নাটক কিংবা চলচ্চিত্র, চরিত্রাভিনেত্রী বা চিত্রনায়িকা- সবখানেই সফল নুসরাত ইমরোজ তিশা। শোবিজ সংশ্লিষ্টরা তো সবসময়ই বলে থাকেন, তিশা অভিনয়ে যেমন পরিণত, তেমন অফস্ক্রিনেও চমৎকার ব্যবহারে মুগ্ধতা ছড়ান। ক্যারিয়ারে তুঙ্গে থাকা তিশা সর্বমহলে প্রশংসিত হচ্ছেন তার ব্যতিক্রমী কাজ দিয়ে। শহুরে কিংবা গ্রামীণ, প্রেমিকা কিংবা গৃহিণী- যে কোনো চরিত্রে তিশার জুড়ি নেই! জনপ্রিয় এ তারকা এবার হাজির হচ্ছেন ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী নারী ও প্রথম মহিলা শহীদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের চরিত্রে।
সরকারি অনুদানে নির্মিতব্য প্রদীপ ঘোষের পরিচালনায় ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’ নামে এ ছবির দ্বিতীয় লটের শুটিং করছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত নুসরাত ইমরোজ তিশা। ওই ছবির শুটিং চলছে রাজধানীর নাজিমুদ্দিন রোডের পুরাতন জেলখানায়। শুটিং সেটে বসেই তিশা তার নতুন এ ছবি নিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে আলাপ করলেন। সেই আলাপের গুরুত্বপূর্ণ অংশ থাকলো এই সাক্ষাৎকারে:
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের চরিত্র যে কোনো অভিনেত্রীর কাছে স্বপ্নের মতো। একইসঙ্গে ভীষণ চ্যালেঞ্জিং। কোন ভাবনা থেকে এরকম চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে অভিনয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন?
পিরিয়ডিক্যাল ছবিতে এর আগেও কাজ করেছি। এটা যেমন ড্রিম প্রজেক্ট, তেমনি ব্যতিক্রম অন্যখানে। প্রায় ১০০ বছর আগের সময়কে ধারণ করতে হচ্ছে। সেই পারসপেক্টিভ ধারণ করে কাজটা করা সত্যি খুব কঠিন। প্রীতিলতা উপন্যাস আমার আগে থেকেই পড়া। যিনি লিখেছেন, সেলিনা হোসেন আমার পছন্দের লেখকদের একজন। দীর্ঘদিন ধরে তার সঙ্গে আমার পরিচয়। তার সঙ্গে দেখা করে গল্পটা নিয়ে কথা বলেছি। প্রীতিলতাকে ওনার চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি। পরিচালক যিনি, তিনিও অনেক অভিজ্ঞ। বহু বছর ধরে তিনি এ বিষয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছেন। তার কাছে থেকে প্রীতিলতার বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেছি। ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রীতিলতাকে খুব বেশি জানা সম্ভব নয়। প্রীতিলতার ডায়েরি থেকে কিছু নলেজ নিয়েছি। প্রীতিলতাকে পোট্রেট করা কঠিনসাধ্য ব্যাপার, কিন্তু অসাধ্য নয়। প্রচুর পড়ালেখা করে প্রীতিলতাকে ধারণ করে কাজের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
একই সঙ্গে প্রীতিলতাকে নিয়ে দুইটি চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে। একটিতে আপনি, অন্যটিতে পরীমনি অভিনয় করছেন। একই সময়ে একই বিষয় নিয়ে দুইটি চলচ্চিত্র নির্মাণকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
স্মরণীয় চরিত্র এবং কনসেপ্ট নিয়ে একাধিক সিনেমা হওয়া উচিত। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একাধিক সিনেমা হচ্ছে। দেশের বাইরে বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে একাধিক সিনেমা হচ্ছে। প্রীতিলতাকে নিয়ে আগে কেউ কোনো সিনেমা বানায়নি। তার বিদ্রোহ নিয়ে সাহস করে দুটো সিনেমা হচ্ছে এটা খুবই ইতিবাচক ব্যাপার। আমার বিশ্বাস, দুটো সিনেমাই ভালো হবে। সঠিক তথ্যগুলো উঠে আসবে।
২১ বছর বয়সী প্রীতিলতার চরিত্রে বিশ্বাসযোগ্য অভিনয়ের জন্য আপনার দিক থেকে কী কী প্রস্তুতি নিয়েছেন?
