চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘ভারত এক খোঁজ’: সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিপরীতে জন্মপরিচয়ের প্রশ্ন

“বিশেষ এক কারণে এত বছর পর আমি অযোধ্যা এলাম, মাননীয় বিচারক,
এলাম আমার মায়ের জন্মভূমি খুঁজতে।
না, আমার কী ধর্ম আমি জানিনা,
জানি না আমার বাবা কে,
আমার মাও জানত না এসব।”

জন্মভূমি হারানো এক সন্তানের বহু বছর পর স্বভূমির খোঁজে অযোধ্যা ফিরে এসে আদালতের কাছে এমন আকুতি দিয়েই কবিতাটির শুরু। পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত কবি জয়দেব বসু’র কবিতা- ‘ভারত এক খোঁজ’। আলোচ্য কবিতাটিতে জন্মভূমি খুঁজে বেড়ানো যুবকের ভাষ্যে যে স্থানটির বর্ণনা উঠে এসেছে, তা থেকেই কবিতাটির প্রতি আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। আমি সাহিত্যের ছাত্রও নই, সাহিত্য সমালোচক নই তো বটেই। স্রেফ রাজনীতিসচেতন এক সামাজিক মানুষ মাত্র। আর এখানেই কবিতাটির প্রতি আমার সবিশেষ আগ্রহের কারণ।

সেই ছেলেবেলায় ‘অযোধ্যা’ নামটির সাথে আমার পরিচিতি। স্বভাবতই সনাতন ধর্মাবলম্বী পরিবারে জন্মগ্রহণের কারণে ‘রামায়ন’ এবং তার অন্যতম মূল ঘটনাস্থল ‘অযোধ্যা’ নামের সাথে আমার এই পরিচিতি। পৌরাণিক রাজা দশরথের রাজ্য অযোধ্যা। দশরথের তিন স্ত্রী ও চার পুত্র। এর মধ্যে বড় পুত্র শ্রীরাম ছিলেন ঈশ্বরের রূপ তথা অবতার। রামায়নের সে কাহিনী আমাদের সবারই জানা। শ্রী রামচন্দ্র যেহেতু ঈশ্বরেরই এক রূপ, সেহেতু তার নামে মন্দির নির্মিত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কথিত আছে- অযোধ্যাতেই সেই ঐতিহাসিক রামমন্দির অবস্থিত। যদিও একালে এসে তার কোনো দালিলিক বা প্রামাণিক উপাত্ত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এবং তা নিয়ে স্বভাবতই আজ প্রশ্ন বিদ্যমান।

আবার ভারতবর্ষে মোগল শাসকদের শাসনকালও বেশ ঐতিহাসিক। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ছুটে আসা বীর যোদ্ধা জহিরউদ্দিন মোহাম্মদ বাবর ভারতবর্ষে মোগলরাজ প্রতিষ্ঠা করেন। কালক্রমে মোগলদের প্রতাপ ভারতবর্ষজুড়েই এক ঐতিহাসিক যুগের সূচনা করে। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের ইতিহাসে বাবর তথা মোগলরাজাদের অবদান কম নয়। সম্রাট বাবরের প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদটিও নাকি ঐ অযোধ্যাতেই অবস্থিত। এরও কোনো দালিলিক বা প্রামাণিক উপাত্ত আজ খুঁজে পাওয়া যাবে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

কিন্তু রাম মন্দির ও বাবরী মসজিদের এই পরস্পরবিরোধী অস্তিত্ব খোঁজার বিতর্কটি গেলো শতকের শেষ দিকে এসে রীতিমতো তর্ক থেকে যুদ্ধের রূপ নেয়। এবং বিষয়টি শেষতক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পর্যন্ত গড়ায়। ওদেশে এ নিয়ে হিন্দু মৌলবাদীরা সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা যেমন চাপিয়ে দেয়, এখানেও তার পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে মুসলমান মৌলবাদীরা সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর অনুরূপ চড়াও হয়। এর বিভৎস রূপটি ওখানকার মুসলমান সংখ্যালঘু এবং এখানকার হিন্দু সংখ্যালঘুরা বেশ নির্মমভাবেই দেখেছে। রামমন্দির ও বাবরী মসজিদের অস্তিত্বের বিষয়টি ভারতে আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে এবং সেদেশের উচ্চ আদালতে এ বিষয়ে বিভক্ত রায় এসেছে। অর্থাৎ এই মন্দির-মসজিদের বিতর্কটির আইনী সমাধান এখনো পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। ফলত এই বিতর্ক এবং তার সূত্র ধরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দুই দেশেই আমাদের আরো কিছুকাল হয়তো দেখতে হবে।

