রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ সম্প্রতি এক জনসভায় বলেছেন, রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের পকেটে। বর্তমান বাংলাদেশ রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ ইতিহাসের যেকোন সময়ের থেকে বেশি। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, যেখানে উন্নত বিশ্বে রাজনীতিতে আইনজীবীর সংখ্যা ৮০% সেখানে বাংলাদেশে ব্যবসায়ীর সংখ্যা একই রকম।
রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের অধিকতর অংশগ্রহণের ফলে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কতিপয় পুঁজিপতির হাতে চলে গিয়েছে। তারা একদিকে বিপুল অংকের কর ফাঁকি দেয় অন্যদিকে বিভিন্ন আইন পাশের প্রক্রিয়ার উপর প্রভাব বিস্তার করে সাধারণ মানুষের দেয়া করের অর্থ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং অবকাঠামো নির্মাণের নামে নিজেদের পকেটস্থ করছে।
১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যবসায়ী সাংসদ ছিলেন ৪%, ‘৭৩ সালে ১৩%, ‘৭৯ সালে ৩৪%, ‘৯৬ সালে ৪৮%, ‘০১ সালে ৫১%, ‘০৮ সালে ৬৩% – এই তথ্য দিয়েছে দ্যা ডেইলি স্টার। বর্তমান সংসদে কত শতাংশ ব্যবসায়ী আছেন তা জানায়নি পত্রিকাটি।
লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে সংসদে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ১৩% থেকে একলাফে ৩৪% এ উন্নীত হয়। মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে ব্যবসায়ীদের প্রভাব বাড়ে ২১%। ‘৭৯ নির্বাচন ছিল টার্নিং পয়েন্ট।
এরপর থেকে রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের আধিপত্য দিন দিন শুধু বেড়েই চলেছে। ধীরে ধীরে ব্যবসায়ীদের আধিক্য বাড়ল কেন? রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের সংখ্যাধিক্য থাকলে ক্ষতি কি? এই দুটি প্রশ্ন রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের পরে রাজনৈতিক এবং সামাজিক আলোচনার কেন্দ্রে থাকা দরকার।
প্রশ্ন দুটির উত্তর খুঁজতে যেতে হবে ইতিহাসের গভীরে। ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলে পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে যুক্তরাষ্ট্র। গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে হটিয়ে দিয়ে সেনা শাসন কায়েমের মাধ্যমে ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদী অর্থনীতি চালু হয় পাকিস্তানে। রাষ্ট্র পরিচালনার নিয়ন্ত্রণ পুঁজিপতিদের হাতে চলে যায়।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানী আগ্রাসন পরাজিত করে বাঙালির মূল চেতনাগুলো রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক জীবনে ফিরে আসে। বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্যে দিয়ে ‘৭১ এর পরাজিত শক্তি পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং আমেরিকার সক্রিয় অংশগ্রহণে বাংলাদেশের রাজনীতির স্বাভাবিক গতি বদলে যায়।
মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তিরা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নিয়ে দেশে দুইটি প্রধান পরিবর্তন আনেঃ ১) মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নস্যাৎ; এবং ২) পুঁজিবাদী অর্থনীতির পুনঃপ্রচলন। প্রথমটি হচ্ছে পাকিস্তানী, সৌদি এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের এজেণ্ডা। দ্বিতীয়টি আমেরিকানদের তথা সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমাদের এজেণ্ডা। দ্বিতীয় এজেণ্ডা বাস্তবায়ণের সুযোগ আদায় করার জন্যই পশ্চিমারা প্রথম এজেণ্ডার প্রতি সমর্থন দিয়েছে, দিয়ে যাচ্ছে।
পুঁজিবাদী বিশ্বে বেসরকারি খাতের গুরুত্ব অনেক। সকল রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে এক নম্বর প্রাধান্য; তারপরে অন্য সবকিছু। এ কথার পক্ষে সাম্প্রতিক সময়ের উদাহরণ দিলে সর্বাগ্রে আসে আমেরিকার স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়ণের লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট ব্যারাক ওবামা গৃহীত স্বাস্থ্য সেবা নীতি ও পদ্ধতি যা ‘ওবামাকেয়ার’ নামে সমধিক পরিচিত। ওবামা ২০০৮ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার আগে তাঁর নির্বাচনী ইস্তেহারে স্বাস্থ্য সেবাকে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে এনে দেয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। নির্বাচনে জেতার পর তিনি যখন সে অঙ্গীকার বাস্তবায়ণ করতে গেলেন তখন সামনে দাঁড়াল পাহাড় সমান অলঙ্ঘনীয় বাঁধা।
