নানা অনিয়মে গত কয়েক বছর ধরেই আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজার। মূলত পরিচালনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়ায় সংকটে পড়ে দেশের আর্থিক খাত। তাই এ খাতে শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রস্তাবিত বাজেটে প্রচলিত আইন সংস্কারের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা জারির কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত।
বৃহস্পতিবার ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রস্তাবিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট পেশের সময় অর্থমন্ত্রী নতুন আইন প্রণয়নের বিষয়ে জানান।
অর্থমন্ত্রী তার বাজেট প্রস্তাবনার ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে সংস্কার ও সুশাসন বিষয়ে বিশদ বিবরণ দিয়েছেন।
এতে আর্থিক খাতের সংস্কার বিষয়ে তিনি বলেছেন, মুদ্রা ও দক্ষ ঋণ ব্যবস্থাপনা এবং সুনিয়ন্ত্রিত মূলধন বাজার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।
আর্থিক খাতে প্রশংসনীয় স্থিতিশীলতা ছিল দাবি করে মুহিত বলেন, প্রাক-বাজেট আলোচনাসহ বিভিন্ন ফোরামে আর্থিক খাত নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছে। তবে দু’একটি ব্যতিক্রম ঘটনা ছাড়া দেশে আর্থিক খাতে বরাবরই প্রশংসনীয় স্থিতিশীলতা বজায় ছিল, যা আর্থ-সামাজিক অগ্রযাত্রায় সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
তিনি বলেন, সম্প্রতি ব্যাংকিং খাতে তারল্যের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সিআরআর পুনঃনির্ধারণসহ কয়েকটি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ফলে সৃষ্ট অচলাবস্থার নিরসন হয়েছে। এ ছাড়াও ফারমার্স ব্যাংক পুনর্গঠনের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে সিস্টেমেটিক পতন (সিস্টেমেটিক ফেইলিয়র) বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। তাই গ্রাহকদের আস্থা ফিরে এসেছে।
ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজার নিয়ে যা আছে
প্রস্তাবিত বাজেটে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বিদ্যমান আইন প্রয়োগের পাশাপাশি আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা জারি ও কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য
১. ব্যাংকগুলোতে আমানত ও ঋণের সুদ হার মাসে শুধুমাত্র একবার পরিবর্তন এবং পরিবর্তিত সুদ হার তাৎক্ষণিকভাবে তাদের নিজ নিজ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।
২. ঋণ এবং আমানতের সুদ হারের ব্যবধান ৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখতে হবে।
৩. কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তদের জন্য ঋণ আবেদন ফি ২০০ টাকায় সীমিত রাখা এবং মেয়াদ পূর্তিতে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে কোন চার্জ আদায় করা যাবে না।
৪. বড় ঋণ খেলাপি মনিটরিংয়ের জন্য বিশেষায়িত সফট্ওয়্যার চালু করা হবে।
৫. সুষ্ঠু এজেন্ট ব্যাংকিং এর নির্দেশনা সম্বলিত গাইডলাইন জারি করা হচ্ছে।
৬. মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে একক ব্যক্তি মোবাইল হিসাবের স্থিতি সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে।
৭. স্বল্প সুদে ও সহজশর্তে বিভিন্ন পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের আওতায় বিভিন্ন ধরণের ঋণ সুবিধা প্রদান করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
৮. ব্যাংকিং সেবা বিষয়ক অভিযোগ নিষ্পত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে গ্রাহক সেবা সংরক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে।
৯. ব্যাংকের মাধ্যমে সন্ত্রাস অর্থায়ন প্রতিরোধ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতকর্তা অবলম্বনের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
১০. বড় আকারের ঋণগুলোকে আরো নিবিড়ভাবে পরিবীক্ষণ এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ মনিটরিং ব্যবস্থাকে জোরদার করতে কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডার (সিডিএলসি) গঠন করা হচ্ছে।
১১. কোনো কোনো গ্রাহক একই সম্পদ বা জমি জামানত দেখিয়ে ব্যাংক থেকে অনিয়মিতভাবে ঋণ নিয়ে থাকে। এই জালিয়াতি রোধের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে সব ঋণের বিপরীতে যে জামানত দেখানো হয়, সে বিষয়ে একটি তথ্যভান্ডার সংরক্ষণ করা হবে। যাতে যে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই তথ্য যাচাই করে ঋণ দিতে পারেন। আগামী বছরেই এই তথ্যভান্ডার কার্যকরী হবে।
অর্থপাচার রোধের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, অর্থপাচার বা মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে তথ্য বিনিময় ও আন্তঃসংস্থা সহযোগিতা বাড়াতে বাংলাদেশ ফিনানশিয়াল ইন্টেলিজেন্সিইউনিট (বিএফআইইউ) এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর আওতায় সংস্থা দুইটি নিজেদের ডাটাবেইজে থাকা তথ্য আদান-প্রদান করবে। এবং অর্থপাচারের অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রে একে অপরকে সহযোগিতা ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারবে।
বন্ড বিষয়ে অর্থমন্ত্রী জানান, বিভিন্ন ধরনের সিকিউরিটিজ ব্যবহারের মাধ্যমে বন্ড মার্কেটের উন্নয়ন করা যায়। এ দিকে লক্ষ্য রেখে ফ্লোটিং রেট ট্রেজারি বন্ড (এফআরটিবি) চালু করা হচ্ছে। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে গাইডলাইন ও নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, লক্ষ্য করার বিষয় হলো- ব্যাংকিং শিল্পে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের হিস্যা প্রায় ২০ শতাংশ হলেও এখন পর্যন্ত শরীয়াভিত্তিক কোন সিকিউরিটিজের প্রচলন করা হয়নি। তাই শরীয়াভিত্তিক সিকিউরিটিজ প্রচলনের বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। এছাড়া, সঞ্চয়পত্র ক্রেতাদের তথ্যভান্ডার প্রণয়ন ও জাতীয় পরিচয়পত্রের সাথে এর সংযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ কার্যক্রম সম্পন্ন হলে সঞ্চয়পত্র ব্যবস্থাপনায় আরো বেশি শৃঙ্খলা আনয়ন সম্ভব হবে।
পুঁজিবাজার বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, পুঁজিবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য সহায়তা তহবিল পরিচালনা করা হবে।
এছাড়াও গ্রাহক বাছাই করতে বীমা কোম্পানীগুলোকে কেওয়াইসি (নো ইউর কাস্টমার) প্রোফাইল জারির নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।