জয়দেব বসু’র কবিতায় এ বিষয়টি চমৎকার সাহিত্যগুণে উঠে এসেছে। ‘ভারত এক খোঁজ’ কবিতায় এক প্রয়াত বাঈজীর সন্তান আজ এতো বছর পরে তার জন্মভূমির খোঁজে ফিরে এসেছে বিতর্কে মোড়া ঐতিহাসিক অযোধ্যায়। কবিতায় কথকের ভূমিকায় থাকা ওই পতিতাসন্তান আজ এতো বছর পরে এসে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সাহসী উচ্চারণ করছে:

“আমার কী ধর্ম আমি জানি না,
জানি না আমার বাবা কে,
আমার মাও জানত না এসব।”

এ উচ্চারণ এমন এক সময়ে যে সময়ে রামমন্দির-বাবরী মসজিদ নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক তুঙ্গে। এই রাজনৈতিক বিতর্কের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে কতো যে অসহায় পরিবারের পরিচয়- তার জ্বলন্ত উদাহরণ তুলে ধরেছেন জয়দেব বসু। এ ধরনের রাজনৈতিক বিতর্ক যখন সাম্প্রদায়িক হিংসায় রূপ নেয়, তখন এমনিভাবে অসংখ্য মানুষ অসহায় হয়ে আত্মপরিচয় হারায়। এ তো শুধু বর্তমান ভারতের অযোধ্যার গল্প নয়, এমন অসংখ্য গল্প পাওয়া যাবে আমাদের বাংলাদেশে, যদি কোনো ঐতিহাসিক তার সুলুকসন্ধান করতে চান।

কবিতার নায়কের কোনো পিতৃপরিচয় নেই। আছে শুধু মাতৃপরিচয়। তার মা মুন্না বাঈয়েরও ছিলো শুধু তাই। কারণ পতিতালয় কিংবা বাঈজীখানায় জন্ম নেওয়া কোনো সন্তানের এর চেয়ে বেশি থাকতে পারে না। এ নায়ক এক সময়ে বাঈজীখানার পরিবেশ ছেড়ে চলে যায় অন্যত্র। আজ বহুদিন পরে সে ফিরে এসেছে তার জন্মভূমিতে, জন্মভূমির অধিকার দাবি করে অযোধ্যারই আদালতে। এবং সাহসের সাথে রামমন্দির-বাবরী মসজিদ বিতর্কে জল ঢেলে দৃঢ়তার সাথেই ওই তথাকথিত ঐতিহাসিক স্থানে তার জন্মভূমির অধিকার চাইছে সে।

হতে পারে এ চরিত্র জয়দেব বসু’র কাল্পনিক। তবুও কি তা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পূর্বোক্ত পরিচয় হারানো মানুষগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে না? সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কীভাবে মানুষকে পরিচয়হীন করে তার মর্মস্পর্শী শৈল্পিক প্রতিবেদন এ কবিতা।

