাথর কারো ক্ষতি করে না। কিন্তু মানুষ যদি জানোয়ারের মতো কথা বলে বা আচরণ করে,সেটি শুধু তার নিজের জন্যই নয়,পুরো জাতি ও রাষ্ট্রের জন্যই ক্ষতিকর।
আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞান আর অর্থনীতিতে এগিয়ে যাচ্ছি বলে আমোদ পেলেও,২০২৪ সালের পরে দেশে কেউ গরিব থাকবে না বলে অর্থমন্ত্রী আশার বাণী শোনালেও আমাদের চিন্তা ও বোধে,আমাদের মেধা ও মননে যে বিশাল ঘাটতি থেকে যাচ্ছে, একটি বোধহীন রুচিহীন প্রজন্ম যেভাবে ভেতরে ভেতরে তৈরি হয়েছে- সেই শূন্যতা অর্থমন্ত্রী কী দিয়ে পূরণ করবেন তা হয়তো তিনিও জানেন না।
ফলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি আর রিজার্ভ বাড়লেই আমরা যে আনন্দে আটখানা হয়ে যাই, শিক্ষার হার ৫ শতাংশ বাড়লেই যেভাবে বুকটা টান করে দিই,কয়েকটা অভিযান সফল হলেই দেশ থেকে জঙ্গি নির্মূলের যে আশার কথা শুনতে পাই, দুজন শিক্ষার্থীকে বাঁচাতে গিয়ে একজন অটোরিকশা চালকের আত্মাহুতির খবর পেলেই যেভাবে আমরা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করি-তার ভেতরে ভেতরে প্রতিহিংসাপরায়ণ, চরম মৌলবাদী ও চিন্তায় উগ্রবাদী, ভারতবিদ্বেষের নামে তথাকথিত উগ্র দেশপ্রেমিক যে জনগোষ্ঠী এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশেষ করে ফেসবুকে সরব-তাতে আতঙ্কিত না হবার কোনো কারণ নেই।
এসব উগ্রবাদী এবং রুচিহীন লোকজনকে শনাক্ত করে তাদের ভালো কথা দিয়ে উদ্বুদ্ধ করা এবং প্রয়োজন হলে তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত বলে আমি মনে করি। আমার লেখার নিচে যতগুলো মন্তব্য এসেছে,তার মধ্যে এমন কিছু মন্তব্য করা হয়েছে যেগুলো উল্লেখ করার রুচি আমার নেই।
২.
হাতিটিকে নিয়ে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ির অভিযোগ করেছেন অনেকে। পরিস্কার ভাষায় বলতে চাই, এ নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি হয়নি। কেননা হাতিটি এখানে ছিল সিম্বলিক বা প্রতীকী।
আমাদের বন্য প্রাণি উদ্ধারের সক্ষমতা, হাতিটির কারণে স্থানীয় মানুষের বিপদ, হাতির মতো একটি অতি বিপন্ন প্রাণির নিজের বিপন্নতা-এসব কিছুই ছিল সাংবাদিকদের রিপোর্টিং, লেখালেখি ও আলোচনার বিষয়। ওই একই সময়ে দেশের উত্তরবঙ্গ ও মধ্যাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির খবর যে গণমাধ্যম এড়িয়ে গেছে তা নয়। বরং হাতির চেয়ে বন্যার খবরই বেশি গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ ও প্রচার হয়েছে। যারা সমালোচনার জন্য সমালোচনা করেছেন, বাজে মন্তব্য লিখেছেন, তারা খবর না দেখেই ঢালাও মন্তব্য করেছেন। তাদের গাত্রদাহের মূল কারণ হাতিটি ভারত থেকে এসেছে, ব্যস।
কেউ কেউ লিখেছেন, ফেলানী হত্যার সময় মিডিয়া কোথায় ছিল? তাদের জানা দরকার, গণমাধ্যমে অব্যাহত রিপোর্টিংয়ের কারণেই ফেলানী হত্যা নিয়ে পুরো ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্র নড়েচেড়ে বসেছে। সেখানে বিএসএফ-এর আদালতে বিচার হয়েছে। সেটি ন্যায়বিচার হয়নি উল্লেখ করে ভারতের হাইকোর্ট সরকারকে সতর্ক করেছেন। ফেলানীর পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে ভারতের মানবাধিকার সংগঠনগুলো। গণমাধ্যমে খবর না হলে এসব কী করে সম্ভব হত?
রাষ্ট্রীয় ও জনগুরুত্বপূর্ণ সব বিষয় নিয়েই গণমাধ্যম সরব থাকে। এর মধ্যে কোনো কোনোটি বিশেষ গুরুত্ব পায় নানা কারণে। কিন্তু হাতিটিকে নিয়ে আমরা যা করেছি তার সঙ্গে ভারতপ্রেম বা ভারতবিরোধিতার কোনো সম্পর্ক নেই। একজন মানুষের বেঁচে থাকার যেমন অধিকার আছে, তেমনি একটি হাতির অধিকার আছে নিরাপদে থাকার। একটি বন্য হাতি যখন অন্য দেশে এবং লোকালয়ে চলে এসেছে, তখন সে নিজে যেমন বিপন্ন, তেমনি তার কারণে ওই জনপদের মানুষও ভীত, সন্ত্রস্ত। সুতরাং উভয়ের নিরাপত্তার স্বার্থেই সাংবাদিকরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তার অর্থ এই নয় যে, অন্য ইস্যু বাতিল হয়ে গেছে। বান্দবানের থানচিতে খাদ্য সংকটের কথা গণমাধ্যমই প্রকাশ ও প্রচার করে এবং তার ফলে সরকার সেখানে খাদ্য পাঠায়। কোন খবরটির ট্রিটমেন্ট কী হবে-সেটির সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারক ও নিউজরুম সংশ্লিষ্টদের। পাঠক কখনো খবরের ট্রিটমেন্ট ঠিক করেন না। সেই এখতিয়ারও তাকে দেয়া হয়নি। সুতরাং সুযোগ পেলেই গণমাধ্যমের সমালোচনা, বাজে মন্তব্য করার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। এতে বরং নিজের রুচির দীনতা আর মূর্খতাই প্রকাশ পায়।
(এ
বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর
সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)