কোয়ারেন্টাইন প্রটোকল ভাঙার অভিযোগে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেছে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ম্যাচে। বিশ্বকাপ বাছাইয়ে লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের ম্যাচটি মাঠে গড়ানো কয়েক মিনিটের মধ্যে স্থগিত করা হয়েছে খেলা। পয়েন্টের হিসাবে কী ঘটবে তা এখন শুধুই ফুটবলের অভিভাবক সংস্থা ফিফার হাতে।
কী-কেনো ঘটেছিল
গণমাধ্যমে আলোচনা ছিল আর্জেন্টিনার চার খেলোয়াড় ব্রাজিলের কোয়ারেন্টাইন নীতিমালা মানেননি। তাদের এই ম্যাচে খেলানো যাবে না। কিন্তু ওই চার খেলোয়াড়ের তিনজনকে শুরুর একাদশে রেখে ম্যাচের সূচনা ঘটান সফরকারী কোচ লিওনেল স্কালোনি।
ব্রাজিলের সাও পাওলোতে ম্যাচ তখন শুরু হয়ে গেছে। ষষ্ঠ মিনিটের খেলা চলছে। সফরকারী আর্জেন্টিনার চার খেলোয়াড়কে ধরতে আচমকাই মাঠে ঢুককে পড়েন স্বাগতিক ব্রাজিলের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। উদ্দেশ্য আর্জেন্টিনার চার খেলোয়াড়কে আটক করা।
আর্জেন্টিনা ডাগআউটের কাছে অপরিচিত উপস্থিতি দেখতেই প্রশ্ন তোলেন খেলোয়াড়রা। একপর্যায়ে খেলোয়াড় ও স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তাদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কিও হয়ে। পরে লিওনেল মেসি দল নিয়ে মাঠ ছাড়েন।
সফরকারী কোচ লিওনেল স্কালোনি, স্বাগতিক কোচ টিটে, নেইমার-আলভেজ-কাসেমিরো দীর্ঘক্ষণ রেফারির সাথে আলোচনা করেন। জার্সি খুলে ফিরে এসে তাতে যোগ দেন মেসিও। কোনো সমাধান আসেনি। ম্যাচ স্থগিতই থাকে। রেফারির ম্যাচ স্থগিতের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় আর্জেন্টিনার ফুটবল সংস্থা।
কোয়ারেন্টাইন নিয়মে যা আছে
ব্রাজিলের কোভিড বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী ব্রাজিলীয় নন এমন কেউ যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা, ভারত থেকে সরাসরি দেশটিতে প্রবেশ করতে পারবেন না। সাও পাওলোর স্বাস্থ্য বিভাগ সেই আইন মেনে লেগে থাকে আর্জেন্টিনা দলের পেছনে।
অবশ্য বিশেষ বিবেচনায় ছাড় দেয়ার বিষয়ও আছে। সেজন্য বিশেষ অনুমতিও নিতে হবে। ব্রাজিলে প্রবেশের আগে বিশেষ ব্যক্তির জন্য আলাদা ছাড়পত্রের আবেদন ও অনুমতি পাশ করিয়ে নিতে হবে কর্তৃপক্ষ থেকে। নয়ত দেশটিতে প্রবেশ করলেই ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন পালন করতে হবে।
কোন চার খেলোয়াড়
গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ, ক্রিস্টিয়ান রোমেরো, জিওভান্নি লো সেলসো, এমিলিয়ানো বুয়েন্দিয়া। আর্জেন্টিনার এ চার খেলোয়াড় প্রিমিয়ার লিগের অ্যাস্টন ভিলা ও টটেনহ্যাম হটস্পারের কারণে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন শর্ত পালন করতে পারেননি। যা ব্রাজিলের কোয়ারেন্টাইন নীতির সাথে সাংঘর্ষিক।
এর মধ্যে গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ, ক্রিস্টিয়ান রোমেরো, জিওভান্নি লো সেলসোকে শুরুর একাদশে রাখেন কোচ স্কালোনি।
এই চার খেলোয়াড় অবশ্য সরাসরি ব্রাজিলে আসেননি। ইংল্যান্ড থেকে তারা প্রথমে যান নিজ দেশ আর্জেন্টিনায়। সেখান থেকে বিশ্বকাপ বাছাই খেলতে ভেনেজুয়েলায় যান। ম্যাচ খেলেন। জয় তোলেন। তারপর আসেন ব্রাজিলে। কিন্তু আর্জেন্টিনা-ভেনেজুয়েলা মিলিয়ে তাদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন পূর্ণ হয়নি। হলে সাও পাওলোর স্বাস্থ্য বিভাগ ঝামেলা করতে পারত না।
খেলানো যাবে না, জানানো হয়নি
আর্জেন্টিনা কোচ স্কালোনি বলেছেন, তার চার খেলোয়াড় যে খেলানো যাবে না সেটি তাদের জানানো হয়নি। তাই খেলোয়াড়দের একাদশে নামিয়েছিলেন।
তিন দিন ধরে ওই খেলোয়াড়রা আর্জেন্টিনা দলের সাথে আছেন। ব্রাজিলের মাটিতে তারা অনুশীলন করেছেন। স্বাভাবিক সব কাজ-কর্ম করেছেন। সেসময় তাদের খেলা নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ। এমনকি হোটেলে হানা দিতে পারত, সেটিও করেনি। যেই না খেলা শুরু হল, অমনি তারা মাঠে হাজির খেলোয়াড় আটক করতে।
আর্জেন্টিনা কোচ বলছেন
স্কালোনি বলেছেন, ‘কী ঘটেছিল তা জানাতে এসেছি, ব্যাপারটা আমাকে খুবই ব্যথিত করেছে। কাউকে দোষারোপ করবো না। তবে ম্যাচ ওভাবে ভেস্তে দেয়ার সময় নিশ্চিতভাবেই ওটা ছিল না। কনমেবল আমাদের জানিয়েছে ওই চার খেলোয়াড়কে খেলাতে কোনো বাধা নেই।’
‘কোচ হিসেবে নিজ খেলোয়াড়দের রক্ষা করা আমার দায়িত্ব। আমাদের একবারও বলা হয়নি ওই চার খেলোয়াড়কে খেলানো যাবে না। আমরা শুধু খেলতে চেয়েছিলাম। জানি, ব্রাজিল খেলোয়াড়েরাও সেটাই চেয়েছিল। আর্জেন্টিনার মানুষ এটা বুঝবেন।’
মেসি বলছেন
তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় আর্জেন্টিনা অধিনায়ক লিওনেল মেসি বলেছেন, ‘তিন দিন ধরে আমরা ব্রাজিলে অবস্থান করছি। ওরা ম্যাচ শুরু হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল কেন?’
