চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বেকারদের আখ্যান ‘চাকরিনামা’

‘চাকরিনামা’য় কেবল বেকারের ব্যর্থ জীবন নয়, সফল জীবনও দেখানোর চেষ্টা করেছি। সফলতার সূত্রেরও আছে চমৎকার ব্যবহার।

‘চাকরিনামা’ উপন্যাস লেখা শুরু করেছিলাম ২০১৭ সালের সেপ্টম্বর মাসে। প্রথমদিকে পরিকল্পনা ছিল একটা গল্প লিখবো চাকরির বর্তমান হালচাল নিয়ে। এর কয়দিন পর মনে হলো গল্প নয়, উপন্যাসই লিখবো। এবং লেখা শুরু করি এ উপন্যাস।

সমাজে বেকাররা নিন্মবর্গ । ফলে তাদের স্বর পৌঁছায় না সমাজ, দেশ, পরিবার, বন্ধু-বান্ধব এমনকি প্রেমিকার কাছেও। তারা অনার্স-মাস্টার্স শেষ করার পরেও সমাজে অবহেলিত, বঞ্চিত এবং অপমানের এক জীবন অতিবাহিত করে। দেশে যে হারে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে সে তুলনায় কর্মের সুযোগ কম। ফলে হতাশা আর যন্ত্রণা তাদের চারপাশ ঘিরে রাখে। বেকারের মেধা ও প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও সুযোগের অভাবে এর প্রয়োগ করতে পারছে না। চাকরি-বাকরি না থাকায় বেকাররা যে যন্ত্রণাবিদ্ধ সময় পার করে তা আমাকে ব্যথাহত করে। তাদের জীবন নিয়ে লেখার চেষ্টায় নিজেকে যুক্ত করি।

পড়ালেখা শেষ করার পর চাকরি না থাকা সাময়িক সমস্যা। এটাই মানতে পারে না চারপাশের মানুষ। আমাদের চাকরি ব্যবস্থা হয়ে গেছে এককেন্দ্রিক, সেই কেন্দ্র হলো বিসিএস। এখন পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে একজন বিসিএস ক্যাডারের অনেক গুরুত্ব। একজন ক্যাডার সমাজ ও মানুষের কাছে আইকন হিসেবে পরিগণিত। বন্ধু-বান্ধব, প্রেমিকা, পরিবার, সমাজে তার অনেক কদর। ফলে ছাত্রছাত্রীরাও যাচ্ছে ওই পথে।

ইউনিভার্সিটির প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েই একজন স্টুডেন্ট লাইব্রেরিতে যায় বিসিএস এর বই পড়তে। দেশ ও দশ বিসিএস জ্বরে আক্রান্ত। রাষ্ট্র তো কেবল বিসিএস ক্যাডার দিয়েই চলবে না। ক্যাডারদের পাশাপাশি প্রয়োজন আছে গবেষক, উদ্যোক্তা, প্রয়োজন আছে ভালো চিকিৎসক, ভালো ইঞ্জিনিয়ার, ভালো বিজ্ঞানী, ভালো শিক্ষকের। প্রয়োজন আছে ভালো লেখক কিংবা সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের। প্রয়োজনের এমন অনেকগুলো সূত্রের উল্লেখ করেছি ‘চাকরিনামা’য়।

পরিশ্রম আর দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও ভোতাই থেকে যাচ্ছে বেকারের মেধা ও প্রতিভা। মাস্টার্স পাস করার পর একজন বেকারের থাকে অনেক চাপ। এ সময় পরিবার ও কাছের মানুষদের সহযোগিতা খুবই দরকার হয়। কিন্তু তারা কাছে থাকে না। পরিবার টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেয়। কাছের মানুষেরা দূরে সরে যায়। ফলে একজন বেকার আরো চাপে পড়ে যায়। যন্ত্রণার উপর যোগ হয় মাত্রাতিরিক্ত যন্ত্রণা। তারা পায় পলায়নপর জীবন। তারা হয়ে ওঠে সমাজ বিচ্ছিন্ন মানুষ। যেখানে নাই আদর-সোহাগ কিংবা সম্মানের স্বর। অপমান, যন্ত্রণা আর পলায়নপর জীবন যাপন করতে করতে বেকাররা পড়ে যায় অস্তিত্বের সংকটে। এ সত্ত্বেও নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সংগ্রামী হয়।

চরিত্র চাকরির পেছনে ছোটে আবার টিউশনিরও খোঁজ রাখে, কোনোরকমে দিন কাটানোর জন্য। কেউ কেউ জয়েন করে যেনতেন চাকরিতে। তারা পড়ে আরো বড় ভোগান্তিতে। কেউ কেউ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারে। কেউ কেউ ব্যর্থ হয়।

যখন একজন ছেলে কিংবা মেয়ের বিয়ে করে সংসারী হওয়ার সময় তখনও সে পড়ছে। এই পড়া গল্প-উপন্যাস পড়ার মতো মজার নয়। এই পড়ার টপিকগুলো বিদঘুটে। তবুও পড়তে হয়। এ পড়ার সাথে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পাঁচ বছরের পড়ার সম্পর্ক খুব বেশি থাকে না। নতুন করে সব কিছু শুরু করতে হয়।
দেশে কর্মের সুযোগ এমনিতেই কম। যেটুকু আছে সেখানেও কোটা বৈষম্য। চাকরিতে থাকা এই বৈষম্য কমাতে তারা আন্দোলনের ডাক দেয়। কোটা সংস্কার করতে গিয়ে তাদের সহ্য করতে হয় পুলিশি হামলা। অবশ্য তারা কিছুটা সফল হয়। তাদের আন্দোলনের ফল হিসেবে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটায় নিয়োগ বন্ধ হয়। তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে বহাল আছে কোটা।

চরিত্ররা যাপিত জীবন থেকেই জেনেছে মানুষের অকৃতজ্ঞতা, বিশ্বাসহীনতা। মনের ভেতরে থাকা ক্ষোভ, যন্ত্রণা প্রকাশ করে বেকাররা তাদের নিত্য ব্যবহার্য ভাষায়। যেখানে থাকে না কোনো রাখঢাক।

উপন্যাসটি কেবল বেকারের ব্যর্থ জীবন নয়, সফল জীবনও দেখানোর চেষ্টা করেছি। সফলতার সূত্রেরও আছে চমৎকার ব্যবহার। চাকরি-বাকরিতে না থাকা লেখকের হাতেই লিখিত হলো বেকারদের জীবনকথা।
উপন্যাসটি লিখেছি শুক্র-শনিবার এবং ছুটির দিনগুলোয়। কারণ মনে সান্ত্বনা থাকতো এইসময় অফিস আওয়ার নাই। চাকরির সার্কুলার হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকতো। মনে হতো অন্যরাও আমার মতো ঘরে আছে। তারা অলস সময় কাটাচ্ছে, আমি লিখছি। দুঃশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেয়ে চমৎকার মনোযোগের সাথে যাতে লিখতে পারি এজন্যই বেছে নিতাম এই সময়গুলো। এই দিনগুলো।

সবশেষে, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বেকারদের জন্য আরো কর্মের সুযোগ তৈরি হোক। বদল আসুক প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ও সিলেবাসে। বদল আসুক নিয়োগ প্রক্রিয়ায়। দেশের সব চাকরি প্রত্যাশীরা চাকরি পাক। রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবারে বেকারদের সম্মান বাড়ুক।

চাকরিনামা
প্রকাশনী: অনিন্দ্য প্রকাশ
প্রচ্ছদ: তৌহিন হাসান
মূল্য: ৩০০ টাকা।