এই চরিত্রটা করার আগে বড় একটা বিরতি নিয়েছিলাম। একজন সাধারণ মেয়ে থেকে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে মেয়ের চরিত্র করতে মনস্থির করতে হয়েছে। এ চরিত্রের সঙ্গে আমাকে বসবাস করতে হয়েছে। চরিত্রটা এমন যে আমি ভিজ্যুয়ালি কিছুই দেখতে পাইনি। যতটুকু প্রস্তুতি নিয়েছি লেখাপড়ার মাধ্যমে। একটা চরিত্রকে এক্সিকিউট করার জন্য পুরো টিমের সাপোর্ট দরকার হয়। ব্যক্তিগতভাবে বলতে গেলে প্রীতিলতা চরিত্রকে ধারণ করার জন্য প্রীতিলতা সম্পর্কে ছোট বড় সব ধরনের নিউজ, পরিচালকের পরামর্শ, স্ক্রিপ্ট, বিভিন্ন বই পড়েছি। এছাড়া প্রীতিলতার কথা বলার বাচনভঙ্গি, ব্যক্তিত্ব, হেয়ার স্টাইল, পোশাক, প্রীতিলতার সঙ্গে রামচন্দের সম্পর্ক, প্রীতিলতার ইনার সাইট সবকিছু আলোচনার মাধ্যমে জেনে চেষ্টা করেছি নিজেকে প্রস্তুত করতে। আবারও বলছি এটা খুব কঠিন কাজ, কিন্তু অসাধ্য কিছুই না।
অভিনয়ের আগে ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’ উপন্যাসের লেখিকা, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের কাছ থেকে কোন্ পরামর্শগুলো নিয়েছেন?
প্রীতিলতার মানসিকতা, চিন্তাধারা, সে কী ধরণের মেয়ে ছিল- এই বেসিক তথ্যগুলো পেয়েছি। এ জিনিসগুলো চরিত্র ধারণ করতে অবশ্যই বাধ্যতামূলক। এ জিনিসগুলো আলোচনার মাধ্যমে জেনেছি। লেখিকা সেলিনা হোসেন আমাকে চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
১৯৩২ সালের সমাজবাস্তবতা ২০২১ সালের চলচ্চিত্রে কতটুকু বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে আনা সম্ভব হবে বলে আপনি মনে করেন?এর আগে ভাষা আন্দোলন নিয়ে ‘ফাগুন হাওয়ায়’ করেছি। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করেছি। ওই সময়কার অনেক রেফারেন্স ভিডিও আমাদের সামনে আছে। চরিত্রে ভর করাটা এতে করে অনেক সহজ হয়। কিন্তু ১০০ বছরের পুরাতন কাজ ২০২০ এসে তুলে ধরছি কোনো ভিডিও রেফান্সে পাইনি। তথ্যও সীমিত। এক্ষেত্রে কাজটা পোট্রেট করা খুবই কঠিন কাজ। তবে কঠিন কাজ তখনই ইজি হয়, যখন সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকে। পরিচালক, ডিওপি, মেকাপ, আর্ট ডিরেক্টর থেকে প্রোডাকশনের সবার সহযোগিতায় আমরা চেষ্টা করছি বিশ্বাসযোগ্য ভাবে ওই সময় তুলে আনার। আমার মনে হচ্ছে, এই অসাধ্যটা আমরা সাধন করতে পারবো।
কঠিন সব চরিত্রে ঢুকে চরিত্রের সঙ্গে বসবাস করেছেন। আপনার নন্দিত কাজগুলো তার প্রমাণ। এমন কোনো চরিত্র আছে যেখান বেরিয়ে আসার পর ঘোর কাজ করেছে বা স্বাভাবিক হতে সময় লেগেছে?
আমার সিনেমার সংখ্যা অনেক না হলেও কিছু কঠিন কাজ করেছি। একটা চরিত্রের কথা আমি বলতে পারি যেখান থেকে বের হয়ে আসতে আমার অনেক সময় লেগেছে। তা হলো ‘শনিবার বিকেল’ ছবির চরিত্র। আমার মনে হয় শুধু আমার একার নয়; সিনেমার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেক শিল্পী, পরিচালক এবং সহকারীদেরও সময় লেগেছে। এই কাজটা যদিও দর্শক দেখেনি কিন্তু দেখলে কিছুটা বুঝতে পারবে আমরা কী পরিমাণে পরিশ্রম করেছি।
ছবিটি কবে নাগাদ মুক্তি পেতে পারে?
