চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ব্যর্থতায় স্বাধীনতাবিরোধী রাজনীতি

২০১৫ সালটি কেমন গেল? বছর শেষে এমন প্রশ্ন সকলকে কম বেশি ভাবায়। কোনো বছর প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তি বেশি; কোনো বছর উল্টো। ব্যক্তি জীবনে যেমন চাওয়া-পাওয়ার ব্যালেন্স সিট আছে; তেমনি আছে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক জীবনে। ২০১৫ সালটি বাংলাদেশের জন্য হতে পারত নিরবিচ্ছিন্ন উন্নয়নের বছর। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত উন্নয়ন এলেও রাজনৈতিক উন্নয়ন সহজে আসেনি। বছরের শুরুতে মানুষ পোড়ানোর আন্দোলন এবং জঙ্গিবাদী টার্গেট কিলিং উৎকণ্ঠায় রেখেছে দেশবাসীকে। তবে আশার কথা এই যে সবরকমের সহিংস রাজনীতিতে ব্যর্থ হয়ে স্বাধীনতা বিরোধীরা বছর শেষে পৌর নির্বাচনে অংশ নিয়ে আগামী বছরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার আভাস দিয়েছে। আগামী বছরে রাজনীতি স্থিতিশীল থাকলে পরবর্তী অর্থ বছরের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮% নির্ধারণ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।

গেল বছরে প্রকৃতি রক্ষায়, তথ্যপ্রবাহে এবং সামাজিক উন্নয়নে অনেকটাই এগিয়েছে বাংলাদেশ। অনেক স্বীকৃতি মিলেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। পুরস্কৃত করা হয়েছে উন্নয়নের নেতৃত্বদানকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। জাতিসংঘ দিয়েছে ‘চ্যাম্পিয়ন অফ দ্য আর্থ’ এবং ‘আইটিসি’স ইন সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট’ পুরস্কার। বিশ্বখ্যাত এবং প্রভাবশালী পত্রিকা ফরেন পলিসি রাশান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল এবং মৌরিতাসের প্রেসিডেন্ট আমিনাহ গুরিব-ফাকিমের সঙ্গে দিয়েছে ‘লিডিং গ্লোবাল থিংকার’ এর স্বীকৃতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান পেয়েছেন ‘এশিয়ার সেরা ব্যাংকার’ পুরস্কার। দারিদ্র বিমোচনে, মানবসম্পদ উন্নয়নে, পরিবেশ রক্ষায়, তথ্য বিপ্লবে বাংলাদেশ এখন জগতবাসীর রোল মডেল; অর্থনৈতিক উন্নয়ণে বিস্ময়। দিন দিন উন্নত হচ্ছে অবকাঠামো। স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তবে রূপান্তরের কার্যক্রম চলছে পুরোদমে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ ১২.৬৫ বিলিয়ন ডলারের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের চুক্তি সম্পাদন হয়েছে রাশিয়ার ভাবতে হয়েছে। নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের পদক্ষেপ বাংলাদেশের মানসিক শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। ১২.৬৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই করা এখন আর বিরাট কোনো ব্যাপার নয়।

রাজনীতি, অবকাঠামো এবং সামজিক উন্নয়নের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে অর্থনীতি। এডিবি, বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ- সকলেই তাদের এপ্রিলের প্রাক্কলন থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেশি হবে বলে মনে করছে। তাদের নতুন প্রাক্কলন সরকারের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যের কাছাকাছি চলে এসেছে। দেশ যেভাবে চলছে তাতে চলতি অর্থ বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ৭% ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা জোরালো হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার রয়েছে স্থিতিশীল। সঞ্চয়ের হার পৌঁছেছে ৩০ শতাংশে। সুদের হার নিচের দিকে ধাবিত হয়েছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাবোধ বাড়তে শুরু করেছে। দেশি এবং বিদেশী দুই বিনিয়োগ আগামী বছরে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছানোর লক্ষণ উজ্জ্বল। বিশ্বখ্যাত বাঙালি অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু ঢাকায় বেড়াতে এসে বলেছেন, আগামী দুই/তিন বছরের মধ্যে অর্থনীতিক প্রবৃদ্ধির হার ৮% ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।

