চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বিশ্বকাপ খেলতে ওজন কমাচ্ছেন শাহজাদ

বিশ্বকাপের সেমিতে যেতে চায় আফগানিস্তান

সিলেট থেকে: জোর খাটিয়ে ব্যাট চালালে ভুঁড়িতে ঢেউ খেলে চর্বি! ওজন বেশি বলে নিন্দুকের বাঁকা কথাও শুনতে হয়! ব্যাটিংয়ের ধরণ নিয়েও অনেকের প্রশ্ন। তবে ক্রিকেটের প্রথাগত ব্যাকরণ অনুসরণ না করেও চার-ছক্কার ঝড় তুলতে পটু তিনি, খেলে ফেলেন বড় বড় ইনিংস। আবার উইকেটের পেছনে অতন্দ্রপ্রহরী হয়ে গ্লাভসে জমান অসাধারণ সব ক্যাচ। বিস্ময় জাগানো সেই তারকা ক্রিকেটারের নাম মোহাম্মদ শাহজাদ।

চিটাগং ভাইকিংসের হয়ে বিপিএল খেলতে সিলেট এসে চ্যানেল আই অনলাইনকে দেয়া সাক্ষাতকারে এ আফগান তারকা কথা বললেন প্রিয়, এমনকি ‘অপ্রিয়’ দুটি প্রসঙ্গ নিয়েও।

শুক্রবার সকালে টিম হোটেলে তার কক্ষের সামনে যেতেই ঝটপট বেরিয়ে এলেন শাহজাদ। আগের রাতেই এসেছেন সিলেটে, এখানে চিটাগং ভাইকিংসের একমাত্র ম্যাচটি খেলতে। ঢাকা পর্বে দলের দারুণ পারফরম্যান্সের অনুরণন টের পাওয়া গেল তার কথায়। ব্যাট হাতে খুবই অস্থির প্রকৃতির হলেও মাঠের বাইরের আচরণ, হাঁটাচলা, কথাবার্তায় মিলল শান্তশিষ্ট শাহজাদকেই।

বিপিএল এবার কেমন লাগছে?
ভালো লাগছে এখানে। এবার প্রতিযোগিতা বেশি। বিপিএলের মান দিন দিন ভালো থেকে আরও ভালোর দিকে যাচ্ছে। আমরা মাত্র চার ম্যাচে তিনটা জিতেছি। তারপর লম্বা একটা বিরতি গেল। জয়ের মধ্যে থাকলে সবকিছুই ভালো যায়। সিলেট থেকে জয় নিয়েই ঢাকায় ফিরতে চাই।

নিজের ব্যাটিং নিয়ে মূল্যায়ন কী। অনেকেই বলাবলি করে ক্রিকেটীয় ব্যাকরণের ধারেকাছে নেই আপনি…
আমি অনুভব করি এটা ঈশ্বর প্রদত্ত। আমি যে ক্রিকেট ম্যাচে খেলি, সেটি নেটেও খেলি। অদ্ভুত মনে হতে পারে কিন্তু এটাই বাস্তব, প্রকৃতিগতভাবেই এটা এসেছে। আমি যখন ছোট, দশ-এগার বছর বয়স, সবে ক্রিকেটে শুরু করেছি, তখন থেকেই এভাবে খেলি।

শরীরের ভার কীভাবে সামলান। ফিটনেস নিয়ে কতটা ভাবতে হয়?
আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কোনো সমস্যা হয় না। তবে হ্যাঁ, টি-টেন লিগ থেকে এ অবধি ৩-৪ কেজি ওজন কমিয়েছি। বিশ্বকাপের আগে আরও অনেক কমাব। গত একমাস ধরে খুব মেহনত করছি। ফিটনেসের কারণে ২০১৫ বিশ্বকাপ দলে ছিলাম না। এবার খুবই সচেতন থাকছি। এটিই হয়ত আমার প্রথম ওয়ানডে বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে।

যতটুকু দেখছি আপনাদের দল সময়ের সঙ্গে ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। হযরতউল্লাহ জাজাই বিপিএলে খুব ভালো খেলছে। রশিদ খান, মুজিব-উর-রহমানের মতো স্পিনারদের নিয়ে বিশ্বকাপ খেলবেন। নিশ্চয়ই বিশ্বকাপে বড় কিছুই আশা করছেন?
ক্রিকেট খেলাটা এমন, এখানে কী হবে সেটি অনিশ্চিত। তবে আমি সুযোগ দেখছি বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ডে (সেমিফাইনাল) খেলার। এবার ফর্মেশন ভিন্ন হওয়াতে আগে থেকেই ভাবতে পারছি। প্রথম পর্বে দশটি দল সবার সঙ্গে সবার খেলা। আর আমাদের বর্তমান খেলোয়াড়দের দেখুন, রশিদ-মুজিব বিশ্বসেরা স্পিনারদের কাতারে। অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার মোহাম্মদ নবী আছে। ট্যালেন্টেড ফাস্ট বোলারদের মধ্যে আছে আফতাব আলম, দৌলত জাদরান। ব্যাটিং লাইনআপও ভালো। আজগর আফগান, আমি, জাজাই, রহমত শাহ। দলটা খুবই ভারসাম্যপূর্ণ। জানি না বিশ্বকাপে কী হবে। সবাই-ই জিততে চাইবে। আমরা ১১০ ভাগ দিয়েই খেলে চেষ্টা করবো সেমিফাইনালে যেতে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ থেকে একঝাঁক প্রতিভাবান ক্রিকেটার উঠে এলো। টেস্ট স্ট্যাটাসও অর্জিত হল। স্বপ্নের মতো মন হয় সবকিছু?
আমাদের জন্য ক্রিকেট খেলা শুধু কঠিনই-না, দুরহও ছিল। কারণটা সবাই জানেন। যখন ক্রিকেট শুরু করি, আমরা আফগানিস্তানে বসবাস করতে পারিনি। পেশোয়ারের একটি ক্যাম্পে ছিলাম। সবাই ওখানেই ক্রিকেট শুরু করি। ধীরে ধীরে একটা সময় ক্রিকেট আফগানিস্তানে আসতে শুরু করে। সে সব কঠিন ছিল। একাডেমি ছিল না, স্টেডিয়াম ছিল না, অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে আমরা এসেছি। এখন দেখতে ভালো লাগে যে, বিশ্বের এক নম্বর বোলারটি আমাদের দেশের। প্রতিটি দিনই যেখানে ক্রিকেটের জন্য কঠিন, সেই দেশটি এখন টেস্টও খেলছে। আমরা খুব উপভোগ করছি।