দর্শকদের মতো ছবিটার জন্য আমিও অধীর আগ্রহে আছি। যদি আমি এ ছবির প্রযোজক হতাম তাহলে হয়তো বলতে পারতাম সত্যিকার জটিলতা আসলে কী! পরিচালক আমার স্বামী হলেও মুক্তি কেন পাচ্ছে না এ ইনফরমেশন তার থেকে জানতে পারিনি। পরিচালক এবং প্রযোজক ভালো বলতে পারবেন।
আপনার জীবনসঙ্গী মোস্তফা সরয়ার ফারুকী একজন জনপ্রিয় পরিচালক। কঠিন চরিত্র ধারণ করতে তার সহযোগিতা পান?অভিনেতা অভিনেত্রীর জীবনে যদি তার সঙ্গী সাপোর্টিভ হয় তাহলে তার জীবনযাপন এবং কাজের জায়গাটা খুব সহজ হয়ে যায়। আল্লাহর কাছে সবসময় শুকরিয়া আদায় করি, আমি জন্মেছি এমন এক পরিবারে যারা সবসময়ে আমাকে সববিষয়ে সাপোর্ট করেছেন। এমন পরিবারে বিয়ে করেছি এবং এমন একজন মানুষের সঙ্গে সংসার করছি তারাও আমাকে সবসময় সাপোর্ট দিচ্ছেন। আমি যখনই কোনো স্বপ্নের চরিত্র পাই, তখনই আমি যতটুকু অ্যাফোর্ড দেই; লেখালিখি, এডিটিং, শুটিংয়ের শত ব্যস্ততার মধ্যেও সরয়ার আমার জন্য সময় বের করে রাখে। যদিও সে আমার চেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে। অবশ্যই সে আমাকে কঠিন চরিত্রগুলো ধারণ করতে সাহায্য করে। প্রথম যখন প্রীতিলতার প্রজেক্ট আমার হাতে, আমি যখন তার সঙ্গে শেয়ার করি; প্রথমে আমাকে সরয়ার বলে, স্ক্রিপ্ট পড়েছো? উপন্যাসটা পড়েছো? তখন আমি দুটোর উত্তরই ‘হ্যাঁ’ বলি। তখন সে আমাকে নিজে নিজে প্রস্তুতি নিতে বলে। এও বলে, যতটুকু সাহায্য দরকার আমি করবো। প্রতিটা ভালো কাজেই এই সাপোর্ট সে আমাকে দিয়েছে। সোজা লাইনে চলতে চলতে কোথাও যদি একটু গিট্টু লেগে যায় তখনই আমি তার শরণাপন্ন হই। তার সাপোর্টে সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। আবার সে তার কাজে যদি কোথাও গিট্টু অনুভব করে আমিও চেষ্টা করি সাহায্য করার। আমি যখন কোনো ভালো প্রজেক্টে কাজ করি, সেও আমার মতই খুশি হয়।
একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। করোনা লকডাউন শিথিল হবার পর থেকে আপনার অনেক সহ-অভিনয়শিল্পীই অভিনয়ে নিয়মিত হয়েছেন। তবে আপনি খুব একটা কাজ করেননি। কারণ কী?
সাড়ে সাত মাসের মতো আমি কাজ থেকে দূরে ছিলাম। নিজের সুরক্ষার পাশাপাশি পরিবারের সুরক্ষার কথা ভেবে কাজ করার সাহস পাইনি। কারণ আমার মা, শ্বশুর, স্বামী, ননদ, দেবর সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে থাকি। সবদিক ভেবেচিন্তেই বিরতি নিয়েছিলাম। ঘরে থেকেও যে কাজ না করে বসে ছিলাম তা কিন্তু নয়। সবাইকে বলেছি, আমি মনে হয় বিয়ের পর এই প্রথম সংসার করলাম। হাহাহাহা…! আসলে বিয়ের পরদিন থেকে কাজ শুরু করেছিলাম। দেশের বাইরে গেলেও ফেস্টিভ্যাল বা বিভিন্ন কাজে যাওয়া হয়। কিন্তু একজন গৃহিণী সংসারের কাজটা এই সাড়ে সাতমাসে আমি করেছি। ঘর গোছানো, দেয়াল রঙ করাসহ ঘরে অনেক এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করেছি। নিজেকে নতুন করে চেনার চেষ্টা করেছি। ছোট ছোট হাতের কাজ, কুটির শিল্পের কাজ করেছি। আমার ছোট বারান্দায় করলা, টমেটো গাছ, বিভিন্ন শাক লাগিয়েছি। সেগুলো রান্না করেছি। এটা গৃহিণী হিসেবে আমার চমৎকার অভিজ্ঞতা।
আফরান নিশো, অপূর্বর সঙ্গে বেশ কিছু জনপ্রিয় কাজ উপহার দিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন তাদের সঙ্গে অভিনয় করতে আপনাকে দেখা যায় না। এটার কী কারণ?