২০১৫ সালে বাংলাদেশে রাজনীতির উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলীর মধ্যে রয়েছে বছরের শুরুতে তিন মাস ব্যাপী অগ্নি সন্ত্রাস। জামায়াত-বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের এক বছর পূর্তিতে সরকার পতনের লক্ষ্যে অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশব্যাপী অবরোধ ডাকলে শুরু হয় পেট্রোল বোমা মেরে নির্বিচারে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা। চলন্ত বাসে, টেম্পুতে, সিএনজিতে পেট্রোল বোমা মেরে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা কমবেশি ১৫০ জন। আগুনে পুড়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় ঢাকা মেডিকেলের বার্ণ ইউনিটে কাতরায় কয়েকশ’। আগুন সন্ত্রাস থেকে রেহাই পায়নি যানবাহন, ঘর-বাড়ি, অফিস-আদালত, গবাদি পশু, খাদ্যশস্য। দলীয় কার্যালয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়ে টানা তিন মাস অগ্নি সন্ত্রাস চালিয়ে সরকার পতনে ব্যর্থ হয়ে আদালতে গিয়ে জামিন নিয়ে ঘরে ফিরে যান স্বাধীনতা বিরোধী জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া।

ফেব্রুয়ারী মাসে বই মেলা থেকে ফেরার পথে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় আমেরিকা প্রবাসী বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়কে। একই সঙ্গে চাপাতির আঘাতে মারাত্মকভাবে জখম করা হয় তার স্ত্রীকে। এরপর একে একে হত্যা করা হয় লেখক ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয়, নিলয় নীল (নীলাদ্রি চ্যাটার্জি) এবং প্রকাশক আরেফিন ফয়সাল দীপনকে। অগ্নি সন্ত্রাসে ব্যর্থ, নিন্দিত হয়ে জামায়াত-বিএনপি জোট যখন কোনো ইস্যু নিয়ে রাজনীতির মাঠে থাকার সুযোগ পাচ্ছে না; সারা দেশে তাদের নেতা-কর্মীরা যখন অগ্নি সন্ত্রাসের দায়ে আইনের আশ্রয়ে, ফেরারি তখন আর কোনো পথ না পেয়ে দলীয় সন্ত্রাসী এবং জঙ্গিদের মনোবল টিকিয়ে রাখার জন্য টার্গেট কিলিং এর পথ বেছে নেয় জামায়াত-বিএনপি জঙ্গিবাদী জোট। একাজে তারা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামের একটি সাইনবোর্ড ব্যবহার করে। প্রতিটি হত্যার পরে ইন্টারনেটে এই সাইনবোর্ড থেকে হত্যার দায় স্বীকার করে বার্তা দেয়া হয়। লেখক, ব্লগার হত্যার দায়ে যাদের পুলিশ গ্রেফতার করেছে তাদের মধ্যে রয়েছে জামায়াতে ইসলামের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরের লোক এবং তাদের নেতৃত্বাধীন কিছু উগ্র মৌলবাদী।

