ভারতের বাজার থেকে বাংলাদেশের তুলনায় কয়েকগুণ উচ্চমূল্যে ওষুধ ক্রয়ের ফলে রোগীরা বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। মালয়েশিয়াভিত্তিক গবেষণা সংগঠন ‘থার্ড ওয়ার্ল্ড নেটওয়ার্ক’ (টিডব্লিওএন) সম্প্রতি তাদের ‘প্রোডাক্ট প্যাটেন্ট প্রোটেকশন দ্য ট্রিপস এলডিসি এক্সেমশন অ্যান্ড দ্য বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যালস’ শিরোনামে গবেষণায় এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
টিডব্লিওএন বিভিন্ন দেশে ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছে। তারা জানায়, প্রতিবছর কয়েক লাখ রোগী চিকিৎসার জন্য ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে যান। চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীরা ভারতের বাজার থেকেই প্রয়োজনীয় ওষুধ ক্রয় করে থাকেন।
গবেষণায় বলা হয়, ভারতে উৎপাদিত নানা ওষুধ যে মূল্যে অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রি করে থাকে বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানী কর্তৃক উৎপাদিত সেই একই ওষুধের দাম তুলনামূলক কয়েকগুণ কম। বিশেষ করে ক্যান্সার, লিভার, সিওপিডি, হেপাটাইটিস বি/সি, ফুসফুসসহ বিভিন্ন ধরনের কঠিন ও ব্যয়বহুল চিকিৎসায় ব্যবহ্নত ওষুধ ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে অনেকটাই সহনীয় মূল্যে বিক্রি হয়। কোনো কোনো ওষুধ অর্ধেক দামেও বিক্রি হয়।
কিন্তু বাংলাদেশ থেকে ভারতে যারা চিকিৎসার জন্য যান, তারা এসব ওষুধ ভারতের বাজার থেকে বেশি দামে ক্রয় করে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। কেননা এই সব ওষুধের বেশিরভাগ দীর্ঘসময় ধরে খেতে হয়। ফলে চিকিৎসা শেষে রোগীরা ভারত থেকে বেশি অর্থ ব্যয় করে ওষুধ কিনে আনেন। কিন্তু এই একই ওষুধ যদি তারা বাংলাদেশের বাজার থেকে ক্রয় করেন তাহলে তাদের কয়েকগুণ অর্থ সাশ্রয় হতো। অথচ গুণগতমান, প্রক্রিয়াকরণ এবং কার্যকারিতায় বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধ কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই।
গবেষণায় ক্যান্সার, লিভার, ফুসফুসসহ অন্যান্য চিকিৎসায় ব্যবহৃত ১৮টি ব্র্যান্ডের ওষুধের ভারত এবং বাংলাদেশের বাজারে দামের তারতাম্যের এরকম একটি তুলনামূলক চিত্রও তারা প্রকাশ করেছে। সেখানে তারা দেখিয়েছে একই জেনেরিকের ওষুধের ইউনিট প্রাইস বা একক মূল্যের তারতম্য ভারতে এবং বাংলাদেশে কেমন। সেখানে দেখা যাচ্ছে অনেক ওষুধ কয়েকগুণ বেশি দামে ভারতের বাজারে বিক্রি হয়ে থাকে।
তুলনামূলক চিত্রে তারা যে ১৮টি ওষুধের দামের তারতম্য দেখিয়েছে সেগুলো হলো- লিনাগ্লিপটিন, এম্পাগ্লিফ্লোজিন, রিভারক্সাবান, অসিমারটিনিব, পিটাভাস্ট্যাটিন, ইব্রুটিনিব, এলট্রম্বোপ্যাক, ইন্ডোক্যাটেরল, এপিক্সাবান, সাক্সাগ্লিপটিন, পারটুজুম্যাব, ডেফেরিপ্রোণ, আফাটিনিভ, ক্রিজোটিনিভ, নিনটেডানিব, পালবোছিক্লিভ, এক্সিটিনিব, রিগোরাফেনিব। এই ওষুধগুলো বাংলাদেশের থেকে ভারতের বাজারে অনেক বেশি দামে বিক্রি করা হয়।
‘থার্ড ওয়ার্ল্ড নেটওয়ার্ক’ এ তালিকা তারা প্রকাশ করেছে ভারত এবং বাংলাদেশের ওষুধ প্রশাসন প্রদত্ত মূল্য বিশ্লেষণ করে।
ভারতে যে উচ্চমূল্যে ওষুধ বিক্রি করা হয় এর উদাহরণ স্বরুপ ইন্ডাক্যাটেরল এর কথা বলা যেতে পারে। ফুসফুসের চিকিৎসায় এই ওষুধ ব্যবহার করা হয়। ‘থার্ড ওয়ার্ল্ড নেটওয়ার্ক’ তাদের গবেষণায় বলছে বাংলাদেশের বাজারের তুলনায় ভারতের বাজারে এই ওষুধের দাম শতকরার হিসেবে প্রায় ২৮ ভাগ বেশি। বাংলাদেশে এই ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন করে ইনসেপ্টা, ইউনিমেড, হেলথকেয়ারসহ কিছু ফার্মাসিউটিক্যালস। ডায়াবেটিস আক্রান্ত রুগিরা লিনাগ্লিপটিন নামের একটি ওষুধ ব্যবহার করেন। বাংলাদেশে ৩০টিরও অধিক ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি এই ওষুধ উৎপাদন করে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে এই ওষুধের প্রতিটির দাম ২২ টাকা (০.২৬ ডলার)। কিন্তু ভারতের বাজারে এই ওষুধের দাম ৬০ টাকা (০.৭১ ডলার)। শতকরা হিসেবে এটি বাংলাদেশের তুলনায় ১৭২ শতাংশ বেশি দামে ভারতের বাজারে বিক্রি হয়।