কনমেবলের নিয়মে যা আছে
আর্জেন্টিনার কাছে ৩ পয়েন্ট হারাতে পারে ব্রাজিল। লাতিন ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কনমেবলের নিয়ম বলছে এমনই।
কনমেবলের শৃঙ্খলাবিধির একটি ধারা আছে। ৭৪ নম্বর সেই ধারাটি পক্ষে যেতে পারে আর্জেন্টিনার। যেখানে উল্লেখ আছে, ম্যাচ শুরুর পর খেলা থামিয়ে দেয়া যাবে না, খেলা থামিয়ে কোনো খেলোয়াড়কে ম্যাচ খেলায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া যাবে না। কোনো খেলোয়াড়কে নিয়ে বিপত্তি থাকলে মিটমাট করে ফেলতে হবে ম্যাচ শুরুর বাঁশি বাজার আগেই।
এই হিসেবে তিন পয়েন্ট পাওয়ার কথা আর্জেন্টিনারই। যদিও এই ম্যাচ কেবল কনমেবলের আওতায় এমনও নয়। এটা ফিফার আয়োজন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে ফিফা থেকেই।
কনমেবল বলছে
ম্যাচ স্থগিতের আনুষ্ঠানিক বিবৃতির পর কনমেবল জানি দিয়েছে সামনে কী ঘটবে। ম্যাচ রেফারি, ম্যাচ কমিশনার রিপোর্ট জমা দেবেন ফিফার শৃঙ্খলা কমিটির কাছে। এরপর ফিফাই নেবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। সব প্রক্রিয়া ফিফার বর্তমান নিয়ম দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করে এগোবে। বিশ্বকাপ বাছাই ম্যাচ ঘিরে কোনো পদক্ষেপের এখতিয়ার কেবল ফিফারই আছে বলে স্পষ্ট জানিয়েছে কনমেবল।
ফিফার বিবৃতি মেলেনি
ফুটবলের অভিভাবক সংস্থার পক্ষ থেকে এখনও কোনো বিবৃতি মেলেনি। যদিও সবকিছু নির্ভর করছে সংস্থাটির উপরই। খবরে আসছে, ম্যাচ রেফারি ও ম্যাচ কমিশনার রিপোর্ট পাওয়ার পরই ফিফার পদক্ষেপগুলো জানা যাবে ধীরে ধীরে।
আর্জেন্টিনার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন যা বলছে
ম্যাচ স্থগিতের পর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সভাপতি ক্লদিয়ে তাপিয়ে। বলেছেন, ‘যা ঘটেছে তা ফুটবলের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক। খেলাটির ভাবমূর্তির জন্যও খুবই বাজে বার্তা।’
‘স্বাস্থ্য নিয়ে থাকা সকল দেশের আইনের অধীনেই লাতিন আমেরিকার খেলাগুলো হয়। যা পুরোপুরি মেনে চলেছি। এই মুহূর্তে আমাদের খেলোয়াড়দের আর্জেন্টিনায় ফিরিয়ে আনা আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আমরা সেটাই করছি।’
আর্জেন্টিনায় ফেরা
ওই চার ফুটবলারকে আটক করতে চেয়েছিল সাও পাওলো স্বাস্থ্য বিভাগ। পরে ব্রাজিলে অবস্থান করা আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত ড্যানিয়েল নিজে মেসিদের সঙ্গে করে সাও পাওলো বিমানবন্দরে যান। সেখান থেকে চার্টার্ড বিমানে আর্জেন্টিনার পথে উড়াল দেয় আলবিসেলেস্তে দল।
মার্টিনেজ ও বুয়েন্দিয়া নিজ ক্লাবকে কথা দিয়ে এসেছেন কেবল আর্জেন্টিনার প্রথম দুটি ম্যাচেই খেলবেন। পরে ক্রোয়েশিয়ায় পৌঁছে ১০ দিনের অনুশীলন সূচি পালন করবেন। কেননা ব্রাজিল থেকে সরাসরি ইংল্যান্ডে যাওয়ার অবস্থা নেই। গেলে দীর্ঘ কোয়ারেন্টাইন মানতে হতো। করা যেত না অনুশীলন। তাই এই পদক্ষেপ।