বছরের শেষ দিনটিতে নিম্ন আদালত রায় দিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ সংগঠক রাজীব হায়দার হত্যা মামলার। দুই জনকে ফাঁসি এবং ৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে জেল দিয়েছে আদালত। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী মিরপুরের কসাইখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার বিচারের রায়ের প্রতিবাদে সংগঠিত গণজাগরণের অন্যতম সংগঠক রাজীব হায়দারকে তার বাসার কাছে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় গণজাগরণের মাত্র ১০ দিন পরে। রাজীবকে হত্যা করে তাকে নাস্তিক হিসেবে ব্যাপকভাবে প্রচার করে স্বাধীনতা বিরোধীদের মুখপাত্রগুলো। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এবং ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে বিএনপি নেতা মাহমুদুর রহমান সম্পাদিত দৈনিক আমার দেশ। স্বাধীনতা বিরোধী এবং ইসলামী মৌলবাদীদের উস্কে দেয়ার উদ্দেশ্যে যে প্রচার চালানো হয় তাতে সাড়া দিয়ে ঘোমটা খুলে মাঠে নামে বিএনপি। ২৮ ফেব্রুয়ারী সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরে বিএনপি নেত্রী গণজাগরণে যোগদানকারীদের ‘নাস্তিক’ এবং ‘নষ্ট ছেলে’ বলে আখ্যায়িত করেন। মার্চ মাসে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় দেয়া হলে জামায়াত-বিএনপির লোকেরা হত্যা করে শতাধিক সাধারণ মানুষ। এপ্রিল মাসে মধ্যযুগীয় বর্বর চিন্তায় সৃষ্ট ১৩ দফা নিয়ে মাঠে নামে উগ্র মৌলবাদী সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। এসব ঘটানো হয় রাজীব হত্যাকে ইস্যু করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার উদ্দেশ্যে। জামায়াত-বিএনপি এবং তাদের সমর্থক সুশীল সমাজ এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইলেই তাকে ‘নাস্তিক’ বলে চিহ্নিত করা হয়। ‘নাস্তিক’ হত্যাকে জায়েজ বলে ফতোয়া দেওয়া হয় বেশ কিছু ইসলামী আলোচনায়। সেরকম এক ফতোয়াবাজ হচ্ছেন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি মো. জসীমউদ্দিন রাহমানী। রাজীব হত্যায় উস্কানী দেয়ার অপরাধে আদালত তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। জসীমউদ্দিনের ফতোয়ায় অনুপ্রাণিত হয়ে হত্যা করা হয়েছে আরও কয়েকজন ব্লগারকে। এহেন অপরাধীর সাজা মাত্র পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেখে হতাশ হয়েছে প্রগতিশীল মানুষেরা। তিন বছরের মাথায় রাজীব হত্যার বিচার সম্পন্ন হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন অনেকে। এই বিচার মুক্তবুদ্ধি চর্চার ক্ষেত্রে আগামীতে বড় ভূমিকা রাখবে নিঃসন্দেহে।