এক সময়ের অবিভক্ত ভারতবর্ষ আজ নেই, যে ভারতবর্ষে বহু বিচিত্র জাতি ও ধর্মের মানুষ একত্রে বসবাস করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছিলো বিশ্বে। ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসকেরা যখন ভারত ছাড়তে বাধ্য হলো, তখন কৌশলে এ ভূখণ্ডের রাজনীতিকদের মাঝে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনে রেখে গেলো। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হলো ভারতবর্ষ। হিন্দুদের জন্য ভারত (হিন্দুস্থান) আর মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান। পাকিস্তানের দুই অংশ এবং তাদের মাঝে হাজার মাইলের ব্যবধান। কিন্তু সাতচল্লিশে পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের মানুষ উপলব্ধি করলো- এই পাকিস্তান আমার না। এই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ আমার না। এই স্বাধীনতা আমার না। অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে তাই প্রায় সিকি শতকের নানা সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বহু রক্তের ত্যাগ স্বীকার করে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম।

এই বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছিলো অসাম্প্রদায়িকতা ও গণতন্ত্রের প্রসববেদনা জাগিয়ে। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান তথা আজকের পাকিস্তান রাষ্ট্রটি কিন্তু সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হয়েই রইলো। এবং তার ফলস্বরূপ এখনো তাকে সামরিকতন্ত্রের বিষবাষ্প আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে। পাকিস্তান আজ ব্যর্থ রাষ্ট্রের খাতায় নামও লিখিয়ে ফেলেছে। কিন্তু ভারত তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। যদিও কখনো সখনো সেও আক্রান্ত হয়েছে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীদের দ্বারা। অযোধ্যায়, গুজরাটে…।

বাংলাদেশে যখনি মৌলবাদ আর সামরিকতন্ত্র একজোট হয়েছে, তখনি এক একটি কালো সাম্প্রদায়িক অধ্যায় সূচিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এবারই প্রথম গণতান্ত্রিক শাসন আমাদের অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রপরিচয়ের কফিনে পেরেক ঠুকে দিয়েছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর দ্বারা। এর ফলও যে আমাদের ভোগ করতে হবে অদূর ভবিষ্যতে, তার লক্ষণগুলোও ইতোমধ্যে প্রকাশিত। আমরা তো এই শতকের শুরুতেই এখানে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত নিঃশ্বাসে জর্জরিত হয়েছি। সে তো বেশিদিন আগের কথা নয়।

‘ভারত এক খোঁজ’ কবিতার নায়ক এবার জন্মভূমির অধিকার চাইতে অযোধ্যায় ফিরে এসে আদালতের কাঠগড়ায় সাহসের সাথেই উচ্চারণ করছে:

“কিন্তু এতবছর পর মায়ের জন্মভূমি খুঁজতে এসে
কী আমি দেখলাম?
কেউ বলছে- এখানে জন্মেছিলেন তাদের এক পৌরাণিক রাজা।
কেউ বলছে- এখানে এসেছিলেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে তাড়া খাওয়া এক বাদশা।”

অর্থাৎ সেই রামমন্দির-বাবরী মসজিদ বিতর্ক।

কাঠগড়ায় তার অমোঘ ঘোষণা:

“আমি জানি না পৌরাণিক কোনো চরিত্রের পক্ষে
জন্ম নেওয়া আদৌ সম্ভব কিনা, আমি জানি না অতদিন আগে আসা
কোনো সেনানীর পদচ্ছাপ এতটাই নিশ্চিত কিনা, …”

ঠিকই তো। শ্রীরাম ঈশ্বরের ভূমিকায় অবতীর্ণ। ঈশ্বর তো মানুষের মঙ্গলের জন্য। সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা। কিন্তু এ কী সৃষ্টি? কেবলই সাম্প্রদায়িকতা? এক ধর্মের মানুষের উপর আরেক ধর্মের মানুষের জুলুম? এজন্যেই কি ঈশ্বরের নামে মন্দিরের সৃষ্টি? আর সে মন্দিরের অস্তিত্বের প্রশ্ন তুলে এই দাঙ্গা? আদৌ আজ এই মন্দিরের অস্তিত্বের প্রশ্ন তোলা কি নিতান্তই অবান্তর? যার কোনো দালিলিক বা প্রামাণিক উপাত্ত এই একুশ শতকের যুক্তিবাদী কালে এসে আর পাওয়া যায় না।

