চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা সুযোগ বুঝে পক্ষ নিচ্ছেন’

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একটি সম্মানজনক পদ আর মানুষটি একজন সম্ম‍ানিত ব্যক্তি হলেও উপাচার্যরা তাদের নানা কার্যক্রমে বারবারই বিতর্কিত হচ্ছেন। সর্বশেষ বিতর্ক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে কেন্দ্র করে। একজন সাবেক উপাচার্য হিসেবে ড. আনোয়ার হোসেন বলছেন, শিক্ষকরা সুযোগ বুঝে পক্ষ নেওয়ায় আর গণতন্ত্র চর্চার অভাবেই উপাচার্য অপসারণের দাবিতে আন্দোলন দেখছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার।

তিনি বলেন: সরকার বদল হলে উপাচার্যকে বঙ্গভবনে চায়ের আমন্ত্রণ জানানো হয়, চা খেয়ে এসে পদত্যাগ করেন তিনি। তার জায়গায় আরেকজনকে কয়েক মাসের জন্য অস্থায়ী নিয়োগ দেয়া হয়। ৭৩’এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী তাকে সিনেটের মাধ্যমে মনোনীত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করতে বলার সংস্কৃতি চালু আছে। এভাবে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি থাকলেও গোটা প্রক্রিয়ায় যে গণতান্ত্রিক চর্চা থাকার কথা তা দুঃখজনকভাবে অনুপস্থিত।

‘১৯৭৩ এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশকে পাশ কাটিয়ে বছরের পর বছর উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের অপচর্চা অব্যাহত আছে। পরিতাপের সঙ্গে লক্ষ্য করছি এর সুযোগ নিচ্ছেন শিক্ষকরা,’ বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতির অন্যতম এ পুরোধা যিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্বর্তী উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করে নির্বাচিত উপাচার্যের কাছে দায়িত্ব ব‍ুঝিয়ে দিয়েছেন।

চ্যানেল আই অনলাইনকে ড. আনোয়ার বলেন,‘১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ছিলো সদ্য পাওয়া স্বাধীনতার প্রাথমিক সুফলগুলোর একটি। এই অধ্যাদেশের আওতায় স্বায়ত্ত্বশাসন পায় ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। স্বাধীন স্বকীয়সত্তা হিসেবে দেশ ও গণতন্ত্রকে শক্ত ভিত্তি দিতেই এই অধ্যাদেশ জারি হয়েছিলো। কারণ বৃটিশ শাসন এবং পাকিস্তানি শোষণের নানা কালাকানুনে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মুক্তমত এবং গণতন্ত্র চর্চা ছিলো না’।

শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই অধ্যাদেশের চর্চা হলেও ’৭৩ এর ধারাগুলো এখন অনেকটাই অবহেলিত বলে মনে করেন ড. আনোয়ার। বিশেষ করে উপাচার্য নিয়োগে অধ্যাদেশের ১১(১) ও ১১(২) ধারা অনেকদিন ধরে কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ বলে জানান তিনি।

১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের ১১ (১) ধারায় বলা হয়েছে উপাচার্য নির্বাচিত হবেন সিনেটের মাধ্যমে। আর ১১(২) ধারায় আছে, জরুরি প্রয়োজনে আচার্য (রাষ্ট্রপতি) অস্থায়ীভাবে উপাচার্য নিয়োগ দেবেন এবং যতো দ্রুত সম্ভব সিনেট তা পাস করবে।

‘অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট নির্বাচন ও প্রতিনিধিত্ব এখন প্রশ্নবিদ্ধ,’ মন্তব্য করে আনোয়ার হোসেন বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট নির্বাচনে ১০৫ জনের মধ্যে ৫০ জন অংশ নেন। ‘এই সিনেট দিয়েই ঢাবি উপাচার্য সাড়ে চার বছর পর নির্বাচিত উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এভাবে অপচর্চায় গণতান্ত্রিক চর্চা ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।

সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে শিক্ষাঙ্গন থেকে সেনা সরানোর দাবিতে কারাবরণ করা এই অধ্যাপক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আরও বলেন,‘ চ্যান্সেলর (রাষ্ট্রপতি) আমাকে জাবি’র ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) হিসেবে ৪ বছরের জন্য নিয়োগ দিয়েছিলেন। আমি সবসময় গণতন্ত্র অনুসরণের কথা বলে এসেছি। তাই ৭৩ এর অধ্যাদেশ সমুন্নত রাখার চেষ্টা করেছি। গণতন্ত্র চর্চার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টির দায়িত্ব নিয়ে সেখানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়েছিলাম’।

তবে জা.বি ভিসি হিসেবে মেয়াদ শেষ করতে না পারাকে দুঃখজনক উল্লেখ করে ড. আনোয়ার বলেন,‘ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে সরিয়ে দেয়ার একটা অপসংস্কৃতি চালু হয়েছে’।

তিনি মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিই এর মূল কারণ। ‘স্বার্থ চরিতার্থ করতে শিক্ষকরা সুযোগ বুঝে পক্ষ অবলম্বন করছেন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন অনেক শিক্ষক ভিসি’র পদত্যাগের জন্য আন্দোলন করছেন। অথচ তাদের অনেকেই অধ্যাপক আমিনুল হক ভূঁইয়াকে ভিসি পদে সমর্থন দিয়েছিলেন,’ বলে তিনি জানান।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষক ও প্রতিভাবান গবেষক হিসেবে অধ্যাপক আমিনুলের নিজের মর্যাদার জায়গাটি ধরে রেখে সরে দাঁড়ানোই ভালো হবে বলে মনে করেন জাবি’র ভিসি পদ থেকে পদত্যাগ করা ড. আনোয়ার হোসেন।

তিনি শাবিপ্রবিতে ড. জাফর ইকবালের স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমীন হকসহ শিক্ষকদের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এই ঘটনার পর শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখার সময় এসেছে। ‘নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা অনুসরণ করবে, শ্রদ্ধা করবে এরকম ব্যক্তিসম্পন্ন শিক্ষক যেনো কমে আসছে। গোটা পরিস্থিতি মূল্যবোধে ভাঙ্গনের ফল। আমাদের দেশের শিক্ষকরা যদি সৎ উদ্দেশ্যে কোনো আন্দোলন করে তাহলে শিক্ষার্থীরাও পাশে থাকে। ’৫২,’৭১,’৯০ এবং ২০০৭ সহ সকল ন্যায্য আন্দোলনে এটা প্রমাণিত।’

তিনি মনে করেন, গণতন্ত্র চর্চার অভাবেই এখন ভিসি অপসারণের আন্দোলন হয়। ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক সচেতনতা এবং গণতন্ত্র চর্চার অভাবে এসব আন্দোলনে লাভবান হচ্ছে কালো টাকার বিত্তশালী রাজনীতিবিদরা। শিক্ষক-কর্মচারীদের রাজনীতি চলছে। নানা সময় নানা সমিতির নির্বাচন হচ্ছে অথচ ছাত্র সংসদগুলো অকেজো পড়ে আছে। এর কারণে দলীয় লেজুড়বৃত্তির শিক্ষক-ছাত্র রাজনীতি উচ্চ শিক্ষার পুরো ব্যবস্থাকে কলুষিত করছে।

ড. আনোয়ার বলেন, এই পরিস্থিতি থেকে উচ্চ শিক্ষার শ্রেষ্ঠ অঙ্গনগুলোকে বাঁচাতে হবে। এজন্য প্রশাসনে গণতান্ত্রিক চর্চা ও শিক্ষার্থীদের রাজনীতি সচেতন হতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিতে হবে।