২০১৫ সালের আরেক প্রধান রাজনীতি হয়েছে পীর-মাশায়েখ হত্যা, খ্রিষ্টান যাজকদের হত্যা চেষ্টা, নৌ-বাহিনীর মসজিদে বোমা হামলা, শিয়া সমাবেশে বোমা হামলা করে মানুষ হত্যা, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং বিদেশী নাগরিক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। কোরবানী ঈদের পর হঠাৎ করে নিরাপত্তার অজুহাতে নির্ধারিত ক্রিকেট সফর বাতিল করে অস্ট্রেলিয়া। নিরাপত্তা অনিশ্চয়তার ধোঁয়া তুলে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণে সতর্কতা জারি করে। দেশজুড়ে শুরু হয় নিরাপত্তা নিয়ে সুশীলীয় হৈচৈ। একের পর এক জঙ্গি হামলা। এসব হামলার প্রতিটির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আইএস দায় স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে মার্কিন সংগঠন সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ। সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পর আইএস যে সকল ওয়েব সাইটের মাধ্যমে হামলার দায় স্বীকার করে সেসব ওয়েব সাইটের কোনটিতে বাংলাদেশে হামলার বিষয়ে উল্লেখ না থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইট ইন্টেলিজেন্স একতরফাভাবে বাংলাদেশে জঙ্গি হামলা আইএস করেছে বলে জানিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার সাইট ইন্টেলিজেন্সের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের দেয়া তথ্যের উৎস জানতে চাইলেও তারা কোনো গ্রহণযোগ্য সূত্র উল্লেখ করতে পারেনি। সাইট ইন্টেলিজেন্সের দেয়া তথ্য অনুসারী পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশে আইএস সক্রিয় রয়েছে বলে প্রচার করতে থাকে। সংসদে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন দেশে আইএস এর উপস্থিতি স্বীকার করার জন্য সরকারের উপর বিদেশী রাষ্ট্রের চাপ রয়েছে। অন্যদিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্রেসক্লাবে গিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জঙ্গি মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এই আহ্বান বুঝিয়ে দিয়েছে যে জঙ্গি দমনের অজুহাতে বাংলাদেশে মার্কিন আগ্রাসন বৃদ্ধি করাই হচ্ছে তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। আর সে উদ্দেশ্য পূরণের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে ঘটানো হয়েছে আইএস গন্ধ মাখানো বিভিন্ন রকমের জঙ্গি হামলা। আমেরিকানদের সঙ্গে যৌথভাবে জঙ্গি দমন প্রকল্পের মাশুল দিচ্ছে ইরাক, আফগানিস্থান, লিবিয়া। কথায় বলে, আমেরিকা যার বন্ধু তার শত্রুর প্রয়োজন হয় না।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উপরোক্ত জঙ্গি হামলার দায়ে বেশ কিছু জঙ্গি গ্রেফতার করেছে। তাদের অনেকেই জঙ্গি হামলায় অংশগ্রহণের কথা স্বীকার করেছে। এদের বেশিরভাগ হচ্ছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে মুজাহিদিন বাংলাদেশ(জেএমবি)। জামায়াত সদস্যদের নিয়ে জেএমবি গঠন হয় ২০০১-০৬ সালের জামায়াত-বিএনপি শাসনামলে। গুলশানের রাস্তায় ইতালিয়ান নাগরিক হত্যায় বিএনপির এক নেতা এবং তার ভাই জড়িত বলে পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি দিয়েছে গ্রেফতারকৃত ভাই এবং অন্যান্যরা। গ্রেফতারকৃত  সকলেই বিএনপির কর্মী। বছরের শুরুতে অগ্নিসন্ত্রাসে ব্যর্থ জামায়াত-বিএনপি স্বাধীনতা বিরোধী জোট রাজনৈতিক মূলধন হারিয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে; পশ্চিমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশকে বিশ্ববাসীর কাছে সন্ত্রাস কবলিত রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করতে তারা বেপরোয়া হয়ে যায়। জঙ্গিবাদী তাণ্ডব ঘটিয়ে বাংলাদেশকে সন্ত্রাস কবলিত রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করে তুলতে পারলে দেশের রাজনীতি অস্থিতিশীল হবে। অস্থিতিশীল রাজনীতির ঘোলা পানিতে একটা সামরিক সরকার স্থাপন করতে পারলে ফিরে পাওয়া যেতে পারে ১৯৭৫ থেকে ২০০৮ সালের মতো স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের হাতে নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ। সে চেষ্টায়ও জামায়াত-বিএনপি জোট ব্যর্থ হয়েছে। জঙ্গিবাদী সন্ত্রাস করে দেশবাসীর কাছে তারা জনগণের কাছে ধিকৃত হয়েছে। বছর শেষের পৌরসভা নির্বাচনে জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। এই নির্বাচনে তারা পেয়েছে মাত্র ২৪টি মেয়র পদ যেখানে আওয়ামী লীগ পেয়েছে ১৮০টি; বিদ্রোহী আওয়ামী লীগ পেয়েছে আরও ১৭টি।