কীভাবে জাতীয় দলে এলেন এবং নিজের অর্জন কীভাবে দেখেন?
যখন ক্রিকেট শুরু করি, আফগানিস্তানে ক্রিকেট পৌঁছায়নি। পেশোয়ারের জিমখানা স্কুলে ক্রিকেট খেলতাম। ২০০৩ সালে আফগানিস্তান অনূর্ধ্ব-১৬ দলে খেলি। পরের ৬ বছর আফগানিস্তানের হয়ে খেলতে পারিনি। কেননা তখন পেশোয়ারেই আমার স্কুল, পড়াশুনো ছিল। ২০০৯ সালে আবার আফগানিস্তানে ফিরি। আমাদের দল ডিভিশন ওয়ান কোয়ালিফাইং রাউন্ড খেলতে সাউথ আফ্রিকা যাবে। তখন প্রথম আফগানিস্তান জাতীয় দলে সুযোগ পাই। এখন ২০১৯। এই সময়ে অনেককিছুই অর্জন করেছি। প্রথম আফগান ক্রিকেটার হিসেবে ডাবল সেঞ্চুরি করেছি চার দিনের ম্যাচে, টি-টুয়েন্টি সেঞ্চুরি, ওডিআই সেঞ্চুরি। প্রতিদিনই এগিয়ে যাচ্ছি।

দুই সময়ের মধ্যে মোটাদাগে বড় পার্থক্য কোনটি মনে হয়?
আমরা যখন শুরু করি তখন ম্যাচ খেলার জন্য ট্রাভেল করার টাকা পেতাম না। জালালাবাদ (শাহজাদের জন্মস্থান) থেকে কাবুলে খেলতে যেতে খুব সংগ্রাম করতে হত। এখন সবার প্রচুর টাকা হয়েছে। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলছে চার-পাঁচ ক্রিকেটার। এসব হয়েছে আফগানিস্তানের হয়ে ক্রিকেটে খেলার কারণেই। আমি খুব খুশি। প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করি। আমরা যখন ক্রিকেট শুরু করি ভালো কেডস, ভালো ব্যাট ছিল না। এখন তো সবকিছুই আছে।

রূপকথার মতো আফগান ক্রিকেট বদলে যাওয়ার পেছনে কোন কোন বিষয় ভূমিকা রেখেছে?
অবশ্যই আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড। যেখানে পারছে সেখানে আমাদের ক্যাম্প করছে, প্রতিবন্ধকতা নিয়েই। খেলোয়াড়দের পরিশ্রম তো আছেই। আর আমাদের দেশের জনগণের সমর্থন। ৯ মাসই আমরা দেশের বাইরে বসবাস করি ক্রিকেটের কারণে। দেশের মানুষ বিশ্বাস করে আমরা একদিন বিশ্বকাপও জিতব। বিশ্বের যে প্রান্তেই জিতি তারা খুব খুশি হয়। আনন্দের বন্যা বয়ে যায় কাবুল, কান্দাহারে। তাদের (ক্রিকেট সমর্থক) প্রতিও আমরা দায়বদ্ধ থাকি। যেটি আমাদের ভালো খেলতে অনুপ্রাণিত করে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করি।

দেশের মানুষ নিশ্চয়ই চায় নিজেদের মাঠে আপনাদের ম্যাচ দেখতে?
একদিন সে দিন আসবে। প্রতিনিয়ত সে প্রার্থনা করি আমরা। এখানকার স্থানীয় লিগে জয়সুরিয়া, গিবস খেলেছে কয়েকবছর আগে। বিশ্বাস করি কাবুলে একদিন অন্যদেশও সফরে আসবে। আমাদের খুব ভালো স্টেডিয়াম আছে কাবুল, জালালাবাদ, কান্দাহারে। কিন্তু বিদেশি দল এখানে আসতে ভয় পায়। সেখানে খুব ভালো ক্রিকেট হয়। এশিয়ার প্রতিটি দেশেই ক্রিকেট হওয়া উচিত। বিশ্বাস করি এখানেও একদিন ওয়ানডে, টেস্ট, টি-টুয়েন্টি হবে। সেদিন আমি হয়ত দলের কোচ থাকব।