মূল কারণ, ওবামাকেয়ার বাস্তবায়ণ করা হলে বীমা কোম্পানি, ঔষধ উৎপাদক এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ব্যবসায়ীক ক্ষতি হতে পারে। এই আশঙ্কায় ধনী এবং রক্ষণশীলদের দল রিপাব্লিকান পার্টি ওবামার স্বাস্থ্য আইন পাশ করার পদে পদে বাঁধা দেয়। তাঁর পথের কাটা হয়ে দাঁড়ায় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষাকারী নিজের দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির কিছু সদস্যও।
পুঁজিবাদীদের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের আরেকটি জঘন্য উদাহরণ ছোট অস্ত্র (পিস্তল, বন্দুক) ব্যবসা। গত তিন বছরে শুধু আমেরিকাতেই ছোট অস্ত্র ব্যবহার করে এক সঙ্গে একাধিক মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটেছে প্রায় এক হাজার। এইসব ঘটনার মধ্যে যে কয়েকটি আন্তর্জাতিক আলোচনায় এসেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে স্কুলে গিয়ে গুলি করে নির্বিচারে শিশু হত্যা। কয়েক দফা উদ্যোগ নিয়েও অস্ত্র ব্যাবসায়ীদের প্রচণ্ড চাপের মুখে ছোট অস্ত্রের অবাধ কেনাবেচা বন্ধ করতে পারেনি ওবামা প্রশাসন।
আমাদের দেশেও রাজনীতিতে, অন্য কথায় সরকারি নীতি নির্ধারণে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য চোখে পড়ার মত। দু’একটি উদাহরণ দেয়া যাক। প্রাক-বাজেট আলোচনায় সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর দাবী দাওয়া। কৃষক-শ্রমিক বা অন্যান্য পেশাজীবীদের সঙ্গে বাজেট আলোচনা হয় না বললেই চলে। পশ্চিমা বিশ্বের মত আমাদের দেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যমের মালিক ব্যবসায়ীরা; সাংবাদিক বা সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরা নয়। ব্যবসায়ীদের মালিকানাধীন গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত খবর পড়ার সময় স্পটভাবে দেখা যায় যে তারা নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সামাজিক বা রাজনৈতিক ইস্যুগুলোর থেকে বেশি প্রাধান্য দেয় ব্যবসায়িক ইস্যুগুলোতে।
২০০৮ সালে পশ্চিমাদের দীর্ঘ দিনের আর্থিক দূর্নীতির ফলে আর্থিক সংকট তৈরী হলে সেসব দেশের অর্থনীতি অচল হয়ে পড়ে। বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে তাদের অর্থনীতি চালু রাখার জন্য কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষা করা হয় যে প্রক্রিয়ায় যার নাম দেয়া হয় ‘বেইল আউট’।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পশ্চিমা দূর্যোগের প্রভাব না পড়লেও অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছিলাম যে এখানকার পত্রিকাগুলো রফতানিকারক কোম্পানিগুলোকে ‘বেইল আউট’ করার দাবী জানাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের উটকো দাবীর মুখে অর্থমন্ত্রী প্রশ্ন করেছিলেন, কোম্পানিগুলোতো বন্ধ হয়নি বা হওয়ার অবস্থাও সৃষ্টি হয়নি তাহলে বেইল আউটের দাবী আসছে কেন? অর্থমন্ত্রীর জোড়াল অবস্থানের কারণে ব্যবসায়ীরা তখন রাষ্ট্রীয় কোষাগার খালি করার ব্যবস্থা করতে পারে নি।
সে দফা সুবিধা করতে না পারলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবী আদায় করার জন্য ২০১৩ সালের দেশব্যাপী ব্যাপক সহিংস আন্দোলনের পর পোশাক রফতানীকারকদের ক্ষতি পোষানোর অজুহাতে রফতানি আয়ের উপর বিদ্যমান ০.৮% উৎসে কর কর্তনের হার কমিয়ে ০.৩% করা হয়েছিল যা বর্তমান বাজেটে ০.৫%। ‘১৩ সালের সহিংসতার ক্ষতিকর প্রভাব পোষাক রফতানিতে পরিলক্ষিত হয়নি। সে বছরও এই খাতের রফতানি প্রবৃদ্ধি অন্যান্য বছরের মতই ছিল। তবে কেন আগাম কর কমানো হল? ক্ষতি যা হয়েছিল তা তো সকলেরই হয়েছে; শুধু পোষাক রফতানিকারকদের নয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল দিন এনে দিন খাওয়া লোকেদের। সরকার তাদের ক্ষতি পোষানোর জন্য কিছুই করে নি।