এ বছরের আরেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, বিজয় দিবসের পরে এবং পৌরসভা নির্বাচনের প্রাক্বালে জামায়াত-বিএনপি জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এক সভায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সর্বজন স্বীকৃত সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক তুলেছেন। এ বক্তব্য দিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছেন বেগম জিয়া। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী পক্ষ ৭২ সাল থেকেই এ বিতর্ক করে আসছে। সুশীল সমাজ যতই মুক্তিযুদ্ধ চাদর দিয়ে বিএনপিকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করুক না কেন বেগম জিয়া এ বছর জামায়াত, মুসলিম লীগের সঙ্গে সুর মিলিয়ে নিজেকে আরেক বার মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী পক্ষের লোক হিসেবে চিনিয়ে দিয়েছেন। বেগম জিয়ার বিতর্ক সৃষ্টিকারী বক্তব্যের চার দিন পর তার দলের নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ‘নির্বোধ’ বলেছেন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের। বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে কথা বলে সুর মিলিয়েছে পাকিস্তানের রাজনৈতিক মহলের এবং একই সঙ্গে এদেশে বসবাসকারী প্রায় ৩০% পাকিস্তানী মানসিকতার মানুষের সঙ্গে যারা মুক্তিযুদ্ধকে গণ্ডগোল বলে, যারা বলে– ‘মেরী মি আফ্রিদি’। মূলধারার বাংলাদেশ রাজনীতিতে পরিত্যক্ত বেগম জিয়া ও তার দল স্বাধীনতা বিরোধী কথা বলে তাদের জোটের পাকিস্তানপন্থী, মৌলবাদী এবং জঙ্গিবাদী সলিড সমর্থক ৩০% মানুষকে আঁকড়ে ধরেছেন। এর সঙ্গে সুশীল সমাজ বিভিন্ন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে সুইং ভোটারদের থেকে ২০% এনে দিতে পারলেই তো জিতে নেয়া যায় একেকটা নির্বাচন। বিএনপির এই সাম্প্রতিক অবস্থান দেখে এটা বোঝা যায় যে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত আর ৪ লক্ষ বিরাঙ্গনার সম্ভ্রমের দামে কেনা স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী রাজনীতি এখনো স্ববলে বিদ্যমান রয়েছে। আর এর পেছনে সবচেয়ে ক্রিয়াশীল রয়েছে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার এবং মিথ্যা প্রপাগাণ্ডা করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি। স্বাধীনতাবিরোধী এই চক্রের হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য দরকার দীর্ঘ মেয়াদী যুগপদ অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লব।

এ বছরে তিন প্রধান যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল প্রদত্ত রায় কার্যকর হয়েছে। এরা হচ্ছেন, জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের মন্ত্রী ও জামায়াতের জেনারেল সেক্রেটারী আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ এবং চট্টগ্রাম-২ আসন থেকে ছয় বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। মুজাহিদ প্রকাশ্যে বলেছিলেন, বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই। বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং সামাজিক আলোচনায় জাতীয় রাজনীতি, রাজনৈতিক নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অশ্লীল উক্তি ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা বিকৃত মানসিকতার সালাউদ্দিন দম্ভ করে বলেছিলেন, ঐসব ট্রাইব্যুনালে এক তুড়িতে উড়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দালাল আইনের অধীনে বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দিয়ে এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের ইনডেমনিটি দিয়ে, পুরস্কৃত করে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল যে আইনের শাসন তা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।

২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনেকটা ফিরে এসেছে বাংলাদেশ। নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিচার চলছে একাত্তরের গণহত্যার, মানবতাবিরোধী অপরাধের। একে একে বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে দেশের আনাচে-কানাচে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের। সরকারের অব্যাহত চেষ্টা থাকা স্বত্বেও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে শক্তির অসহযোগিতার কারণে পশ্চিমা দেশগুলোতে লুকিয়ে থাকা সাজা পাওয়া যুদ্ধাপরাধীদের দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। এই দুর্বলতাটুকু নিয়েও বলা যায় এবারের বিজয় দিবসটা অনেক ভিন্ন রকম ছিল। কয়েকটা কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী, বিশেষ করে আলবদর প্রধান মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পরের বিজয় দিবস। ফিরে আসতে শুরু করেছে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার বাংলাদেশ; বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে জিয়া-গোলাম আযম-খালেদা-নিজামি পাকিস্তানী আদর্শের যে বাংলাদেশ বানাচ্ছিল সে পথ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। উঠে এসেছে আবহমানকাল থেকে চলে আসা বাঙালি চেতনার মহাসড়কে- চণ্ডিদাস, লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের বাংলাদেশে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)