আমি সবার সঙ্গে কাজ করেছি। নিশো, অপূর্ব থেকে শুরু করে জাহিদ ভাই, মাহফুজ ভাই, মোশাররফ ভাই, চঞ্চল দা- মোটামুটি সবার সঙ্গে কাজ করেছি। নতুন এখন যারা ভালো কাজ করছে তাদের সঙ্গে কাজ করছি। হয়তো স্ক্রিপ্ট, শিডিউল, জনরার কারণে নিশো-অপূর্বর সঙ্গে আমার কাজ হচ্ছে না। কিন্তু হচ্ছে না মানে আর হবে না এমনটা নয়। আগামীতে আবার কাজ হতে পারে।
টিভির বাইরে ইউটিউব এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মে কাজের স্রোত বাড়ছে। এ মাধ্যমে কাজ বৃদ্ধি কীভাবে দেখেন ?
ভালো ভালো কাজ হচ্ছে। শক্তিশালী কনটেন্ট নির্মিত হচ্ছে। এটা খুব ভালো। আমিও কিছু শক্তিশালী কনটেন্টে কাজ করেছি। যেগুলো বাজটে বা অন্য ইস্যুর কারণে টিভির জন্য করতে পারিনি। ভালো ভালো কাজ তৈরি হচ্ছে এটাই আমার কাছে আশার ব্যাপার। এছাড়া নতুন নতুন পরিচালক উঠে আসছেন। এটা খুবই ইতিবাচকভাবে দেখছি।
ফর্মুলা বেইজ ছবি ‘মেন্টাল’-এ শাকিব খানের সঙ্গে কাজ করেছেন। তার সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? মেন্টালের পর আর এরকম জনরার ছবি করলেন না কেন?
শাকিব খান কেমন হিরো সেটা দেশের মানুষ মূল্যায়ন করছেন। আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই। শুটিংয়ে আমরা খুব মজা করেছি, উপভোগ করেছি। শাকিব খান খুবই ফ্রেন্ডলি পার্সন। কাজ করতে গিয়ে কখনও মনে হয়নি, আমি শাকিব খানের সঙ্গে সিনেমা করছি! আমার কাছে মনে হয়েছে, তার সঙ্গে আমার অনেক সিনেমা করা হয়েছে। অনেক বছরের যাত্রা। এককথায় তার সঙ্গে আমার কাজের অভিজ্ঞতা দারুণ।
আর মেন্টাল’ করেছিলাম অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। চেয়েছি, আমার ডিকশনারিতে সবধরনের কাজ থাকুক। ‘তিশা এ ধরণের কাজ করেনা’ কেউ যেন এমনটা না মনে করে এজন্য কমার্শিয়াল ছবি ‘মেন্টাল’ করার আরেকটা কারণ। এরপর ‘অস্তিত্ব’ করেছি। কিন্তু এটাকে ফর্মূলা বেইজ ছবি বলা যাবে না। এটা ছিল অটিস্টিকদের নিয়ে কাজ। এরপর আরও অনেকগুলো ছবি প্রস্তাব আমার কাছে এসেছে। কিন্তু স্ক্রিপ্ট বা অন্য কারণে কমার্শিয়াল ছবি আমার আর করা হয়নি। আমি সবসময় সংখ্যার চেয়ে কাজের মানে বিশ্বাসী। মেন্টালের পর ক্রিটিকাল কিছু চরিত্র প্রধান ও গল্পের কাজ পছন্দ হওয়ার সেগুলো করেছি।