বিপরীতে সম্রাট বাবরের প্রতিষ্ঠিত এক মসজিদ। মসজিদ নাকি আল্লাহর ঘর! তবে কেনই বা তারও অস্তিত্বের প্রশ্ন তুলে মানুষ নিধনের মহাযজ্ঞ? ঐ স্থানে ঐ মসজিদেরও তো কোনো দালিলিক বা প্রামাণিক উপাত্ত আজ আর নেই। যে ধর্মের সৃষ্টি মানুষের কল্যাণের জন্য, সেই ধর্মের নামে বিতর্ক তুলে আজ যখন মানুষে মানুষে বিভেদ-দাঙ্গার সৃষ্টি, তখন তো প্রশ্ন উঠতেই পারে- এ কি শুধু প্রতাপ বজায় রাখার স্বার্থে রাজনৈতিক বিতর্ক নয়?

বরং ওই স্থানে মসজিদ বা মন্দির যাই থাকুক না কেন, তার চাইতে বড় প্রশ্ন সেখানে আমরা ধর্মের নামে কোনো মানুষের বসতি ধ্বংস করলাম কিনা? কোনো মানুষের জন্মভূমির অস্তিত্ব ধ্বংস করলাম কিনা? যখন একই ভারতবর্ষের মানুষেরা মন্দির-মসজিদ বিতর্ক তুলে একে অপরের উপর আঘাত করলাম, ছুরি চালালাম ভাই হয়ে ভাইয়ের গলায়, তখন ঈশ্বরের মন্দির বা আল্লাহ’র মসজিদের চাইতে মানুষের জন্মভূমির প্রশ্ন যদি বড় হয়ে দেখাই দেয়, তবে কি তা ধর্মদ্রোহিতা হবে?

কবিতায় নায়কের বীরোচিত উক্তি:

“আমি জানি না পৌরাণিক কোনো চরিত্রের পক্ষে
জন্ম নেওয়া আদৌ সম্ভব কিনা, আমি জানি না অতদিন আগে আসা
কোনো সেনানীর পদচ্ছাপ এতটাই নিশ্চিত কিনা,
কিন্তু, আমি জানি আমার মা এখানে জন্মেছিল- এখানেই,
কেননা, আমিও যে জন্মেছি এখানে।”

উপসনালয়ের অস্তিত্বের চাইতে মানুষের জন্মভূমির অস্তিত্বের প্রশ্ন জয়দেব বসু বড় করে তুলেছেন। উভয় দেশে উভয় ধর্মের মৌলবাদীদের কাছে এ প্রশ্ন ধর্মের অস্তিত্বের প্রশ্ন তোলার মতো ধৃষ্টতা হতে পারে, কিন্তু আদতে এই ভারতবর্ষের মানুষ যে ধর্মভীরু কিন্তু ধর্মান্ধ নয়, সেই ভূমির সম্প্রীতিমনা সংবেদনশীল মানুষের কাছে নিশ্চয়ই নয়।

ভারতীয় উপমহাদেশে মৌলবাদীরা যতোই শক্তিশালীরা হোক, তাদের আস্ফালন-উন্মাদনা অবশ্যই সাময়িক। এবং সেই অল্প অংশটুকুও সফল হতে পারে আমাদের আপসকামী রাজনীতিকদের জন্য। সাধারণ মানুষদের জন্য নয়। এখানকার মুক্তমনা মানুষেরা শেষ পর্যন্ত বারবার যেকোনো পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে। চূড়ান্তভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে। আজ শাসকেরা সামরিকতন্ত্রের লেবাসেই হোক বা গণতন্ত্রের ধ্বজা উড়িয়েই হোক, যতোই এই ভূখণ্ডের মানুষকে সাম্প্রদায়িক বলে পরিচিত করাতে আগ্রহী হোক না কেন, আদতে এখানকার মানুষ তা গ্রহণ করবে না। বারবার এখানকার মানুষ জন্মের পরিচয় দাবি করবেই।

আমাদের জন্মের পরিচয় যে কোনোক্রমেই সাম্প্রদায়িক নয়, নিতান্তই অসাম্প্রদায়িক।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)