ওসিমারটিনিব ব্র্যান্ডের একটি ওষুধের মূল্যও ভারতের বাজারে অনেক বেশি। ওসিমারটিনিব ব্র্যান্ডের ওষুধ বাংলাদেশে উৎপাদন করে ইনসেপ্টা, ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল, টেকনোসহ অন্যান্যরা। ওসিমারটিনিব ভারতে অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্যাটেন্টেড ওষুধ এবং অ্যাস্ট্রেজেনেকা নিজেরাই বিক্রি করে। বাংলাদেশে এটি বিক্রি করে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশ যেখানে ৮০ মিলিগ্রামের একটি ট্যাবলেট বিক্রি হয় সর্বোচ্চ ৫.৯১ ডলারে। ভারতের বাজারে এটির দাম ২৯৬.৭৩ ডলার। পিটাভাস্ট্যাটিন ও সাক্সাগ্লিপটিন এই দুটি ওষুধেরও উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশে ইব্রাটিনিব ১৪০ মিলিগ্রাম ক্যাপসুল বিক্রি হয় ৫.৯১ ডলারে। আর ভারতে এর মূল্য ১৫.৭৫ ডলার। আবার এপিক্সাবিয়ান (৫মিলিগ্রাম) বাংলাদেশে ০.৩ ডলার, ভারতে ২.১ ডলার।
এসব পরিসংখ্যান থেকেই এটি পরিস্কার যে, ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধের দাম অনেক কম। চিকিৎসা বিষয়ক গবেষকরা বলছেন, প্রতিবছর প্রচুর রোগী চিকিৎসার জন্য ভারতে যান এবং এসব রোগী ভারতীয় চিকিৎসকদের পরামর্শ মোতাবেক ভারত থেকে উচ্চমূল্যে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ক্রয় করে থাকেন। অথচ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে রোগীরা এসব ওষুধ সংগ্রহ করলে তাদের অনেক অর্থ সাশ্রয় হতো।
দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া জানায়, প্রতি বছর বিভিন্ন দেশ থেকে যারা চিকিৎসার জন্য ভারতে যান সেই তালিকার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। এরপরে রয়েছে আফগানিস্তান, মালদ্বীপসহ অন্যান্য দেশ। গত বছর ভারতে মেডিকেল টুরিস্টদের মধ্যে বাংলাদেশি ছিল ৫৪ দশমিক ৩ শতাংশ। এই চিত্র বলে দিচ্ছে প্রতিবছর কত সংখ্যক মানুষ চিকিৎসার জন্য ভারতে যান।
উল্লেখ্য, আমাদের দেশে প্রচুর আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন হ্নদরোগ, কিডনি, ক্যান্সার, ফুসফুস বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন যারা উন্নত বিশ্বের সমপর্যায়ের কিন্তু এরকম চিকিৎসক থাকলেও একশ্রেণীর দালাল চক্রের কারণে রোগীরা ভারতে চিকিৎসা গ্রহণে প্রলুব্ধ হয়। এই প্রক্রিয়ায় বেশিরভাগ রোগী ভারতের নিম্নমানের হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করে এক ধরনের প্রতারণার শিকার হয়ে থাকে। অসচেতনতা এবং দৃষ্টিভঙ্গিজনিত সমস্যার কারণে এই রোগীরা চিকিৎসা শেষে বেশি দামেই ভারতের বাজার থেকে কোটি কোটি টাকার ওষুধ ক্রয় করেন। সম্প্রতি ভারতে চিকিৎসার জন্য ছয় লক্ষ মানুষ ভিসা গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে।
এ কথা সত্য যে, নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে তুলনামূলক স্বল্পমূল্যে অভ্যন্তরীণ বাজারে ওষুধ বিপণনের সক্ষমতায় বাংলাদেশের অগ্রগতি আজ বিশ্বব্যাপী নজর কেড়েছে। গত কয়েক বছরে মানসম্মত ওষুধ উৎপাদনে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পখাত বড় ধরনের কৃতিত্ব অর্জনে সক্ষম হয়েছে। একইসাথে স্বল্পমূল্যে মানসম্মত ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনেও বাংলাদেশ এখন রোল মডেল। কিন্তু এত কিছুর পরও রোগীদের চিকিৎসার জন্য ভারত গমন এবং উচ্চমূল্যে ভারতীয় বাজার থেকে প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় ওষুধ ক্রয় বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পখাতে অন্যতম একটি অন্তরায় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
ওষুধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের মানুষ এখন অনেকটাই ওষুধের স্বর্গরাজ্যে বাস করছে। নানা অন্তরায় এবং আমদানী নির্ভরতা পেরিয়ে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পখাত বিশ্বব্যাপী দারুণ প্রশংসা অর্জন করেছে। বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার শতকরা ৯৮ ভাগ মিটিয়ে বিশ্বের ১৫১টিরও বেশি দেশে ঔষধ রপ্তানি করছে দেশের ঔষধ কোম্পানিগুলো। দেশে নতুন নতুন উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন প্রযুক্তি ওষুধ শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু রোগীদের দূরদর্শিতার অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ওষুধের বাজার।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)