গত কয়েক দশক ধরে চলা পুঁজিবাদের পোষাকি নাম ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’ মানব সভ্যতায় অনেক কিছুর সঙ্গে যোগ করেছে ব্যাপক আয় এবং সম্পদ বৈষম্য। বিশ্ববিখ্যাত নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিটজ জানিয়েছেন ‘৮০’র দশক থেকে যত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে তার পুরোটাই গিয়েছে টপ ১০% ধনীর পকেটে; বাকি ৯০% মানুষের আয় একই রকম রয়েছে। এই বৈষম্য সৃষ্টি করা বা অন্য কথায় গরীবের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করার কাজটি সাফল্যের সঙ্গে করা সম্ভব হয়েছে রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য বিস্তারের মাধ্যমে।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর রাজনীতিতে আমেরিকানদের প্রভাব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা ধারার ব্যবসা নির্ভর রাজনীতির চাষাবাদ শুরু হয় বাংলাদেশে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পশ্চিমাদের প্রভাব কমে সাম্যবাদী ভাবধারায় অর্থনীতি পরিচালনা করেন মুক্তিদাতা শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে অর্থনীতি আবার বদলে পুঁজিবাদী নীতি ফিরে আসে। পুঁজিবাদকে প্রতিটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে চাই রাজনীতির উপর পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রণ।
৭৫ সালের পর পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের চাপিয়ে দেয়া দুইটি সামরিক শাসন দূর্নীতি এবং সন্ত্রাসের মাধ্যমে এই নিয়ন্ত্রণ আনতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। গণতন্ত্রের মুখোশ নিয়ে চলা রাজনৈতিক দলগুলো পরবর্তী সময়ে সে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছে। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ডানপন্থী দল বিএনপি’র রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে পুঁজিবাদের কোন বিরোধ নেই। তারা নিশ্চিন্তে পুঁজিবাদকে দিন দিন ব্যাপকতা দিয়ে এসেছে।
সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি ‘সমাজতন্ত্র’ যোগ করা মধ্যবাম ধারার দল আওয়ামী লীগকে পুঁজিবাদ মেনে নিতে হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমীকরণ বিবেচনায়। ২১ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে থাকা আওয়ামী লীগ ‘৯৬ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা বাংলাদেশে পুঁজিবাদ বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে নি এমন কি ‘৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়েও কথা বলে নি।
পশ্চিমাদের স্বার্থে সরাসরি আঘাত না করে তারা শুরু করেছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার। ২০০৮ সালের নির্বাচনে পুনরায় জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ তার স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করে; গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুন্যাল; ঘোষণা দেয় রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বেসরকারি খাতে বিক্রি বন্ধ করার। ৯৬ সরকারের সময়ে চালু করা দরিদ্র, দুঃস্থ, প্রতিবন্ধী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতার পরিধি বাড়িয়ে ফেলে অনেক অনেকগুণ। এর ফলে গরীব মানুষদের হাতে নগদ প্রবাহ বাড়তে থাকে, অর্থনীতি চাঙ্গা হতে থাকে, বৈষম্য কমতে থাকে।
বেশ কিছু অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ কর্মসূচী গ্রহণ করলেও রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের প্রভাব হ্রাস করার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার এখনো কোন পদক্ষেপ নেয় নি। এই পদক্ষেপ নেয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। মানুষ পুড়িয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে স্বাধীনতা বিরোধী ডানপন্থী দলগুলো এখন বাংলাদেশ ইতিহাসে সবচেয়ে দূর্বল অবস্থায় রয়েছে। তাদের পৃষ্ঠপোষক আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদীরা বাংলাদেশে বিতর্কিত।
শীতল যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তারা সমগ্র বিশ্বে যে আধিপত্য সৃষ্টি করেছিল যা চীনের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে এবং রাশিয়ার সামরিক শক্তি প্রদর্শনে ম্লান হয়ে গেছে। এরকম পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগে সংস্কার করে দল থেকে সন্ত্রাসীদের বের করে এবং ব্যবসায়ীদের প্রভাব হ্রাস করে দিতে পারলে বাংলাদেশে আবার বিকশিত হবে সুস্থ রাজনীতি; প্রতিষ্ঠিত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ; নিশ্চিত হবে খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার – এ প্রত্যাশাই রাষ্ট্রপতি ব্যক্ত করেছেন অষ্টগ্রাম হাই স্কুলের মাঠে।